জাতিকে লজ্জায় ফেলছেন পুরষ্কারপিপাসু সরকারি আমলারা
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৮:৩৯
পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হন। এর পেছনে বাঙালি বেশ ক’জন কবি-সাহিত্যিক খুব সক্রিয় ছিলেন। এদের ধারণা ছিল রবি ঠাকুর নিষিদ্ধ হলে বাঙালির মুখে মুখে তাদের নাম ফিরবে। কবি হিসেবে তারা অমরত্ব পাবেন। পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জিয়াউর রহমান, এরশাদের আমলে এদের কারও কারও কবিতা পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় লবিংয়ে। সেই পর্যন্তই। এরপর তারা শেষ। কেউ তাদের বই কিনে না। কেউ তাদের কবিতা, উপন্যাসের কোন পংক্তি উদ্ধৃত করে না। কবি, সাহিত্যিকদের জায়গা করে নিতে হয় মগজের জোরে, লেখার জোরে-তদবির বা ক্ষমতার জোরে নয়।
প্রতি বছর বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার দেওয়া হয়। গত ক’বছর এসব পুরষ্কার নিয়ে লজ্জাজনক অবস্থা তৈরি করেছেন সরকারি আমলারা। এ বছরের কথাই বলি। একজন আমলা তার বাবার জন্য সাহিত্যে সরকারি রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার যোগাড়, হ্যাঁ যোগাড়ই করেছিলেন। পুরষ্কার পাওয়ার পর চারদিকে তুমুল সমালোচনা তুফান শুরু হয়। নেটে তার কয়েকটি কবিতা পেয়েছিলাম পুরষ্কার পাওয়ার পর। এমন কবিতা লিখে পুরষ্কার পাওয়া অবিশ্বাস্য। আমলা পুত্র নিজের গৌরব বাড়াতে গিয়ে মৃত পিতাকে অপমানিত করলেন কেবল। প্রবল সমালোচনার মুখে সরকার শেষ পর্যন্ত সে পুরষ্কার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। এ ঘটনা নিয়মিত।
সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়ানোর জন্য ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বই কেনায় বরাদ্দ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেটা নিয়েও ঘটে গেছে তুঘলকি কারবার। নেট দুনিয়ায় চলছে সমালোচনা। পত্রিকাতেও রিপোর্ট হয়েছে। বইয়ের তালিকায় আমলা লেখকদের আধিপত্য। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম বুলবুলের বই রয়েছে ২৯টি। বেশিরভাগ বই-ই কবিতার! অন্যদিকে লেখক তালিকায় নেই পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, শওকত আলীদের মতো লেখকদের নাম! অবিশ্বাস্য কিন্তু বাস্তব। সমসাময়িক যারা কবি সাহিত্যিক আছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের লেখা কম বেশি পড়েছি। অনেকের সাথে ফেসবুকে, ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে। কিন্তু যে কবি বা লেখককে ২৯ খানা বই সরকার কিনেছে তার নামও কখন শুনিনি! স্রেফ অবিশ্বাস্য!
নিজ ক্ষমতাবলে যে বা যারা নিজেদের বই তালিকায় ঢুকিয়েছেন তারা লেখক রয়্যালিটির জন্য এ কাজ করেননি। শোনা যায়, আমলাদের অফুরন্ত সম্পদ এখন বিদেশে। তাহলে কেন এই বই বিলাস? আসলে তারা এ কাজ করেছেন এক ধরনের আত্মতৃপ্তির জন্য। এ আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা পুরোপুরি উন্নাসিকতাও বটে। এটা একটা জাতির জন্য ভয়ংকর। জাতির ভবিষ্যতের জন্য আরও ভয়ংকর।
ভালো কবিতা, সাহিত্য আত্মস্থ না করে কোন জাতির আত্মিক উন্নতি সম্ভব নয়। আত্মিকভাবে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। কে কি পোশাক পরবে সেটা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও আগ্রাসী ঘটনা এখনও চলমান। মগজে মগজে কেবল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। কিন্তু মগজে এগুলো ঢোকাচ্ছে কে? সুস্থ, সুন্দর সাহিত্য, সাংস্কৃতির চর্চা না থাকলে এসব ঘটবেই। ঘটছেও তা। কিন্তু আমলারা যদি এমন করতে থাকেন তাহলে কীভাবে সম্ভব সাহিত্য, সাংস্কৃতির চর্চা?
আমাদের তরুণ মেধাবী কবি-সাহিত্যিকদের অভাব নেই। এরা কাব্যসাহিত্যের চর্চা করেন নিজ তাড়নায়। এদের কেউ কেউ প্রচণ্ড অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কম বয়সে মারা যাচ্ছেন। তারপরও বিরাম নাই। কিন্তু প্রচার প্রচারনার অভাবে এসব কাব্য সাহিত্য হারিয়েও যাচ্ছে। এসব কাব্য সাহিত্য সংরক্ষণ, মূল্যায়নের দায়িত্ব কার? সরকার তথা আমলাদের। কিন্তু আমরা দেখছি আমলা নিজেদের স্বজন বা নিজেদের কবি সাহিত্যিক হিসাবে রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন নিতেই ব্যস্ত। তারাই এখন প্রতিযোগী, তারাই বিচারক।
নয় কোটি টাকার বই কিনেছে সরকার, খুব ভালো কথা। কিন্তু একজন আমলা কবি বা লেখকের ২৯টা বই না কিনে যদি ২৯জন প্রকৃত কবি অথবা লেখকের বই কেনা হতো তবে যেমন ২৯ জনের মূল্যায়ন হতো তেমনি তারা বইয়ের রয়্যালিটিও পেতেন। টাকার অংকে খুব বেশি না হলে দরিদ্র কবি সাহিত্যকদের অনেকের জন্য এইটা বিশাল অংক।
এবার অন্য একটা চিত্র দেখিয়ে লেখা শেষ করবো। সাহিত্য পুরষ্কার, সরকারি বই কেনা নিয়ে ক্রমাগত বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। চাইলেও আজকের দিনে এসব লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। যাচ্ছেও না। কিছু দিন পর পর সমালোচনা সৃষ্টি হচ্ছে। এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আমলারাই থাকছেন। জাতিকে লজ্জায় ফেলছেন পুরষ্কারপিপাসু এসব সরকারি আমলারা। এত সমালোচনা, বিতর্কের পরও এমন কেন ঘটছে? প্রশ্নের ভেতর উত্তর আছে, তাই উত্তরটি লিখলাম না।
লেখক: লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জহিরুল হক বাপি জাতিকে লজ্জায় ফেলছেন পুরষ্কারপিপাসু সরকারি আমলারা মত-দ্বিমত