Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অতিকূটনীতির সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

মোস্তফা কামাল
২৮ আগস্ট ২০২২ ১৫:৩৯

বাংলাদেশকে পেয়ে বসা বা প্রাপ্তির আশায় বিশ্বের শক্তি-পরাশক্তির অনেকে। কখনো অকারণেও প্রশংসা, কখনো আবার গেল-গেল বলে শোরগোল। মানবাধিকার লঙ্ঘণসহ কিছুদিন আগেও যারা বাংলাদেশকে নিন্দা করেছে, বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার দশায় নিয়ে গেছে তাদেরই কেউ কেউ ক’দিন ধরে আবার বাংলাদেশের টুকটাক প্রশংসা শুরু করেছে। এ কি কোনো নতুন চাল? নাকি হীরকপিণ্ড ধরার কৌশল?

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়া কে নেই এ সারিতে? কেউ আমাদের গোঁদের উপর গজানো বিষফোঁড়া রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে নিয়ে যেতে চায়। কেউবা একদম ফ্রিতে জ্বালানি তেলের খনিশুদ্ধ পাঠিয়ে দেয়। কেউবা যতো খুশি ততো নেয়ার জন্য অর্থের ঝাঁপি খুলে দেয়। কেউ তো বিনাশর্তে ফারাক্কা সমস্যাই মিটিয়ে দেয়। কাকে ছেড়ে কাকে নেবে বাংলাদেশ? কেউই তো ফেলনা নয়। আবার তাদের তুলনায় বাংলাদেশ কমজুরি দেশ। ছোটর চেয়েও ছোট দেশ। তাহলে বাংলাদেশকে পেতে এতো উতলা কেন তারা?

বিজ্ঞাপন

এদেশের কারো কারো অজানা হলেও ওই শক্তি-পরাশক্তিদের কাছে অবস্থানগত কারণে আগামীর বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশ একটি ফ্যাক্টর। হতে পারে এটি আগামীর বাংলাদেশ গড়ার মোক্ষম দূয়ার। আবার হতে পারে নষ্টের দুয়ারও। বলঅর অপেক্ষা রাখে না পুলসিরাত পার হওয়ার মতো এক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটিও সর্বনাশা। প্রাজ্ঞ চেতনায় সময়োচিত কূটকৌশল প্রয়োগের এক যুগসন্ধিক্ষণে এখন বাংলাদেশ ।

সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটের সর্বশেষ রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন উদ্বেগ না থাকা একটি মোটাদাগের কূটনৈতিক ঘটনা। বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ সফরশেষে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধানের করা ২৫ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনের খবর দেয়া হয়েছে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে। রিপোর্ট আকারে দেয়া খবরটিতে যেসব দেশে গুম বা খুনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন করা তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের জন্য এটি সোনায় সোহাগা হয়েছে। খুশিতে আটখানা হওয়ার মতো। আর বিরোধীদলের জন্য মর্মবেদনার। কতো আশাই না করেছিল তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো মানবাধিকার লংঘনই হয়নি-হচ্ছে না। মিশেল ব্যাশেলেটের প্রতিবেদনই এর প্রমাণ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এ দাবিতে জোর দিয়েছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

মানবাধিকারলঙ্ঘন বিষয়ে সরকারের এমন বাজিমাত বিএনপির জন্য মাঠে মারা যাওয়ার দশা। মানবাধিকার, পুলিশ প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনির কয়েক কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বেশ ফুরফুরে ছিল তারা। এখন পরিস্থিতিতে ইউটার্ন। জাতিসংঘের রিপোর্টে মন্দ কিছু নেই। শর্তাধীনে হলেও যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের সামিটে ভিসা পেয়েছেন আইজিপি। এ অবস্থায় বিএনটি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শর্ত সাপেক্ষে আইজিপি বেনজিরের যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা পাওয়া দেশের জন্য মারাত্মক অসম্মানের।

৩১ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান হিসেবে চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করবেন মিশেল। এ উপলক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টটির গুরুত্ব উচ্চমাত্রার। মিশেলের এই রিপোর্টকে গুরুত্বসহকারে দেখছে ঢাকা। সফরকালে সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মানবাধিকার বিষয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো তারা অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছেন। এরপরই করেছেন রিপোর্টটি। এতে গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বাংলাদেশের নাম না আসার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা যুগান্তকারী অর্জনের বিশেষ স্বীকৃতি যেনতেন বিষয় নয়। তা অনেকের অনেক হিসাব পাল্টে দিয়েছে। তারওপর রিপোর্টে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একতরফা মিয়ানমারকে দোষারোপের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর মানবতার দিক উঠে এসেছে।

ঠিক এ রকম সময়েই রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের হিতাকাঙ্খার বার্তা শুনিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্তিতে গত ২৫ আগস্ট এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন জানিয়েছেন, মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ‘বড় সংখ্যককে’ আশ্রয় দেবেন তারা। একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাপানও। একইদিন ঢাকায় ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতে এক আলোচনায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের চাপের শরীক হবেন তারা। আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও বলেছেন, এ চাপ ভাগাভাগিতে এগিয়ে আসতে।

রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাপানের রাষ্ট্রদূতের আশ্বাস নিয়ে নেগেটিভ এবং টিপ্পনিসহ রসঘন কথাবার্তা ঘুরছে স্যোশাল মিডিয়ায়। রয়েছে সন্দেহ-অবিশ্বাসও। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার কতোজনকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান শেষ পর্যন্ত দেশে আশ্রয় দেবে; এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে; কতদিন নাগাদ প্রক্রিয়া শেষ হবে?- এ সংক্রান্ত প্রশ্ন ঘুরছে। এ ধরনের প্রশ্ন ও সংশয়ের বাস্তবতাও আছে। এক এক সময় এক এক অবস্থান নেয়া এই পরাশক্তি কদিন পর আবার কথা বদলে ফেললে কী অবস্থা দাঁড়াবে? আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে দিলে কী হবে? বাংলাদেশ কি একা প্রায় ১২ লাখ মানুষকে খাওয়াবে?

এতো প্রশ্ন ও শঙ্কার জোগান বেশিরভাগ বিদেশিরাই জাগিয়েছে। তাদের এক এক বার্তা ও মন্তব্যের সারবত্তা বুঝতে ঝানু কূটনীতিকদেরও অনেক সময় লাগছে। বাংলাদেশে ৫ দিনের সফর শেষে গত ২৫ মে রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, ‘ইউক্রেন ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের সাহায্য নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। তাই দাতাদের এই সহায়তা না কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এখানে মোক্ষম প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, কেন আসছে সহায়তা কমানোর প্রসঙ্গ? কেনই বা এ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা? সমস্যাটা কোথায়? আগে-পিছে, ডানে-বামে কী আয়োজন বাংলাদেশ নিয়ে? এ সব প্রশ্নের কিনারা পেতে ভাবনার অনেক বিষয়আসয় যোগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এজেডএস

অতিকূটনীতি বাংলাদেশ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর