Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএনপি-জামাত, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ

মোঃ আসাদ উল্লাহ তুষার
১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:১৭

জামায়াতে ইসলামের আমির ডা.শফিকুর রহমানের একটি ভিডিও বক্তব্য থেকে জানা যায় জামাত আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটে নাই। এছাড়াও জামাত আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই লক্ষে দলটি ১২০ আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। যা ইতিমধ্যেই পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। জামাতের আমিরের যে বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা পত্রপত্রিকায় এসেছে সেটা কোন আনুষ্ঠানিক বা তাদের দলের পাকা কোন সিদ্ধান্তের খবর হিসেবে নয়। তাদের দলের কোন গোপন বৈঠকে দেয়া দলের শীর্ষ নেতার বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। কারণ জামাত এই মুহূর্তে একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারনে আদালতের নির্দেশে তাদের দলের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। পত্রপত্রিকা মারফত বোঝা যায় বেশ কিছুদিন যাবৎ জামাত তাদের প্রধান মিত্র বিএনপির সাথে প্রকাশ্যে তেমন কার্যক্রমে নাই। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জোটের হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে গো হারা হেরে কিনা, বিএনপির সাথে যুগপৎ কোন আন্দোলন বা সভা সমাবেশে দেখা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

হঠাৎই জামাতের এই বিএনপি বা তাদের জোট ছেড়ে দেয়ার ঘোষণায় রাজনৈতিক ময়দানে বেশ একটি শোরগোল পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও এই জোট ছাড়ার কথা কোন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয় নাই। যাকে অফিসিয়ালি ঘোষণা বলা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিএনপি বা জামাত নেতাদের বিচ্ছিন্ন বক্তব্য পত্রপত্রিকায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে। কিন্তু কি কারণে হঠাৎ করেই জামাত তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক মিত্র বিএনপি তথা বিশ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিলো তা নিয়েই রাজনৈতিক ময়দানে হালকা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কারণ উভয় দলের নেতারা বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়ে বলেছে জামাত ও বিএনপি একই মায়ের পেটের দুই ভাই। একই মায়ের পেটের দুই ভাইয়ের মাঝে মাঝে ঝগড়া বা মনমালিন্য হয়,তাই বলে ভাই হয়ে ভাইকে অস্বীকার করার কোন জো নাই। তাছাড়াও বিএনপি জামাত জোট হওয়ার কারণে তাদের উভয়েই ব্যাপক লাভবান হয়েছে। তাদের আদর্শ উদ্দেশ্যও প্রায় একই ধরণের। সমাজিকভাবেও জামাত বিএনপির একই সাথে চলাফেরা। জামাত প্রকাশ্যে ও চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাদের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন ও সরকার গঠন করে দুইবার ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ১৯৯১ সালে এরশাদ পতনের পর জামাতের সমর্থনে সরকার গঠন করে বিএনপি। পরে ২০০১সালে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন ও নির্বাচন করে বিপুল জয়লাভ করে জামাতকে নিয়েই সরকার গঠন করে বিএনপি। সেই সরকারে জামাতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ দুইটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে পুরো পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। নিজামী ও মুজাহিদ পরবর্তিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলে। সেই পাঁচ বছর প্রায় পরিপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে জামাত। যদিও জামাত স্বাধীনতার পর জেনারেল জিয়ার স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের আমলে রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ বাদে সব সরকারের আমলেই অনেক আরাম আয়েশে রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য করে ফুলে ফেঁপে উঠে। একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে দেশবাসীর কাছে ঘৃণিত জামাত, জিয়া- এরশাদ- খালেদা – মঈনুদ্দিন ফখরুদ্দিন সরকারের সময়ে মিলে মিশে বুক ফুলিয়েই লাখো শহীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করে।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরের ঘৃণিত ও পরাজিত শক্তি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাতের উত্থানের প্রধান শক্তি হলো বিএনপি। বিএনপি নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকে জামাতের উত্থানের পিছনে মদদাতা ও প্রধান শক্তিই হলো বিএনপি। তাই সেই বিএনপিকে ছেড়ে জামাত দূরে থাকবে একথা দেশবাসী কোনোভাবেই বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে বিএনপিরও অন্যতম শক্তির জায়গা হচ্ছে এই স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবির ও বিভ্রান্ত কিছু বাম শক্তি। যারা উভয়েই একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগিতা করেছিল।তাদের এই দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময়ের মাখামাখি ও বন্ধুত্ব এত সহজেই যে শেষ হওয়ার না এটা দেশবাসী জানে। হতে পারে এটা তাদের সাময়িক কৌশল, কারণ জামাত তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা ধরনের অপকৌশল করে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। তাই জামাতের বিএনপি বা জোট ছেড়ে যাওয়ায় ঘোষণায় রাজনৈতিক ময়দানে সাময়িক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। শেষ বিচারের এই জামাত কি করে তা চূড়ান্তভাবে না দেখে কিছুই বলা যাবে না।

বিএনপিকে নিয়ে জামাতের কিছু অভিমান হয়তো থাকতে পারে। কারণ অতীতে তারা বিএনপির জন্য যা যা করেছে বা বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে জামাত তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বর্তমানে বিএনপির কাছ থেকে তাদের চাহিদামতো কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা বা সহমর্মিতা না পেয়ে তারা একটু অভিমান করতে পারে। আবার এমনও হতে পারে জামাত নিজেদের দাম বাড়ানোর জন্য রাজনীতির ময়দানে জোট ছাড়ার কথা প্রচার করে বিএনপির কাছ থেকে নিজেদের জন্য আরো সুবিধা আদায়ের পথকে সহজ করা। কারণ জামাত এই মুহূর্তে অনিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। তারা বিএনপি জোটে থাকলে তাদের ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করতে হবে, আর আলাদাভাবে নির্বাচন করলে তাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে হবে। অন্যদিকে জামাতের অবস্থা যাই হোক বিএনপির ভবিষ্যতও যে অন্ধকার তা হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছে জামাত। বিএনপির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া দন্ডিত অবস্থায় কারারুদ্ধ হয়ে নিজ বাসায় বন্দি ও বয়সজনিত অসুস্থতায় তার ভবিষ্যৎ ধোঁয়াসে। আরেক নেতা তারেক রহমান ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বর্বর গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অন্য আরো মামলায় দন্ডিত হয়ে বিদেশে ফেরার । তারও রাজনীতিতে ফেরা দুরপরাহত। এসব বিবেচনায় জামাতের বর্তমান অবস্থার চাইতেও যে বিএনপির অবস্থা করুন এটা ভেবেও বিএনপিকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে জামাত।

জামাত বর্তমানে হয়তো প্রকাশ্যে মিটিং মিছিল করতে পারছে না। তাছাড়া জামাতের কোন কার্যক্রমই থেমে নেই। তারা গোপনে গোপনে তাদের দলকে সংগঠিত করতে বিভিন্ন পন্থায় তারা নিজেদের শক্তি ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জামাত শিবির এর আগে প্রকাশ্যে রাজনীতি করলেও তাদের অধিকাংশ কার্যক্রমই ছিল গোপন কার্যক্রম। অতীতে তাদের এদেশে সামাজিকভাবে মানুষের সাথে তেমন মেলামেশা করার নজির নাই। তারা তাদের শক্তি বাড়াতে সব সময়ই টার্গেট করে এগিয়ে গেছে। তারা প্রায় সব সরকারের আমলেই নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করতে অনেক সময় নিজেদের পরিচয় গোপন করে, না হয় সরকারের সাথে লিয়াজো করে ব্যবসা বাণিজ্য করে জামাতের নেতারা অনেক অর্থসম্পদের মালিক হয়েছে। জামাত তাদের অতীতের ঘৃণিত কর্মকান্ডের কারণে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল সেখান থেকে বের হয়ে সামাজিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতে পারে । একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে সাজা হয়ে শীর্ষ অনেক নেতা ফাঁসিতে ঝুলেছে এবং অনেকেই জেলে আছে। জামাত হয়তো এই মুহূর্তে ভাবছে রাজনীতিতে তাদেরকে আর প্রকাশ্যে না এনে বর্তমানে যে নেতৃত্ব আছে তাদেরকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করার একটা সুযোগ তারা আলাদাভাবেই নিতে চায়। সেক্ষেত্রে তাদের নিজেদের শক্তিমত্তা জাহির করা এবং অন্যকে বিশেষ করে বিএনপিকে তা দেখানো তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকতে পারে। উদ্দেশ্যটা যে জামাতের একান্তই লাভালাভের তাতে কোন সন্দেহ নাই।

কিন্তু রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল জামাত বিএনপির ছাড়াছাড়ি হবে তা বিশ্বাস করছে না। বিশেষ করে বিএনপি তাদের প্রধান মিত্র শক্তিকে কোন ভাবেই হাতছাড়া করবে বলে মনে করছে না। জামাত যদি আলাদাভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেটা কি বর্তমান সরকারের অধীনেই করবে, নাকি বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী কোন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করবে সেটা অবশ্য পরিস্কার না। যদিও জামাতের বরাতে যে খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তাদের এসব কথার অফিসিয়ালি কোন ভিত্তি নেই। এটা এই মুহূর্তে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে জামাত বিএনপির একটি ড্রামা হতে পারে। কারণ এই দুটো দলই নানা সময়ে দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে একসাথে থেকেছে। তাই রাজনৈতিক মহল তাদের এই ছাড়াছাড়ি বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ তাদের ভাষায় এবং কার্যক্রমে একই মায়ের পেটের দুই ভাই কেনই বা আলাদা হবে। অবশ্য এই মুহূর্তে তাদের এক বা আলাদা চলায় দেশের মানুষের কোন মাথাব্যথার কারণ নাই। এদের অতীতের একসাথে চলা ও আন্দোলন করা দেশবাসী দেখেছে। একসাথে সরকারে থাকতে গ্রেনেড হামলা করে বিরোধী রাজনীতিকে শেষ করে দেয়া,দেশের ৬৩ জেলার পাঁচশ জায়গায় একসাথে বোমা হামলা করা, বাংলা ভাই সৃষ্টি করে দেশকে মৌলবাদী জঙ্গি রাষ্টে পরিণত করা, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন নির্যাতন করা অতীতে এরা একসাথেই করেছে। একসাথে আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী আগুন সন্ত্রাস,জানমালের ক্ষতি করা,বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও লবিং করাও দেশের মানুষ দেখেছে। তাই এরা যাই করুক দেশের যে ভালোর জন্য করে না বা করবে না তা দেশের মানুষ জানে।

বরং এখন দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্য। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং দেশের কল্যানে এর কোন বিকল্প নেই। অস্বীকার করার উপায় নেই দেশের রাজনীতিতে প্রধান দুইটি ধারা চলমান আছে। তার একটি ধারা বা মূল ধারার নেতৃত্বে দিচ্ছে প্রধানত:আওয়ামী লীগ বা চৌদ্দ দলীয় জোট । আর অন্য একটি ধারা ধ্বংসাত্মক, প্রতিক্রিয়াশীল,দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি-জামাত এবং তাদের সাথে সঙ্গ দিয়ে দেশবাসিকে বিভ্রান্ত করছে সুশীল নামধারী কিছু ব্যক্তি ও জনবিচ্ছিন্ন কয়েকজন রাজনীতিক। কারণ জামাত বিএনপির জোড়া লাগাও কোন সুস্থ চিন্তা বা কর্মের জন্য ছিল না। তাদের ছাড়াছাড়িও একে অপরের অপকর্ম বা অপরাজনীতির দায়ভার নিজেদের ঘাড়ে না নেয়ার জন্য। তাই জামাত বিএনপি উভয়েই উভয়ের অপকর্ম থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি আড়াল করতে এই ধরণের ছাড়াছাড়ির খেলা খেলবে সেটাই স্বাভাবিক। বর্তমান অবস্থায় জামাত বিএনপি একে অপরকে ছাড়া অচল এবং এদের উদ্দেশ্য আদর্শ প্রায় একই। কারণ জামাত -বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একই মায়ের পেটের দুই সন্তান।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিএনপি-জামাত মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মত-দ্বিমত মোঃ আসাদ উল্লাহ তুষার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর