Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সীমান্তে আগ্রাসী মিয়ানমার, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষতি

সামিনা আখতার
৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:২৬

কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। স্থানীয় নাইক্ষ্যংছড়ি এবং ঘুমধুম সীমান্তের মধ্যে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ সীমান্ত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত শনিবার সকালে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে বান্দরবানে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে শেল নিক্ষেপ ও গুলি করা হয়। এদিন সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার আকাশে ঢোকে মিয়ানমারের কমপক্ষে চারটি যুদ্ধবিমান। পুলিশ এবং স্থানীয়রা বলছেন, ঘুমধুমের তুমব্রু এলাকায় বিজিবি-বিওপি সীমান্তে পিলার নম্বর ৪০ ও ৪১ এর মধ্যে মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার টহল দিয়েছে। ওই একই সময়ে যুদ্ধবিমান থেকে ৮ থেকে ১০টি গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের মুরিঙ্গাঝিরি ক্যাম্প এবং তমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকেও গুলি করা হয়েছে। এর আগে ২৮শে আগস্ট রোববার মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। এদিন মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া দুটি মর্টারশেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনার পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের অবস্থার অবনতির বিষয়টি বাংলাদেশ জানে। আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে ওইসব অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। তবে এখন মিয়ানমার থেকে যাতে আর কেউ বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সে জন্য বাংলাদেশ আগের চেয়ে ভালোভাবে প্রস্তুত। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, আমরা মিয়ানমারের প্ররোচনা অথবা ফাঁদে পা দিতে চাই না। মিয়ানমার যদি একতরফাভাবে এসব চালাতে পারে তাহলে তাতে তারা কৌশলগত সুবিধা হারাবে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে এই ধরণের উত্যক্ত আগ্রাসন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্যও হুমকি। এসব ঘটনা শুধু বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের জন্যই নয়, একই সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও ক্ষতিকর। গতকাল রোববার বিকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে যে গোলা এসে পড়েছে, তাতে সীমান্তবর্তী তব্রু উত্তরপাড়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসব শেল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের বোমা নিষ্ক্রীয়করণ ইউনিট নিষ্ক্রিয় করেছে। এমন পরিস্থিতি ন্যায়সঙ্গতভাবে বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এ ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত বা দুর্ঘটনাবশত কিন্তু সেটি বাংলাদেশের ওপর হুমকি তো বটেই। এ ধরণের হঠকারী ঘটনা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এমনিতেই চার দশকেরও বেশি সময়ে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে শুধু ২০১৭ সালেই বাংলাদেশে এসেছেন কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবর্তনের সমাধান না হওয়ার কারণে এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। দুই দেশই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু প্রত্যাবর্তন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমে ২০১৭ সালে এবং তারপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এর প্রধান কারণ হলো মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অনীহা এবং মিয়ানমারে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। রোববারের মর্টার ছোঁড়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং আঞ্চলিক শান্তির প্রতি মিয়ানমারের অসম্মান দেখানোর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। এসব ঘটনা এখন পর্যন্ত মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে বলে জানা যায়নি। এমনকি তারা তাদের অবস্থানও পরিষ্কার করেনি।

এর আগে ২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অনেকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার। বাংলাদেশকে অসম্মান জানানোর সেই ঘটনাও নোট করা আছে। ওই সময় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তারপরও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলে দেয় যে, মিয়ানমার অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখারও পরিপন্থি। এসব ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদি তা-ই হয় তাহলে তা মিয়ানমারের স্বার্থেও যাবে না, বাংলাদেশ আঞ্চলিক অন্য দেশগুলোর স্বার্থেও যাবে না। একটি স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী কাম্য। প্রকৃতপক্ষে তা যে কোনো দেশের জন্য প্রয়োজন। অস্থিতিশীল রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি। অস্থিতিশীল সীমান্ত সেখানে বসবাসকারীদের জন্য হুমকি। তাই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো, মর্টারশেলের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং এমন ঘটনা আর কখনো ঘটবে না; এমনটা দাবি করা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এবং এটা করা উচিত উভয় দেশ এবং এ অঞ্চলের স্বার্থের জন্য। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের কাছে মর্টারশেলের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটাই যথেষ্ঠ নয়। একইসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রতিক ও আগের সব আন্তর্জাতিক আইনলঙ্ঘনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যেসব মানুষ বসবাস করেন, তারা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, সেজন্য ওই সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা উচিত সরকারের।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কড়া প্রতিবাদ জানাতে বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কাইওয়া মোয়েকে এর মধ্যেই তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, মিয়ানমারকে সতর্ক করেছে সরকার। মিয়ানমার নিশ্চয়তা দিয়েছে, তারা আরও সতর্ক থাকবে। একইদিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাখাইনের অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমার থেকে যাতে আর কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য বাংলাদেশ ভালোভাবে প্রস্তুত। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ভেতরে মর্টারশেল পড়ার পর আগস্টে দু’বার সতর্ক করা হয়েছে মিয়ানমারকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো বলেছেন, মিয়ানমারের প্ররোচনা এবং ফাঁদে আমরা পা দেব না।

আগেই উল্লেখ করেছি, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে। একইসঙ্গে এটাও ঠিক, বিদ্রোহ মোকাবিলা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অনিচ্ছাকৃত ভুলের নামে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে পারে না মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তাদের অবশ্যই শ্রদ্ধা থাকতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবশ্যই মিয়ানমারের শ্রদ্ধা থাকতে হবে। অব্যাহতভাবে তাদের ওইরকম মনোভাব দ্বিক্ষীয় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অস্থিতিশীল করে তুলবে পুরো অঞ্চল। মিয়ানমারকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, বাংলাদেশও সামরিক দিক দিয়ে সক্ষম একটি দেশ।

লেখক: মানবাধিকারকর্মী ও ফ্রিল্যান্স লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মত-দ্বিমত সামিনা আখতার সীমান্তে আগ্রাসী মিয়ানমার- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর