Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএনপি এখন কী-ও করতে পারবে না!

প্রভাষ আমিন
৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:৩৬

এরশাদ আমলে রাজনীতিতে একটা টার্ম ছিল ‘ঘরোয়া রাজনীতি’। এর মানে হলো রাজপথে নয়, রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো যাবে ঘরের ভেতর। বিএনপি বহুদিন ধরে ঘরোয়া রাজনীতি করে আসছিল। দলীয় কার্যালয়ে ব্রিফিং আর বিভিন্ন উপলক্ষ্যে প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা আর সেমিনারে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কর্মকান্ড। প্রেসক্লাবের হল থেকেই তারা সরকারের পতনের, গণআন্দোলনের ডাক দিচ্ছিল। বিএনপির মাঠে নামা এবং আন্দোলন করার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছিলেন অনেকে। ঘরোয়া রাজনীতির খোলস ছেড়ে ইদানীং বিএনপি মাঠে নামতে শুরু করেছে। আমার ধারণা, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গোছানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বিএনপি রাজপথে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হতে পারে, সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের সাথে আলাপচারিতা তাদের মাঠে নামতে উৎসাহী করেছে। নির্বাচনকে সামনে মাঠের অবস্থা গণতান্ত্রিক দেখাতে সরকার হয়তো নমনীয় থাকবে, এমন ধারণাও তাদের মাঠে নামতে সাহসী করেছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী নিজে একাধিকবার বলেছেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার বাধা দেবে না। কিন্তু মাঠে নামতে গিয়ে বিএনপি দেখতে পেলো, সরকারের মনোভাব বদলায়নি। বিরোধী দলের ব্যাপারে তারা আগের মতই কঠোর। বিশেষ করে গত ৩১ জুলাই ভোলায় দুই কর্মীর মৃত্যু বিএনপি নেতাকর্মীদের আরো বেশি করে মাঠে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভোলার ঘটনার পরপর নেতাকর্মীরা হরতালের দাবি জানালেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের আগে মাঠ দখল করার পরামর্শ দেন। মাঠ দখলের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১০ আগস্ট অনেকদিন পর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। সেই সমাবেশে বিপুল উপস্থিতি দুই দলে দুই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিএনপি আরো কর্মসূচি পালন করতে অনুপ্রাণিত হয় আর আওয়ামী লীগ নমনীয়তার নীতি বদলে কঠোর অবস্থানে চলে যায়।

ফলে ২২ আগস্ট থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি ধারাবাহিক মার খেতে থাকে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা, নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, মারধোর, পাল্টা কর্মসূচি ডেকে ১৪৪ ধারা জারি করানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। এই ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও অংশ নেয়। বোঝাই যায় সরকার ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে বিএনপিকে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার ধারণা সরকারি দল ভেবেছিল, দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে, রাজপথের আড়ালে থাকায় বিএনপি দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু মাঠে নামার সুযোগ পেয়েই বিএনপি দেখিয়ে দিয়েছে, তারা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। সে কারণেই হয়তো সরকারি দল নমনীয়তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। নির্বাচন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে মাঠে থাকার সুযোগ পেলে বিএনপি নিজেদের গুছিয়ে ফেলতে পারে, এটাও হয়তো সরকারি দলকে শঙ্কিত করেছে। তাই তারা সাঁড়াশি আক্রমণে বিএনপিকে আবার মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। তবে বিএনপি এবার আগের মত মার খেয়েই লেজ গুটিয়ে পালায়নি। বরং মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নীতি নিয়েছে। তবে বিএনপি কতদিন মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

সন্দেহটা হয়েছে, গত ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে যুবদল কর্মী শাওনের মৃত্যুর ঘটনায়। বিএনপির সাধারণ বিক্ষোভ মোকাবিলা করতেই যদি পুলিশকে গুলি ছুঁড়তে হয়, তাহলে তো আর আন্দোলন করার সুযোগ থাকবে না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আক্রান্ত হলে তারাও বসে থাকবেন না। খুবই নায্য কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন? বিএনপি নেতা কর্মীরা আাওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করবে, এই বাস্তবতা বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই নেই। আমরা বরং দেখছি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে, কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিএনপির কর্মসূচির কাছে যাবেই বা কেন। বিএনপি তাদের জায়গায় কর্মসূচি পালন করবে। কোনো জবাব দেওয়ার থাকলে, আওয়ামী নিজেদের কর্মসূচি করে তার জবাব দেবে। এখন আওয়ামী লীগ কর্মীরা যদি বিএনপির কর্মসূচির সামনে গিয়ে মার খেয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে বিএনপিকে দোষ দেওয়া যাবে কি? বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার যুক্তি হিসেবে পুলিশ বরাবরের মতই বলে আসছে, জনদুর্ভোগ হয় এমন কোনো কর্মসূচি দিলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেবে। খুবই জনবান্ধব যুক্তি। কিন্তু মাঠে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গেলে জনদুর্ভোগ একটু হবেই, সেটা যে দলই করুক না কেন। একসময় আওয়ামী লীগও দিনের পর দিন মাঠে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এখনও বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সভা-সমাবেশ, মিছিল করে। আর তাদের সেসব কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগও হয়। এমনকি যে নারায়ণগঞ্জে যুবদল কর্মীকে মেরে ফেলা হলো, সেখানেও কয়েকদিন আগে সরকারি দল কর্মসূচি পালন করেছে। এখন বিএনপির কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ হবে আর আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে হবে না; ব্যাপারটা তো এমন নয়। পুলিশ তো কোনো দলের নয়, সবার প্রতি সমান আচরণ তাদের দায়িত্ব। কিন্তু পুলিশ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ন্যায্যতার সাথে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপি মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারবে কিনা, এ নিয়ে আমার শঙ্কা অবশ্য ভিন্ন কারণে। দেশের বিভিন্নস্থানে বিএনপির নেতাকর্মীরা আক্রান্ত হলেও মামলা হয়েছে উল্টো তাদের নামেই। নারায়ণগঞ্জে যুবদল কর্মী মারা গেলেও আসামী হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরাই। এমনিতেই বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার শেষ নেই। এই দফায় নতুন করে আসামি হয়েছে আরো কয়েক হাজার। তাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ হামলা এবং মামলার চাপে বিএনপি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকতে পারবে কিনা, শঙ্কাটা এখানেই। আন্দোলন করতে গেলেই বিএনপির শক্তিক্ষয় হবে। মাঠে নামলে মার খেতে হবে, গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। অন্তত নির্বাচন পর্যন্ত মাঠের আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার মত সাংগঠনিক সক্ষমতা এই মুহুর্তে বিএনপির আছে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা বিএনপিকে আবার ঘরোয়া রাজনীতিতেই ফিরে যেতে হবে। হয়তো নির্বাচনের আগে আগে তারা আবার মাঠে নামার চেষ্টা করবে।

বিএনপি আসলে উভয় সঙ্কটে পড়েছে। বিএনপি যখন প্রেসক্লাবের ঘরোয়া আসরে আন্দোলনের হুমকি দেয়, সরকারি দলের নেতারা তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আর হাসিঠাট্টা করেন। আর যখন মাঠে নামে, তখন মামলা-হামলায় পর্যদুস্ত করে মাঠছাড়া করতে চায়। বিএনপি এখন কী করবে? একটা গল্পে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। এক পথিক এক ফসলের মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সেটা দেখে কৃষক ছুটে এলেন, তার ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। কৃষক এসে সেই পথিককে থামালেন। পথিক তখন ক্ষেতের মাঝামাঝি। বললেন, আমি কি পিছনের দিকে চলে আসবো? কৃষক বললেন, না। পথিক বললেন, তাহলে কি আমি সামনে চলে যাবো? কৃষক বললেন, না। পথিক পড়লেন বিপাকে, তাহলে আমি কী করবো? ফসলের ক্ষতির চিন্তায় ব্যাকুল কৃষক বললেন, তুমি কী-ও করতে পারবে না।

বিএনপির দশা হয়েছে তাই। বিএনপি এখন কী-ও করতে পারবে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

টপ নিউজ প্রভাষ আমিন বিএনপি এখন কী-ও করতে পারবে না! মত-দ্বিমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর