পরিবেশ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য স্কুলবাস
১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:৩১
পৃথিবীর অনেক ধনী ও উন্নত দেশের বড় বড় শহরে যানজটের সমস্যা আছে। কিন্তু ঢাকার যানজট সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানীতে যানজট বেড়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম কারণ হলো ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। গণপরিবহনে জোর না দিয়ে ব্যক্তিগত পরিবহন বা ছোট গাড়িকে উৎসাহ দেওয়া সড়কের বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তুলছে। যানজটের জন্য রাজধানীর এখন ‘আইসিইউ’তে থাকার মতো অবস্থায় আছে।
রাজধানীতে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ছোট গাড়ির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এক কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে দুই একটি যাত্রীবাহী গাড়ির দেখা মেলে। আর সব ছোট গাড়ি ও মোটরসাইকেল। আর ছোট গাড়িগুলোর প্রতিটিতেই এসি চলার ফলে রাস্তার আবহাওয়া আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
ঢাকা শহরের মতো বাংলাদেশ বিভিন্ন বিভাগের ব্যক্তি গাড়ি সংখ্যা বেড়ে যাওয়া জ্বালানি তেলের খরচ বেশি হচ্ছে। বাড়ছে যানজটের ভোগান্তি ও পরিবেশদূষণ। আর এর জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশন (ডিএনসিসি) এক ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে।
ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে স্কুলবাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। আর এতে যানজটে ভোগান্তি, পরিবেশ দূষণ কমবে এবং জ্বালানি সাশ্রয় হবে। দূষণ কমার পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এতে অনেক শিক্ষক একমত পোষণ করেছেন। এটি বাস্তবায়নে অভিভাবকদের সদিচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে এমনটাও অনেক স্কুলে দেখা যায়। ফলে অফিস সময়ে রাস্তায় চলাচল করে অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়ি। স্কুলবাস চালু হলে ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর চলাচল কমে যাবে। আর এক সঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়ার করলে ছেলে-মেয়েদের মাঝে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হবে ও তাদের সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হবে। একইভাবে ছেলেমেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বড় হওয়ার পাশাপাশি বাড়বে তাদের সক্ষমতাও। আর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার ফলে একই শ্রেণিতে পড়ে, কিন্তু একজন অন্যজনকে ঠিকমতো চেনে না বা কথাও হয় না। এতে তাদের মধ্যে সমাজিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে স্কুল বাসে যাওয়া-আসা করলে তারা আনন্দ পাবে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হবে।
পরীক্ষামূলকভাবে ডিএনসিসি প্রথমে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কর্যক্রম শুরু করবে। এই কর্যক্রম ফলপ্রসূ হলে এ সেবা প্রতিটি স্কুলে চালু হতে পাড়ে। অভিভাবকরা স্কুলবাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেন। সবগুলো প্রশ্নেই জবাব দেয়া হয়।
কারণ প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে তাদের সন্তানরা মূল্যবান সম্পদ। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে স্কুলবাসগুলোতে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাসহ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। অ্যাপের মাধ্যমে ট্র্যাকিং করা যাবে। কখন বাসে উঠল, বাস থেকে কখন নামল, স্কুলে কখন প্রবেশ করল- সবই অ্যাপের মাধ্যমে ঘরে বসেই অভিভাবকরা পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। বাসচালক ও কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। জরুরি প্রয়োজনের হটলাইন নম্বর থাকবে, শিক্ষার্থীর বাসার ঠিকানা অনুযায়ী বাসের রুট নির্ধারণ করা হবে।
স্কুলবাসে শিক্ষার্থীদের পৌঁছাতে দেরি হলে দায়ভার স্কুল কর্তৃপক্ষ নেবে। একজন শিক্ষার্থী যে সময় স্কুলবাসে উঠবে, ওই সময় থেকেই শিক্ষার্থীর উপস্থিতি গণ্য করা হবে। বাস দেরি করলেও কোনো শিক্ষার্থীর স্কুলে প্রবেশে সমস্যা হবে না।
অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। তাদের যেন ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া আসা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে হয়, সেক্ষেত্রে স্কুলবাসই নিরাপদ সমাধান।
শুধু উত্তর সিটি করপোরশন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে চলবে না। দক্ষিণ সিটি করপোরশন সহ বাংলাদেশের সকল জেলা তা বাস্তবায়ন করলে এর সুফল পাওয়া যাবে। সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতেও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে গণপরিবহন বা যৌথভাবে পরিবহন ব্যবহার করলে ব্যয় অনেকাংশে কমে আসবে। রাস্তায় যানজট, জ্বালানিক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ কমবে।
ইতোমধ্যেই অনেক রাস্তায় মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমেছে যানবাহনের গতি। যানজট পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। ছোট ছোট যানবাহনের সংখ্যা যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। রাজধানীর চারপাশের জলপথ ব্যবহার করে যানজট কমানো সম্ভব।
বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা সংস্থা প্লাস ওয়ান জার্নাল এক গবেষণায় বলছে, ২০-২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫ দশমিক ১ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের ৪ দশমিক ৯, ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ৪ দশমিক ৮২ আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার। সব বয়সী মানুষের গড় হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার, যেটি বর্তমানে পিক টাইমে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি।
নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার হলেও ঢাকায় আছে নয় শতাংশের মতো। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে গণপরিবহন বাড়ানোর পরামর্শ বিভিন্ন সময় দেওয়া হয়েছে। তবে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে যানজট নিরসনে নানা প্রকল্প নেয়া হলেও ব্যক্তিগত ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলছে। ফলে এসব প্রকল্প যানজট নিয়ন্ত্রণে তেমন কাজে আসছে না।
বিআরটিএ-র হিসাবে, চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে সারাদেশে ৯৬ হাজার ৮৭৮টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে। এ সময় ঢাকায় নিবন্ধিত হয় ২৯ হাজার ৬৭৮টি যানবাহন, যা মোট সংখ্যার ৩০ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মোটর যানের সংখ্যা ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টি। এর মধ্যে প্রাইভেটকার ৩ লাখ ৮৫ হাজার। বাস ৪৯ হাজার ৬৭৩টি। মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার। যানজটের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন পুলিশ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
ঢাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া-আসা করে। সেক্ষেত্রে একজনের জন্য বের হয় একটি গাড়ি। একটা গাড়ির জায়গায় যদি ১০টা গাড়ি থাকে, তাহলে যানজট হবে, এটাই স্বাভাবিক। গাড়ি বেশি থাকলে ইন্টারসেকশনে গাড়ির সংখ্যা বাড়বে। এগুলো ম্যানেজ করা তত কঠিন হয়ে যাবে।
বর্তমানে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ১০ম স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ১০১ নিয়ে এ স্থানে অবস্থান করছে রাজধানী। পাকিস্তানের লাহোর, ভারতের দিল্লি ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ যথাক্রমে ১৮১, ১৫৯ ও ১৪১ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকায় প্রথম তিনটি স্থান দখল করেছে।
বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য একিউআই স্কোর ১০১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়। সেই হিসাবে ঢাকায় বাতাসের মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় রয়েছে।
একইভাবে ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘খারাপ’ বলা হয়। যেখানে ৩০১ থেকে ৪০০-এর স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়। বাসিন্দাদের জন্য যা গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয়। সেই সঙ্গে তাদের জন্য কোনো ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়।
বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে-বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২ দশমিক ৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ক্রমাগতভাবে বিশ্বব্যাপী মৃত্যু এবং অক্ষমতার জন্য বায়ুদূষণ শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়ার কারণে হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সার হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
পরিবেশ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য স্কুলবাস পলাশ চন্দ্র দাস মত-দ্বিমত