সংবাদ সম্মেলন বিতর্ক এবং বাফুফের দায়
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৫২
খেলোয়াড়রা ভালো কিছু করলে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন কৃতিত্বের ভাগ পায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো ঘটনা। নারীরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমানে গালি খাচ্ছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন-বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। মনে হচ্ছে, সালাউদ্দিনই এতদিন নারীদের আটকে রেখেছিলেন। সবার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের নারী ফুটবলার কলসিন্দুর বা রাঙামাটি থেকে উঠে এসে সরাসরি নেপালে গিয়ে ট্রফি নিয়ে চলে এসেছে। মাঝখানে আর কিছু নেই। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। বাফুফের নিবিড় তত্ত্বাবধান, পরিচর্যা আর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশের এই মেয়েগুলো আজ অপরাজেয় হতে পেরেছে। কাজী সালাউদ্দিন ভেবেছিলেন, তাদের পরিকল্পনা ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে মেয়েরা সাফ শিরোপা পাবে। কিন্তু অদম্য মেয়েরা দুইবছর আগেই তা অর্জন করেছে। তার মানে কাজী সালাউদ্দিনের পরিকল্পনা ঠিকমতই কাজ করেছে।
একসময় বাংলাদেশে খেলাধুলা মানেই ছিল ফুটবল। অনেক দিন ধরেই সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ক্রিকেট। ফুটবল এখন ক্রীড়াঙ্গনের দুয়োরানি। কোনো মনোযোগ নেই, সাফল্য নেই, দর্শক নেই, তাই অর্থও নেই। তারপরও ফুটবল ফেডারেশন অনেকদিন ধরেই নারী ফুটবলারদের আগলে রেখেছে। বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের প্রায় সবাই উঠে এসেছেন সমাজের অবহেলিত অংশ থেকে। তারা সবাই প্রান্তিকতর পরিবারের সদস্য। সেই মেয়েগুলো মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বাফুফে ভবনে থাকছে। তাদের থাকা-খাওয়া এবং অল্প হলেও বেতন দিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার কাজটাও করছে বাফুফেই। নারী দলের অভিভাবক মাহফুজা আক্তার কিরণ জানিয়েছেন, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যেসব খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছিল তার খরচ ব্যক্তিগতভাবে কাজী সালাহউদ্দিন ও তিনি বহন করেছেন। ২০১২ সালে বাফুফের ট্যালেন্ট হান্ট প্রকল্প থেকেই উঠে এসেছে আজকের মারিয়া মান্ডা, সানজিদা আক্তার কিংবা কৃষ্ণা রাণি সরকাররা। তারচেয়ে বড় কথা ২০০৯ সাল থেকে গোলাম রাব্বানী ছোটনের ওপর আস্থা রেখেছে বাফুফে। তাই নারীদের এই অসামান্য অর্জনের কিছুটা কৃতিত্ব বাফুফে পেতেই পারে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। কাজী সালাউদ্দিন এখন যেন বাংলাদেশের গণশত্রু।
মানুষ কেন সালাউদ্দিনকে কারণে-অকারণে নির্মমভাবে গালাগাল করছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমি নিজের মত করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। আসলে মানুষ অনেকদিন একই পদে একই মানুষকে দেখতে চায় না। সে কারণেই মানুষ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে নাজমুল হাসান পাপনকে। আর ফুটবলের বাধা যেন চারবারের বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। অথচ এই সালাউদ্দিন হলেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে তারকা। ব্রাজিলে যেমন পেলে, আর্জেন্টিনায় যেমন ম্যারাডোনা, বাংলাদেশেও তেমনি কাজী সালাউদ্দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সালাউদ্দিন বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়া আইকনও বটে। তার সময়ে সালাউদ্দিন ছিলেন সিনেমার তারকাদের চেয়েও বড় তারকা। সেই সালাউদ্দিন যখন ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্ব নিলেন, তখন আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আবার বুঝি দিন ফিরবে ফুটবলের। একদম হারিয়ে যাওয়া ফুটবলকে মাঠে ফেরাতে পারলেও সালাউদ্দিন তার কাছে প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। বিশাল প্রত্যাশার বিপরীতে বিপুল হতাশাই একসময়ের নায়ক সালাউদ্দিনকে ভিলেনে পরিণত করেছে। তাই নিজের হাতে গড়া দল যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় যায়, তখনও প্রশংসার বদলে গালিই শুনতে হয় সালাউদ্দিনকে।
তবে এবার তার গালি খাওয়ার ক্ষেত্রটা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। সালাউদ্দিন শুধু বাফুফের সভাপতি নন, তিনি সাফেরও সভাপতি। তাই নেপালে যখন আমাদের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল, তখন তার অনুপস্থিতি অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। সাফ সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনই সাবিনার হাতে ট্রফি তুলে দিতে পারতেন। শুরুতে না যান, কিন্তু মেয়েরা ফাইনসালে ওঠার পর সালাউদ্দিন সেখানে যেতেই পারতেন। মেয়েদের সাফ জয়ে সারাদেশে যখন আনন্দের জোয়ার, তখনও খোঁজ নেই সালাউদ্দিন বা বাফুফের। কয়েকঘণ্টা পর বাফুফে তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি দিয়ে খালাস। সেই বিবৃতিতেও অভিনন্দন জানানো হয়েছিল বাফুফে কর্মকর্তাদের। আর সালাউদ্দিন যেন হারিয়েই গিয়েছিলেন। পরে যখন পাওয়া গেল, তখন তিনি জানালেন, মেয়েদের জয়ের আনন্দে তিনি কারো ফোনই ধরেননি। নেপাল না যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বললেন, টাকা থাকলে তিনি বিমান চালিয়ে চলে যেতেন। নেপাল যেতে টাকা কোনো বিষয় নয়, এটা বোঝার পর সালাউদ্দিন বললেন, তিনবার টিকেট কেটেও যাননি, কারণ তিনি গেলে নাকি মেয়েরা চাপে পড়ে যেতো। যে মেয়েরা ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপকে উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়, সেই মেয়েরা নাকি সালাউদ্দিনকে দেখলে চাপে পড়ে যাবে! এরপর সালাউদ্দিন জানালেন, তিনি বিমানবন্দরেও যাবেন না। তাতে নাকি ফোকাসটা মেয়েদের বদলে তার দিকে চলে আসবে। এমন বিবেচনা যার তাকে প্রশংসা না করে গালি দেয়াটা অন্যায়। তবে বারবার উল্টাপাল্টা কথা বলে, নেপালে না গিয়ে, বিমানবন্দরে না গিয়ে সালাউদ্দিন প্রমাণ করেছেন, তিনি আধুনিক কালের নন্দলাল, দুর্ঘটনার ভয়ে যিনি ঘর থেকেই বের হন না।
তবে বিজয়ীরা ফেরার পর বিমানবন্দর আর বাফুফেতে যা হলো, তা অপেশাদারিত্বের চূড়ান্ত। চেয়ারদখল, ক্যামেরা দখল আর ক্রেডিট চুরির নির্লজ্জ মহড়া। প্রথম কথা ছিল বিজয়ী নারীদের প্রথম সংবাদ সম্মেলনটা হবে বিমানবন্দরেই। কিন্তু সেখানে নির্লজ্জতা আর বিশৃঙ্খলার এমন প্রদর্শনী হলো, সংবাদ সম্মেলনের কথা ভাবাই গেল না। বিমানবন্দরে বাফুফে আর ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ফুলের মালা গলায় দিয়ে এমনভাবে সব ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন, সবাই যাদের দেখার জন্য পাগলপারা, সেই বিজয়ী নারীদের ক্যামেরা খুঁজেই পেলো না।
অপরাজিতাদের সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছে রাস্তায়। বিমানবন্দর থেকে বাফুফে- পথে পথে লাখো ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তারা। ছাদ খোলা বাসেও অপ্রাসঙ্গিক লোকের ভিড় ছিল বটে, তবে সামনে ছিলেন বিজয়ীরাই। তবে এই পথেই কপাল কেটেছে ঋতু রানি চাকমার। ছাদ খোলা বাস একটি ফুটওভার ব্রিজ পার হওয়ার সময় ঝুলে থাকা বিলবোর্ডে লেগে তার কপাল কেটে যায়, যেখানে তিনটি সেলাই লেগেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাফুফেতে এসেছেন তিনি। তবে বাফুফেতে সংবাদ সম্মেলনের নামে যা হলো, তা ছাড়িয়ে গেছে নির্লজ্জতার সকল সীমা। ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, সংবাদ সম্মেলনের প্রথম সারিতে যারা আছেন, তাদের কেউই সাফ জয়ের সাথে সম্পৃক্ত নন। সাফজয়ী দলের অধিনায়ক আর কোচ পেছনে কোনায় দাড়িয়ে আছেন অসহায়ের মত। দলের বাকি সদস্যদের কোনো পাত্তাই নেই।
বিমানবন্দর আর বাফুফে কার্যালয়ের ছবিগুলো দেখে আমি ভুলতে বসেছিলাম, সেদিন আসলে গোটা জাতিকে আবেগে ভাসিয়ে নেয়ার উপলক্ষ্যটা কী ছিল?
একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে সাফজয়ী দলের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সাবিনার কাছ থেকে নেতৃত্বগুণ, কৃষ্ণার কাছে ড্রিবলিঙের রহস্য, সানজিদার কাছে ফেসবুক স্ট্যাটাসের পেছনের গল্প, রূপনার কাছে গোল আটকানোর টেকনিক শুনতে চাইবো। এই জয়ী নারীদের সারিতে একজন পুরুষই আজ প্রাসঙ্গিক- গোলাম রাব্বানী ছোটন। তার কাছে আমরা জানবো, ২০০৯ সাল থেকে শত টিকা টিপ্পনী সয়ে তিনি কীভাবে মেয়েগুলোকে এক পরিবারে বদলে দিলেন, সেই গল্প। কিন্তু পুরুষ কোটায়ও গোলাম রাব্বানী ছোটনের জায়গা হয়নি সংবাদ সম্মেলনে। ভাইরাল হওয়া ছবিটিকে অনেকে অর্ধসত্য বলছেন। আমিও জানি সেটা অর্ধসত্যই। এবার পুরো সত্যটা শুনুন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনের পাশেই ছিল অধিনায়ক সাবিনার আসন। আর কোচ বসতে পেরেছিলেন একদম বাম কোনায়। অধিনায়ক সাবিনার বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল কোচের কাছে। সাবিনা তাই আসনটি কোচের জন্য ছেড়ে দিয়ে সরে যান। কোচের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। এবার আসন ছাড়তে হয় কোচকে। ব্যস সাফজয়ী নারী দলের সংবাদ সম্মেলনের বাকিটা হলো তাদের কাউকে ছাড়াই। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী রাতারাতি বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের ছাদ কেটে ছাদ খোলা বানিয়ে দিয়েছেন। বিমানবন্দরে মেয়েদের স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের সাথে খোলা বাসে চড়ে বাফুফে পর্যন্ত এসেছেন। এমন দরদী একজন প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতেই পারেন। কিন্ত তার জন্য অধিনায়ক বা কোচকে তাদের আসন ছেড়ে দিতে হবে কেন। এ তো রীতিমত বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের আসন দখল করার মত।
সবচেয়ে ভালো হতো যদি শুধু সাফজয়ী দলের সদস্যরাই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতেন। বাকি আর কেউ সেখানে প্রাসঙ্গিক নন। সেটা না হয় নাই হলো। কিন্তু সাধারণ ভদ্রতা কী বলে? সংবাদ সম্মেলনে যদি একটি চেয়ার থাকে সেটি হবে অধিনায়কের। দ্বিতীয় চেয়ারটি হবে কোচের। চেয়ার তিনটি হলে তৃতীয়টি পারবেন ম্যানেজার। জায়গা থাকলে আরো দুটি চেয়ার থাকতে পারতো- প্রতিমন্ত্রী আর বাফুফে সভাপতির জন্য। এর বেশি আর কারো অন্তত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা উচিত ছিল না। কিন্তু ঘটলো উল্টো ঘটনা। সামনের সারির দশটি চেয়ারেও জায়গা হয়নি অধিনায়ক আর কোচের। উৎখাত হয়ে তারা তবু এক কোনায় দাড়াতে পেরেছিলেন। সাফ জিতে আসা বাকি খেলোয়াড়দের দেখাই পায়নি সাংবাদিকরা। সংবাদ সম্মেলনে পেছনে ভিড় করে দাড়িয়েছিল লাল্লু-পাঞ্জুরা, যাদের সাথে সংবাদ সম্মেলন বা সাফ কোনোটারই কোনো সম্পর্ক ছিল না। সামনের সারিতে বসে থাকা বাফুফের সহ-সভাপতিবৃন্দ বা ক্রীড়া সচিবের সংবাদ সম্মেলনে প্রাসঙ্গিকতা কী ছিল? স্রেফ ক্যামেরার সামনে থেকে টিভিতে চেহারা দেখানো ছাড়া তো সংবাদ সম্মেলনে তাদের কোনোই কাজ ছিলই না। এত সম্মানিত মানুষ, এইটুকু বোঝার আক্কেল নেই যে সাধারন মানুষ শুধু বিজয়ী নারীদের দেখতে চায়, আপনাদের চেহারা মোবারক নয়।
তিনি গেলে নারী খেলোয়াড়রা ফোকাস কম পাবে, এই যুক্তিতে কাজী সালাউদ্দিন বিমানবন্দরেই গেলেন না। কিন্তু সেই বিজয়ী মেয়েরা বিমানবন্দরে বা বাফুফেতে কতটুকু ফোকাস পেয়েছেন, এই প্রশ্নের জবাব কী দেবেন কাজী সালাউদ্দিন? ছাদ খোলা বাসে বিজয়ীরাই ছিল রানি। কিন্তু বিমানবন্দর আর বাফুফেতে তারাই ছিলেন অবহেলিত। নারীরা ফোকাস বা সম্মান তো পেলই না, উল্টো বিলবোর্ডের আঘাতে অল্পের জন্য বাঁচলো ঋতু রানির চোখ; পরে দেখা গেল কয়েকজনের লাগেজ কেটে টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনাটি বিমানবন্দরে না বাফুফেতে ঘটেছে, তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি চলছে। তবে বিজয়ী নারীদের লাগেজ অক্ষত রাখতে না পারাটা অবশ্যই বাফুফের অদক্ষতা, অপেশাদারিত্বের।
অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা মেয়েগুলো আমাদের মাথা উঁচু করলো। আর মন্ত্রী-সচিব, স্যুটেড বুটেড শহুরে কর্তারা সেই মাথা লজ্জায় হেঁট করে দিলেন।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এজেডএস