মাশা আমিনির মৃত্যু ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিণতি
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:৫০
পৃথিবী সৃষ্টিই হয়েছে নারী ও পুরুষের সমান অবস্থানকে নিশ্চিত করে। ক্রমশ সমাজ বানালো মানুষ। সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিয়মকানুন প্রয়োজন। আইন-কানুন সৃষ্টি হল। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যখন ছিল না তখন মানুষ পরিচালিত হতো কেমন করে? আসলে রাষ্ট্রব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মানুষকে কেন্দ্র করেই। রাষ্ট্র মানেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আর তাই রাষ্ট্রের কোন কিছুই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে পরিচালিত হতে পারে না। এই রাষ্ট্রব্যবস্থারও কিন্তু রূপান্তর ঘটেছে। অনেকপ্রকার ধরণ ও পরিচালন ব্যবস্থার অবতারণা ঘটেছে।
রাষ্ট্র মূলত একটি কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের জীবনাচরণ বা জীবনযাপন প্রণালীকেন্দ্রিক। আর তাই এখানে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে চর্চা ও বিশ্বাসের পার্থক্য ঘটে যা রাষ্ট্রব্যবস্থায় সম্ভব হয় না। আর এজন্যই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হতে হয়ে নির্মোহ অর্থাৎ রাষ্ট্র যা করবে বা বলবে সেটা সবার জন্য সমান হবে। প্রতিটা নাগরিকের জন্য বিবেচনা এখানে একই হতে হয়। একটা রাষ্ট্রের আইন কখনও নারীর জন্য একরকম বা পুরুষের জন্য আরেকরকম হতে পারে না বা হওয়া উচিত না। রাষ্ট্র কাজ করবে সামগ্রিকতাকে মাথায় রেখে। ক্ষুদ্রতায় আটকে থাকা রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়।
ইরানের ঘটনা আমাদের এই মানবসভ্যতাকে আবারও সেই একই বার্তা দিচ্ছে। ইরান একটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র। সেখানকার রাষ্ট্রীয় নীতি পরিচালিত হয় ধর্মীয় বিধিমোতাবেক। এই ইরান কিন্তু একটা সময়ে ছিল অনেক বেশী আধুনিক। সেখানে নারীরা মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক হিসাবেই বিবেচিত হতো। ইতিহাস বলে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরেই সকল আইনকানুন পরিবর্তন করা হয়। নারীদের জন্যে হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে নারীদের এই হিজাববিরোধী আন্দোলন নতুন কিছু নয়। যেদিন থেকে নারীদের চলাফেরা বা পোশাক নিয়ে আইন জারি করা হয় সেদিন থেকেই এমন আন্দোলন শুরু। তাদের শরীয়া আইনে বলা হয়েছে নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক এবং সেই হিজাব পরারও বিশেষ ধরণের কথা বলা আছে। সামান্য চুলও দেখা যেতে পারবে না আর পরতে হবে ঢিলাঢালা পোশাক।
আর যে নৈতিক পুলিশি বাহিনীর অত্যাচারে মাশা আমিনির মৃত্যু সেই পুলিশ বাহিনীও কিন্তু নতুন সৃষ্টি। ২০০৫ সালে কেবল নারীর পোশাক নিয়ন্ত্রন করার লক্ষ্যেই এই মোরাল পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। কতটা হিংস্র হতে পারে একটি রাষ্ট্রের ব্যবস্থা! নারীরা কী পরবে আর পরবে না সেই নির্দেশনা দিয়েই ক্ষ্যান্ত নয় তারা, সেই পোশাকের উপর নজরদারি করার জন্যও রাষ্ট্রীয় পয়সায় বিশেষায়িত বাহিনী গড়ে তুলেছে তাও পুরুষের দ্বারা। অতি চিপলে লেবুও তিতা হয়ে যায়। ইরানেও সেই অবস্থাই হয়েছে। এর মধ্যেই এই আন্দোলন গোটা ইরান ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। নারীদের পাশাপাশি যোগ দিয়েছে ইরানের বিবেকবান পুরুষেরাও। আন্দোলন করতে গিয়ে মৃতদের বেশীরভাগই পুরুষ। অর্থাৎ, নারীর ওপর এই অমানবিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সেই দেশের সবাই। তাহলে রাষ্ট্রের এখানে করণীয় কী? একটি দেশের বেশীরভাগ নাগরিক যে নিয়মকে গ্রহণ করছে না, যে ব্যবস্থাকে বর্জন করতে চাইছে রাষ্ট্র কি পারে সেই আইনকে বহাল রাখতে?
এখন আমরা সবাই ‘এক বিশ্ব, এক নীতি’র কথা বলি। বিশ্বনেতারাও কিন্তু সেই পথেই হাঁটছেন। এখন ‘আমার দেশের আইন মানে আমার দেশেরই বিষয়’ সেই ধারণা অচল হয়ে যাচ্ছে। ‘গণতান্ত্রিক একটি বিশ্ব’ গড়ে তোলার লড়াই করছে সবাই। সেই গণতান্ত্রিক বিশ্বের লড়াইয়ে গোটা বিশ্বের নারী সমাজ একটি বিশাল ভূমিকা রাখে। সেই আন্দোলনে বাংলাদেশ নারী, ইরান বা আমেরিকার নারী বলে আলাদা কিছু নেই। সবাই সবার জন্য এবং সবাই সবার পাশে আছে।
এই যে ইরানে হিজাব বিরোধী আন্দোলন চলছে এটিকে কেবল হিজাববিরোধী বলে বিশ্লেষণ করলে হবে না। এই আন্দোলন আমি মনে করি মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন। নারীরা মানুষ হিসাবে পুরুষের পাশাপাশি নিজের সকল অধিকারের সমান দাবিদার। ইরানের এই বার্তা আমাদের দেশের জন্যও প্রযোজ্য। একটি গোষ্ঠী বিগত কিছু বছর ধরে খুব সুক্ষ্ণভাবে আমাদের দেশেও নারীর পোশাক নিয়ে এক ধরণের মোরাল পুলিশিং এর কাজ করে যাচ্ছে। তারা রাস্তায়, পরিবহণে, ঘরে বাইরে সবজায়গায় নারীরা কী পরবে, কী করবে, কীভাবে চলবে তার সবকিছু নিয়েই আপত্তি তুলে আসছে। হেনস্তা করছে। আক্রমণ করে চলেছে। যদিও আমাদের রাষ্ট্র এখনও এসবকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। আমাদের ভরসার জায়গা একটাই যে আমাদের রাষ্ট্র ধর্মের বিশ্বাস ও নাগরিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আমাদের রাষ্ট্র বা সরকার এখনও ধর্মীয় বিধির উপর নির্ভর করে কোন আইন বা বিধি তৈরী করেনি। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা যারা গড়ে তুলতে চায় তাদেরকে খুব একটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু অপরদিকে এদেশে সুযোগ পেলেই নারীদেরকে বেঁধে ফেলা বা আবদ্ধ করার চক্রান্ত থেমে নেই। নারীদের মানসিকভাবে হেনস্তার কাজটি চলছে নিরবে। নারীরা যাতে ভয় পায়, বাইরে কম আসে এমন কর্মকাণ্ডও চলছে দেদার।
বাস্তবতা হচ্ছে কোন রাষ্ট্রই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তার নাগরিকদের চাহিদাকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মানবাধিকারবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ড একদিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেই। বৈশ্বিক যুগে কোন রাষ্ট্র চাইলেই আদিম যুগে ফিরতে পারবে না। সৌদি আরবের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটি ধীরে ধীরে নিজেদের সৃষ্ট নিয়মকে পাল্টাচ্ছে। তাদের নারীদেরকে খাঁচা থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা খুলে দিচ্ছে। বলা ভালো, দিতে বাধ্য তারা। ঐ যে রাষ্ট্র মানেই রাজনীতি। আর আধুনিক বিশ্বের রাজনীতি হচ্ছে, ‘এক বিশ্ব, এক নীতি’। যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত মাশা আমিনির মৃত্যু ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিণতি লীনা পারভীন