করতোয়ায় অকাল প্রাণ বিসর্জন— কার ভুল কার দায়?
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:১৫
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী এমনিতে খুব একটা খরস্রোতা নয়; গভীরতাও কম। কিন্তু বর্ষা শেষে গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে। গত রোববার ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিনগুন বেশি তীর্থযাত্রী উঠে যায় নৌকায়! এর ফলাফল হলো মাঝ নদীতে ডুবে গেল শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকাটি। মুহূর্তের মধ্যেই ম্লান হলো উৎসবের রং।
নদীর পাড়ে এখন কান্নার রোল। আহাজারি। স্বজনহারা মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠেছে পুরো জনপদ। একসঙ্গে এত প্রাণহানি, স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ এর আগে হয়ত দেখেনি এলাকার মানুষ। মর্মান্তিক এই ঘটনায় শোকে স্তব্দ সবাই। বাকরুদ্ধ। কে দেবে কাকে সান্তনা। এমনও আছে এক পরিবারে স্বজনহারা মানুষের সংখ্যা একাধিক।
সামনে শারদীয় দুর্গোৎসব, চারদিকে খুশির ধুম। কদিন ধরেই বাবার কাছে বিষ্ণুর নতুন জামা কিনে দেয়ার আবদার। বাবা ছেলেকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, মহালয়া শেষ হোক, তারপর। এ কথা শুনে বিষ্ণুর সে কী আনন্দ! সেই মহালয়ার দিনেই নৌকাডুবিতে অনেকের সঙ্গে প্রাণ গেল ছোট্ট এই শিশুটিরও।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় মায়ের সঙ্গে মারা যায় বিষ্ণু। মাকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় মা-ছেলের নিথর দেহ তোলা হয় নদী থেকে! শুধু স্ত্রী-সন্তান নয়, রবিন হারিয়েছেন আরও দুই স্বজনকে। সন্তানের খুশির জন্য ভাটাশ্রমিক সংসারের খরচ বাচিয়ে নতুন কাপড়চোপড় কেনার জন্য টাকা জোগাড় করেছিলেন। সেই টাকা এখন স্ত্রী-সন্তানের সৎকারে খরচ হবে! আনন্দের বিকালটা এত বিষাদ নিয়ে সামনে এসে হাজির হবে হয়ত কোনদিন ভাবেননি তিনি। জানিনা বিষ্ণুর বাবা এই দৃশ্য দেখার পর শোক সামলে কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন।
প্রশ্ন হলো দেশে একের পর এক ঘটে যাওয়া নৌ দুর্ঘটনার জন্য দায় আসলে কার? গোটা দুনিয়ায় সবচেয়ে নিরারপদ হলো নৌ পথ। কিন্তু নদীমাতৃক এই দেশে নৌ পথকে গেল ৫১ বছরেও নিরাপদ করা গেল না, এরচেয়ে কষ্টের, ব্যর্থতা আর কী হতে পারে?
চোখের সামনে অবহেলা, ষড়যন্ত্র, দখল আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নৌ পথ। যতোটুকু আছে সেখানে দুর্ঘটনার ভয়। যে পথে ভয়, সেপথে মানুষ পা বাড়াবেনা এটাই স্বাভাবিক। তাহলে কী নিরাপত্তার অভাবে আস্তে আস্তে দেশের নৌ পথ বন্ধ হয়ে যাবে?
নানা কারণে এ প্রশ্ন আবারো সামনে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দীর্ঘ নদীপথ সচল করার চেষ্টার কথা বলা হচ্ছে গত ১৪ বছর ধরে। ইতোমধ্যে কিছু নৌ পথ যান চলাচলে সচলও হয়েছে। কিন্তু নজরদারি নেই এ পথে; তা আবারো স্পষ্ট হলো গত রোববারের নৌ দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। এমনকি নৌ দুর্ঘটনা রোধে সামান্যতম নিয়ম কানুন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না! এত বড় ব্যর্থতার কী কোন জবাব নেই?
দেশে নৌযানের প্রকৃত সংখ্যা কত, নৌযানের ফিটনেস আছে কি না ও দুর্ঘটনার কারিগরী কারণ, নৌ দুর্ঘটনার পর বিচার হওয়া না হওয়ার বিষয়টিও অনেক পুরনো। তাছাড়া নৌযানটির ফিটনেস, লাইসেন্স আছে কিনা? চালকের লাইসেন্স আছে কিনা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম আছে কিনা, যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌ-যানটি উপযুক্ত কিনা এসব প্রাথমিক বিষয়গুলোও দেখার কেউ নেই। এত অবহেলার মধ্যে যোগাযোগের এত বড় একটি সেক্টর দিনের পর দিন চলতে পারে?
যদি নজর থাকতোই তাহলে করতোয়ার বুকে শ্যালো মেশিনের এই নৌকাটি কিভাবে ধারণ ক্ষমতার তিনগুন যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো? মানছি এটি নিয়মিত কোন নৌ পথ নয়। তাই বলে কী নদীতে কোন নজরদারি থাকবে না? তাহলে নৌ সেক্টরে এক কর্তৃপক্ষ, পৃথক নৌ পুলিশ গঠন করা হলো কেন?
তবে এই দুর্ঘটনার জন্য সরকার যে একা দায়ি তা বলা যাবে না। যারা নৌকায় উঠেছেন তাদের মাথায় একবারও কেন? কাজ করেনি এতোবেশি যাত্রী নিয়ে চলার নৌযান এটি নয়! যিনি চালক তিনি মানা করেছিলেন কিনা খবর আসেনি। অতিরিক্ত যাত্রি নিয়ে চলার সময় এলাকার কেউ বাঁধা দেয়নি? এটা কী আমাদের সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব নয়?
এই ধরণের নৌযানের চালকের লাইসেন্স বা যানের ফিটনেস মোটেই থাকার কথা নয়। অর্থাৎ সবার ভুল আর নজরদারির অভাবের খেসারত হলো এই দুর্ঘটনা, আর এত প্রাণের অকাল বিসর্জন। যা কখনই মেনে নেয়া যায়না। যাবেও না।
সুগন্ধার পাড়ে আহাজারি থামতে না থামতেই শীতলক্ষার তীরে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ শুনেছে দেশ সহ গোটা বিশ্বের মানুষ। সেই নৌ দুর্ঘটনার হ্রেস কাটতে না কাটতেই আবারো করতোয়ার বুকে নেমে এলো মৃত্যুর এক ভয়াবহ বিভীষিকা।
প্রতিটি নৌ দুর্ঘটনার পর নৌ পথের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠলেও সরকার, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী থেকে শুরু করে সব পক্ষকে কম বেশি এর দায় রয়েছে। তবে নিরাপদ নৌ পথের জন্য করনীয় সরকারের হাতেই বেশি।
বিশে^র বিভিন্ন দেশে যেভাবে নৌ পথকে নিরাপদ করা হয়েছে সে ধরণের চিন্তার বাস্তবায়ন যদি কঠোরভাবে করা যেত তাহলে সবাই তা মানতে বাধ্য। তাহলে বিষয়টি একেবারেই পরিস্কার সড়ক পথের মতোই নৌ পথ নিয়ে উদাসিনতা স্পষ্ট। ভালো করতে না দেয়ার পেছনে যদি কোন ষড়যন্ত্র থেকে থাকে তা কাম্য হতে পারে না। এই অবস্থা থেকে থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ২৩০টি সক্রিয় নদী বহমান আছে ও প্রায় ৪৫০টি নদী দখল ও দূষণের কারণে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র কর্তৃক নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা আছে। নির্দেশনা মত কি সব কাজ যথাযথ হচ্ছে?
সারা দেশে কত নৌযানের সংখ্যা ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের সংখ্যা কত এ তথ্যও জানে না নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। অবাক করা বিষয় হলো গেল ৫০ বছরে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ২০ হাজার পথ! নৌ পথ যে অবহেলার শিকার, এই পরিসখ্যান কি যথেষ্ট নয়?
তেমনি দেশে কত নৌযান চলাচল করবে, সরকারি দপ্তরে এর কোনো হিসাব থাকবে না, তা কাম্য নয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নদ-নদীতে সাত লাখের বেশি নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যাত্রীবাহী, বাকিটা পণ্যবাহী। নৌযানের ফিটনেস সনদ, চালকের দক্ষতা, প্রতিটি নৌ যানে নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিতসহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলায় নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে।’ ফলে সামনের দিনগুলোতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি নৌপথ হয়ত আরও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে- এমন ধারণা অমূলক নয়।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে অনুমোদপ্রাপ্ত নৌযানের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় আট হাজার নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। সরকারি হিসাবের নিবন্ধন করা নৌযানের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার অবৈধ থেকে যায়।
নৌযানের নিবন্ধন ও ফিটনেস দেখতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে মাত্র ১৮ জন পরিদর্শক! পাশাপাশি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ২৫ জন পরিবহন পরিদর্শকও ফিটনেসসহ নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়গুলো দেখেন! তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে স্বল্প জনবলের এসব পরিদর্শকদের কাজ আসলে কী? তাদের দায়িত্ব কি শুধু রেজিস্ট্রেশন করা নৌযান দেখা? নাকি গোটা নৌ-সেক্টরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা?
এর বাইরেও নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা-নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তর।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন। নৌ ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নৌ দুর্ঘটনার সময় নৌযানের ভেতরে থাকা জীবন বাঁচানোর সরঞ্জাম ব্যবহার হয়েছে এমন উদাহরণও কম। আসলে নৌ যানের ভেতরে নিরাপত্তা সরঞ্জাম আছে কিনা তা কে দেখবে?
নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানগুলোর নিবন্ধন নেয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করতে হয়। এ সনদ দিতে নৌযানের মাস্টার-ড্রাইভারের সনদ, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়সহ ৫১টি বিষয় দেখেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়াররা। সেদিক দেখভালের শিথিলতা চরমে। তাই দায়িত্বশীলদের দ্রুত সময়ের মধ্যে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সব আলোচনার সার সংক্ষেপ হলো তাহলে কি নৌপথ অরক্ষিত হয়েই থাকবে?। সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই নৌপথকে নিরাপদ করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাব। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার অন্তরালে গজিয়ে থাকা দেয়ালটি চিহ্নিত করতে হবে। সেসঙ্গে সবকিছুতেই স্বচ্ছতা জরুরী। তেমনি দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। আনতে হবে জবাবদিহির আওতায়। সঠিক পদক্ষেপে নিরাপদ নৌপথ গড়ে তোলা সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও সুদৃঢ় হবে। চলমান অবহেলায় দেশের নৌপথ হারিয়ে যাক এটা কারো কাম্য হতে পারে না।
দার্শনিক কুনফুশিয়ান বলেছেন, ‘যদি এক বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে শস্য বোপন করো। যদি দশ বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে বৃক্ষ রোপন করো। যদি একশত বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে সন্তানদের সুশিক্ষিত করো।’ তাই বলছি, সুশিক্ষিত সন্তান ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই আমরা শত বছরের পরিকল্পনায় নৌপথকে নিরাপদ করতে পারি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
করতোয়ায় অকাল প্রাণ বিসর্জন- কার ভুল কার দায়? মত-দ্বিমত রাজন ভট্টাচার্য