Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তবে কি রাজপথেই সংকটের সমাধান?

সজীব ওয়াফি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:৫৬

কয়েকদিন আগে একটা বিভৎস ছবি দেখলাম। ছবিটা মুন্সিগঞ্জে বিএনপির সমাবেশে হামলার শিকার হওয়া একজনের। মনে হচ্ছিলো মধ্যবয়স্ক লোকটার নাক ছিঁড়ে গেছে অথবা নাকের পাশের মাংস উবে গেছে। মুখ এবং চোখ যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটাও নিশ্চিত, সংঘর্ষে নিহতও হয়েছে। নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিএনপির সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বেদম মার খেলো। কারণ কি? কারণ তাদের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যকে ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে যাচ্ছিল। ফুল তো রাস্তায় হামলাকারীদের পায়ের নিচে গেলো আর যারা ফুল হাতে এসেছিল ওরা মার সহ্য করতে না পেরে রাস্তায় শুয়ে পড়েছে; কিন্তু তারপরও হামলাকারীদের পিটুনির বুনো উল্লাস ও উত্তেজনা কমছে না।

বিজ্ঞাপন

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মারা গেল শাওন আহমেদ। মুন্সিগঞ্জে যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেল সেও একজন শাওন। দুঃখজনক যে সহিংসতার রাজনীতিতে এবারের এই শুরুটা হয় ভোলায়। পুলিশের ব্যাপক বাঁধার মুখে মিছিল করতে গেলে সংঘর্ষের মুখে পড়েছিলো দলটি। পরবর্তীতে মোটামুটি ছোটখাটো সব জেলাতেই একেই অবস্থা। এমনকি ঢাকার বনানীর মতো জায়গাতে হামলার শিকার হয়েছেন বয়স্ক সিনিয়র নারী নেত্রী সেলিমা রহমানও। জাতীয় দৈনিকে খবর বেরিয়েছে বিএনপিকে কোন ছাড় নয়, ঢাকার বাইরে ছোট বড় সকল কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি এবং ঢাকার ভিতরে পল্টন-প্রেসক্লাব ব্যাতীত বড় বড় জমায়েত ঠেকানো যার উদ্দেশ্য।

বিজ্ঞাপন

ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক কথা হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিয়ে নির্বাচন কমিশন যে সংলাপের আয়োজন করেছিলো সেখানেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে মতামত দিয়েছিলো। বিএনপি যদিও সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি তারপরও ইভিএম বিষয়ে তারা তুমুল বিরোধিতা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যুক্তি ছিল প্রযুক্তির ব্যবহার করে এবার অভিনব কায়দার কারচুপি হবে। জনসাধারণেরও ইভিএমে তেমন একটা আস্থা পরিলক্ষিত হয়নি। নিজের ভোট অন্য ব্যক্তি কর্তৃক বোতাম টিপে দেওয়া, ইভিএম নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং মেশিন কর্তৃক ভোটার চিহ্নিত করতে না পারার জটিলতাসহ নানান ধাঁচের অভিযোগ তো ছিলই। আবার বিএনপির দাবি তারা দলীয় কোন সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার চাই। সুনির্দিষ্ট এই বিষয়গুলোতে সরকারপক্ষও অনড়। কোন সমাধান যে শীঘ্রই আসবে সেরকমের লক্ষণ রাজনীতিতে অনুপস্থিত।

রাজনৈতিকাঙ্গনে বিএনপি এখন পর্যন্ত একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তারা সংসদের বাইরে থাকায় বিকল্প সরকার হিসেবে জাতীয় পার্টি থাকলেও রাজনীতিতে বিএনপির আধিপত্য এখনো বিদ্যমান। দলটি নব্বইয়ের পরবর্তী দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলো। প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালীন ৯৬ সালে তারা চেষ্টা করেছে পরবর্তী মেয়াদে পূনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার। একতরফা একটা নির্বাচনও করেছিলো, যা টিকেছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ‘জনতার মঞ্চের’ প্রবল আন্দোলনের মুখে ভেসে গেছে পঁয়তাল্লিশ দিনের ঐ সরকার। ঐ সময়ে আওয়ামী লীগ বুঝে গিয়েছিল নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। অর্থাৎ রাজপথে দাবি আদায় করে সাময়িকভাবে সমাধান এসেছিল।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন আমরা সকলেই জানি। সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ৩০০ সংসদীয় আসনের ভেতরে ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামীলীগের প্রার্থীরা ক্ষমতায় গিয়েছেন। নিজেদের ক্ষমতাবলে সংবিধান সংশোধন করে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার এই নির্বাচন। উচ্চ আদালত পর্যন্ত যেখানে মত দিয়েছিল যে আরো দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এই যে নোংরা কাদা আওয়ামীলীগ তার গায়ে মাখলো, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি সেই কালিমা কখনো দূর করতে পারবে কিনা সন্দেহ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে কি হয় তা তো দিনের মতো পরিস্কার হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা ভোট দিতেই ভুলে গেলো। আর সিনিয়র সিটিজেন ভয়ে অথবা যে কোন অলীক কারনে ভোটকেন্দ্র বিমুখ হলো। গেলেও তো লাভ নেই! প্রকাশ্যে ভোট দিতে হবে। নিজের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে না। দিলেও কপালে আছে নোয়াখালীর মতো ধর্ষণ দুর্ঘটনা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে কোন কোন এলাকায় ভোটারের চেয়ে ভোট বেশি পড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নেতিবাচকভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদ বন্টন করা হয়, দেখানো হয় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, আর ভোট হয় মেম্বার পদে।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে কানাগলিতে প্রবেশ করেছে, তা কেবল রক্তারক্তির। প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ বা ঘেরাও করতে আসলে বিরোধীদের চা খাওয়ানো আমন্ত্রণ রাজনীতিতে স্বস্তি দিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো এবার বুঝি একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হলো। কিন্তু কিসে কি শান্তি! মাস না গড়াতেই কতগুলো লাশের সংখ্যা ধরিয়ে দেওয়া হল! সাধারণ কর্মসূচি কিংবা রাষ্ট্রের নানা সমস্যা যেমন— দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে যদি নূন্যতম কর্মসূচি করা না যায়, হামলা-মামলার শিকার হতে হয়, প্রাণ দিতে হয়, একটা বিক্ষোভ মিছিল করা না যায়; তবে গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্র থাকলো কই? মিছিলে যদি বিনা উস্কানিতে পুলিশ এবং সরকার দলীয়রা অন্যায়ভাবে হামলা করে, তারা যদি ঘর থেকেই পণ করে বের হয় বিরোধীদের আজকে শায়েস্তা করবো, তখন তো বিরোধীরা নিজেদের আত্মরক্ষা অথবা নিরাপত্তা দিতে লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হবে স্বাভাবিক। মুন্সিগঞ্জের কর্মসূচিতে দেখা গেল বিএনপি সেই কাজটাই করেছে। পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে তারা বাঁশের লাঠি-রডসহ নানান সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। ঢাকার হাজারীবাগ এবং তেজগাঁও জোনের সমাবেশে লাঠিসোঁটার পরিমাণ আরো বেশি।

সমাবেশে লাঠিসোঁটা নিয়ে নামাটাকে সরকারদলীয়রা ব্যাপক মাত্রায় সমালোচনা করেছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মার খাওয়া ছাত্রদল সদস্যদের কাছে লাঠিসোঁটা দেখা যায়নি। ফুলের তোড়া দেখা গিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের কাছে ছাত্রদলের এই মার খাওয়াটাকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ছাত্রলীগ নেতৃত্ব। এমতাবস্থায় নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেদের সদস্যদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে তারা যদি লাঠিসোঁটা সাথে রাখে তাতে তো ছাত্রলীগের খুশি হওয়ার কথা! জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিছিল সমাবেশে লাঠিসোঁটা দেখে তাদের তো ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই, যতক্ষণে না অন্যায়ভাবে ব্যবহার হয়। যা হোক বিক্ষোভ মিছিলে এই যে বাঁশ অথবা লগি-বৈঠা নিয়ে নামা, এটা কখনোই ভালো লক্ষণ নয়। তারপরও বাধ্য হয়েই নিয়ে আসা। আলোচনার টেবিল যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তারই ইঙ্গিত।

বিএনপি বিগত দশ বছরের তুলনায় একটু গোছালো এটা পরিস্কার। অপরদিকে তাদের শক্তি আগের মতো নেই তা-ও স্পষ্ট। আওয়ামীলীগও তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়-একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপরীতে বিএনপির লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঠে নামার অর্থ ক্ষমতার পালাবদলের ব্যবস্থা তারা আলোচনার টেবিলে দেখছেন না। মির্জা ফখরুলেরাও হুমকি দিচ্ছেন রাজপথেই ফয়সালা। গণতান্ত্রিক সংকটের ফয়সালা রাজপথে বিএনপি আদৌও করতে পারবে অথবা করবে কিনা জানি না। তবে লাঠিসোঁটার এই লড়াইয়ে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা অনুমেয়। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ থেকে মানুষ এবার নিস্তার চায়। ওদের কেবল ক্ষমতার লড়াই। আমরাই চিঁড়েচ্যাপ্টা। নাক ছিঁড়ে যাবে মুন্সিগঞ্জের কারো। প্রাণ যাবে শাওনদের। আহারে মানুষ!

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

তবে কি রাজপথেই সংকটের সমাধান? মত-দ্বিমত সজীব ওয়াফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর