দুর্গা পূজা: লোকশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:০২
দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল- তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। হরপ্পা ও মহেন্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রুনাশ হয়। আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে, শাক্ত সম্প্রদায়। এই মত অনুসারে দেবী হলেন, শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অনান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী সে হিসেবে অথবা দেবী মাতা হিসেবে পূজা হতে পারে।
বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহিরপুর এলাকার রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর বাড়িতে। ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব এখান থেকেই শুরু হয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। তবে বাঙালি সনাতনি সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব।
দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণবিধি কখনো অলৌকিক অবয়বকে আশ্রয় করেছে। এতে কখনো দেবতার কখনো প্রতীকের, কখনো মানুষের মূর্তি নির্মিত হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসনে দেবমূর্তি কল্পনাই শ্রেয় বিবেচিত হওয়ায় দেবমূর্তিই প্রাধান্য পেয়েছে। লৌকিক সৌন্দর্য শিল্পীকে মূর্তি তৈরীতে শিল্পশাস্ত্রের নির্দেশ মেনে চলতে হয়েছে। প্রাচীন ভারতে নানা উপদানে প্রতিমা তৈরী হতো। উপাদানগুলি ছিল ধাতু, প্রস্তর মৃত্তিকা, গজদন্ত, তৃণ, কাঠ ও বস্ত্র। হিন্দুশাস্ত্রে পুজিত মূর্তি প্রস্তর বা ধাতু, দারু ও মৃত্তিকায় নির্মাণবিধির একটি আর্থসামাজিক কারণ আছে। নিত্য আরাধ্য সে মূর্তি স্থায়ী উপাদান যথা পাথরে বা ধাতুতে নির্মিত হয় সে মূর্তি নিত্যপূজা পেলেও বৎসরে একবার সেই দেবতার বিশেষ পূজা হয়। যে মুর্তি বছরে একবার পূজিত হয় সেই মুর্তি নির্মিত হয় মৃত্তিকায়। যদি সব মূর্তি প্রস্তরে বা ধাতুতে নির্মিত হতো তাহলে মৃত্তিকরের সারা বছরের আয় রোজগার সম্ভব হত না। দারু ও মৃন্ময় মূর্তির বিধান আছে বলেই মৃত্তিকরের সারা বছরের জীবিকা নিশ্চিত থাকে। প্রতিমা শিল্পীরা আয় রোজগারে ধুমধামের সহিত দুর্গা প্রতিমা তৈরীতে ব্যাস্ত থাকে। শিল্পীরা মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়েছে। কাঠ, বাঁশ, খড়, মাটি দিয়ে তৈরী এই প্রতিমাগুলো। শিল্পীত হাত ও তুলির ছোঁয়ায় গ্রামের অশিক্ষিত পাল সম্প্রদায়ের শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছে দেবীর প্রকৃত রূপ। এদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এই শিল্পকর্ম পূর্ব পুরুষাক্রমে দেখে দেখে শিখে আসছে তারা।
চিত্রকর্মের মত মাটির মূর্তি একটি বিশেষ ধরনের শিল্পসাধন। যেখানে রয়েছে সাধারন মানুষের অনুভুতি ও কল্পনার অনিবার্য প্রতিফলন। শিল্পের প্রয়োজনে যে সমস্ত উপদান আয়ত্বে আসে তা দিয়েই মূর্তি-কর্ম সর্ম্পূর্ণ হতে পারে। তবে একেক উপদানের ব্যবহার পদ্ধতি একেকরকম। আমাদের দেশে সাধারণত কাদামাটি দিয়ে দুর্গামূর্তি তৈরি করা হয়। পাথর বা কাঠের মূর্তি তৈরী করতে গেলে হাতুড়ি, বাটাল সাহায্যে লাগে আবার ধাতব মূর্তি তৈরী করতে হলে তা ছাঁচে ঢালাই করতে হয়। দুর্গা মূর্তি তৈরিতে দু’হাত দিয়েই মাটিকে নানাবিধ চাপের সাহায্যে একটি আকৃতিতে পরিণত করা হয়। সর্বতোভাবে নিখুঁত করার চেষ্টায় শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে প্রতিটি অবয়বকে সম্পূর্ণতা দান করতে সমস্ত মনের আবেগ খোরাক দু’হাতের সাহায্যে নির্মাণ কৌশলে সৌন্দর্য এবং মহিমায় প্রাণবন্ত গঠনে নৈপুণ্যে একটি নতুন রূপের জন্ম দেন। শিল্পীর একান্ত নিজস্বতা খুঁজে পাওয়া যায় মাটির ভিতর। প্রতিমা তৈরী করেন কয়েকটি ধাপে। প্রতিটি ধাপে ধাপে তাদের অভিজ্ঞতা, প্রাপ্ত কৌশল ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হয়। ফ্রেম কাঠের বা বাঁশের হতে পারে। ফ্রেমকে কাঠামো বলে। প্রথমে খড় দিয়ে প্রতিমা মূর্তি ধারণ করেন। তারপর মূর্তিগুলো কাঠের বা বাঁশের কাঠামোতে আটকানো হয়। সাধারণত দু-ধরনের কাঠামোতো পূজা হয়। এক কাঠামোতে সব মূর্তি ও পাঁচ কাঠামোতে পাঁচ মূর্তি। খড়ের মূর্তি ধারন করার পর, কাঠামোতে আটকিয়ে তার ওপর প্রথমে উপযুক্ত মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। তারপর খড়ের ওপর দু’হাত দিয়ে প্রাথমিকভাবে মূর্তির আকার দেওয়া হয়। দক্ষ শিল্পীরা হাতে বা আলাদা আলাদা ছাঁচের সাহায্যে মূর্তির মুখমন্ডল, হাত, পা ও প্রয়োজনীয় অলংকরণ তৈরী করেন।
মূর্তি তৈরী করতে প্রয়োজনীয় সঠিক মাটি নির্বাচন করতে হয়। শিল্পীরা মূলত দুই ধরনের মাটি নির্বাচন করেন- এঁটেল ও দোআঁশ মাটি। মাটিকে আটকিয়ে রাখার জন্য তুষ বা পাট টুকরো টুকরো করে কেটে দেওয়া হয়। মাটি থেকেই হাত, পা তৈরী হয়। এরপর মূর্তিগুলো রোদে শুকানো হয়। শুকানো শেষ হলে আবার উপযুক্ত মাটি তরল করে মূর্তিগুলোর উপর প্রলেপ দেওয়া হয়। সেই শুকানো মূর্তিগুলোর উপর প্রথমে পিউরি অথবা সাদা রং এর প্রলেপ দেওয়া হয়। রং শুকানো শেষ হলে দক্ষ শিল্পীরা দক্ষতার সাথে এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা রংয়ের শেড দিয়ে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন প্রতিমার অলংকরণ, কারুকাজ ও আকর্ষণীয় গড়ন। প্রতিমার অলংকরণ করতে যে রং ব্যবহার করেন তা অতি সাধারণ। বাজার থেকে চক পাউডার, পিউরি ও তেঁতুল বিচি কিনে এনে নিজেরাই রং তৈরী করেন। প্রথমে তেঁতুল বিচি ভেজে উপরের লাল খোসা ফেলে দিয়ে তা পানিতে ভিজিয়ে জ্বাল দিয়ে আঠা বের করা হয়। আঠাতে বিভিন্ন রং এর পাউডার মিশিয়ে রং তৈরী হয়।
সাধারণত প্রতিমা তৈরী হয় দু’মাধ্যমে। বাংলা মাধ্যম ও অরিয়ান্ট্যাল বা প্রাচ্য মাধ্যম। বাংলা মাধ্যম: মাটি, কাপড় ও অন্যান্য উপকরণ সংমিশ্রন করে যে প্রতিমা হয় তার নাম বাংলা মাধ্যম। এই মাধ্যমের প্রচলন গ্রাম অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। মূর্তিগুলোর মুখমন্ডল, হাত, পা ও কিছু কিছু অংশ রংয়ে আবৃত করা হয়। রং শুকানো শেষ হলে দক্ষ শিল্পীরা নিজ হাতে মূর্তিগুলোকে বিভিন্ন রংয়ের ঝলিমিলি কারুকাজের কাপড় পরিয়ে দেন। কারুকাজের চূড়া, কানে দুল, গলায় বিভিন্ন রংয়ের পুঁতির মালা, হাতে বিভিন্ন ধরনের শাঁখা-বালা, পায়ে নূপুর ইত্যাদিও পরানো হয়। তারা পাটকে কালো রং করে চিরুনি দিয়ে পরিষ্কার করে মূর্তির মাথার চুল কেটে ছেঁটে লাগিয়ে দেন। এই সব প্রতিমার অলংকার বাজার থেকে কিনে এনে দক্ষ শিল্পীরা নিজ হাতে পড়িয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় প্রতিমার গড়ন ফুটিয়ে তোলেন। তারা বলেন, এই কাজের আকর্ষণ হচ্ছে রঙ্গীন ঝিলিমিলি কাপড়। কাপড়কে কাট-ছাঁট করে মূর্তির গায়ে পরানো হয়। তবে লক্ষ রাখতে হয় যে কোনো মূর্তির কোন কাপড় প্রয়োজন। যে যত সুন্দরভাবে মূর্তির গায়ে কাপড় পরাতে পারবে তত মূর্তিগুলো সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
অরিয়েন্ট্যাল বা প্রাচ্য মাধ্যম: পূর্বদেশীয় প্রতিমা। উপযুক্ত মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ন, মাটি দিয়েই কারুকাজবেষ্টিত মূর্তির পোশাক, মাটি দিয়েই মূর্তির মাথার চুল, মূর্তির হাতে ব্যবহার্য্য রণাস্ত্র মূর্তির অলংকরণ ও প্রতিমার অন্যান্য কারুকাজ। মাটির কারুকাজ দিয়েই প্রতিমা সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলেন। মাটির কারুকাজের উপর বিভিন্ন রংয়ের সেড দিয়ে বিভিন্ন তুলির সাহায্যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সাথে সুক্ষ্ম কারুকাজ ফুটিয়ে তুলেন। তারা বলেন, এই কাজের মাধ্যমে শিল্পীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বেশি কাজে লাগাতে হয়। মাটিকে সঠিক নির্বাচন না করতে পারলে মূর্তির অলংকরণ ও কারুকাজ ঝরে পড়ে যেতে পারে। শুধু তাই না রং করার সময়ও লক্ষ্য রাখতে হয় যে অলংকরণ ও কারুকাজ ঝরে পড়ে না যায় কারন এই প্রতিমার আকর্ষণ হচ্ছে মাটির অলংকরণ ও কারুকাজ। তাদের প্রাপ্ত কৌশল, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে দুহাতের নৈপুণ্যের সাথে এমন অসাধারন অলংকরণ ও সৃষ্টিকর্ম তৈরী করেন যে মনের মাঝে স্বয়ং প্রতিমা লালন হতে থাকে। অতি সাধারণ তাদের জীবনযাত্রার মাঝে টিকে আছে শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ। তারা বলেন, আমরা শুধু প্রতিমা তৈরী করতে পারি কিন্তু বির্সজন দিতে পারি না।
যে মাতৃপূজা করলাম, সেই মায়ের সর্ব মঙ্গলকারিণী স্নেহ সুন্দরভাবে ও চরিত্রকে নিজের অন্তরে বিশেষভাবে সৃষ্ট, অর্থাৎ দৃঢ়নিবন্ধ করে তোলা চাই। মায়ের সেবায় আমাদের বৃত্তিগুলোকে নিয়োজিত করি, তখনই হয় বিসর্জনের স্বার্থকতা। তাই তারা প্রতিমা বির্সজনের সময় সেই স্থানে ঊপস্থিত থাকেন না।
অলংকরণে যে মোটিফের ব্যবহার দেখা যায় লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি, লতাপাতা, ফুল-হাতি, পশু-পাখি ইত্যাদি। দুর্গা প্রতিমার অলংকরণ ও কারুকাজ বাংলার সামাজিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই কেবল প্রভাব ফেলেনি, সাধারণ মানুষের কাছে এর জনপ্রিয়তা ও প্রতিযোগিতামূলক উৎসব। হয়তো লোকশিল্পের বিচারে প্রতিমার অলংকরণ খুবই ক্ষণস্থায়ী। বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় ক্ষণস্থায়ী দুর্গা প্রতিমার গড়ন, রং, বৈচিত্র অলংকরণও কারুকাজ। প্রতিমা শিল্পীদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কৌশল ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে দুর্গা প্রতিমার গড়ন, রং, বৈচিত্র অলংকরণ ও কারুকাজের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তা আমাদের গর্ব ও অহংকার।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি