বাঙালির সম্প্রীতির চিরন্তন উৎসব
৪ অক্টোবর ২০২২ ২১:২৯
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো এখন আর কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে উদযাপিত হয় প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব। জাতীয় চেতনায় এবং শান্তি প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই স্লোগান সামনে রেখে সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোষ্ঠীর মানুষ সাড়ম্বরে পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব।
শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বাঙালির কাছে এ পূজা চিরায়ত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক অনুপম প্রীতিময় আনন্দ উৎসব। অশুভ ও অপশক্তির পরাজয় এবং শুভশক্তির জয়, সত্য ও সুন্দরের আরাধনায় সর্বজীবের মঙ্গল সাধন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অশুভ ও আসুরিক শক্তি দমনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার, সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, সব মানুষের সমধিকার নিশ্চিত করা, মানুষের মধ্যকার সব ধরনের বৈষম্য বা ভেদাভেদ ও অন্যায়, অবিচার দূর করা এবং অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, হানাহানিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সমাজ গঠন করার শিক্ষা লাভই দুর্গোৎসবের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
শারদীয় দুর্গোৎসব সমাজকে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করে মানুষের মধ্যে ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা করে। ঐক্যবদ্ধ করে সমগ্র বাঙালিকে। এক মায়াবী বন্ধনে জড়িয়ে রাখে বাঙালি জাতিকে। উদ্বুদ্ধ করে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে। সবার মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে। দুর্গোৎসবের শুভ্র ও আনন্দ জাগানিয়া পরশ শুধু বাঙালি হিন্দু ধর্মানুসারীদেরই নয়, এর চিরায়ত ঐকতান স্পর্শ করে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কে।
সব ধর্মের মূল বাণী হচ্ছে সৃষ্টির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধন নয়, জীবের কল্যাণ সাধনই ধর্মের মূল লক্ষ্য। এই চেতনাকে মনে-প্রাণে ধারণ করেই সব মানুষের সুখ-শান্তি কামনায় এবং সর্বজীবের মঙ্গলার্থে আবহমানকাল ধরে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপাচার ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে পালন করে শারদীয় দুর্গোৎসব, আরাধনা করে দেবী দুর্গার। সব হীনতা, সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই চেতনাকে ধারণ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন করে এবং আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করে। সব বাঙালি মিলিত হয় অভিন্ন মোহনায়, অভিন্ন চেতনায়। পূজার ধর্মীয় অংশটুকু হিন্দুদের; কিন্তু মেলা, উৎসব ও আপ্যায়নে অংশগ্রহণ এবং আনন্দ উপভোগ করেন সবাই। সবার অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে শারদীয় দুর্গাপূজা পরিণত হয় সর্বজনীন উৎসবে, পরিণত হয় সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায়, পরিণত হয় অন্যতম জাতীয় উৎসবে। ঐক্য ও সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে এ উৎসব পরিণত হয় সম্প্রীতিময় আনন্দযজ্ঞে। পূজা থেকে উৎসবে রূপান্তরের এই যে প্রক্রিয়া, এটি বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক সত্তার চিরন্তন বহিঃপ্রকাশ।
অতীত থেকেই দুর্গাপূজা উৎসবাকারে পালিত হয়ে আসছে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে। সবার মঙ্গল ও হিতকামনায়, এমন বৃহৎ আয়োজন খুবই গুরুত্ব বহন করে। পূজার সময় মন্দিরে মন্দিরে ভক্তিমূলক গান, চণ্ডীপাঠ, অর্চনা, আরতি, ভক্তদের শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং সেই সঙ্গে কোলাকুলি, প্রণাম, আশীর্বাদ, মেলা ইত্যাদি দুর্গোৎসবকে ধর্মীয় আবেশে আনন্দঘন করে তোলে। দুর্গোৎসব মানুষে মানুষে মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রীতিময় ও কল্যাণময় সম্পর্ক। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি দুর্গাপূজা সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্গাপূজা সর্বজনীন উৎসব এটা শুধু কথার কথা নয়—পূজাবিধিতেও তা লক্ষ করা যায়। দেবী দুর্গা মৃণ্ময়ী প্রতিমায় সপরিবারে পূজ্যপাদ। দুর্গার সঙ্গে সিদ্ধিদাতা গণেশ, মহাবীর দেবসেনাপতি কার্তিক, ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী ও বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজিত হন। দেবাদিদেব মহাদেবের স্থান থাকে সবার ওপরে। দুর্গা দেবীর সঙ্গে তার বাহন সিংহ, গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা, সরস্বতীর বাহন হংস, এমনকি মহিষাসুরও পূজিত হন। সবাই একত্রে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে। পূজার পর শুভ বিজয়া। বিজয়ায় অবাধ মিলন। নির্বিশেষে সব মানুষ একত্রে বিজয়ার উৎসব পালন করে। সব বাধা ও মনের সংকীর্ণতা দূর করে অনৈক্য-বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক মনোভাব দূরে ঠেলে মানুষে মানুষে সমাবেশ ঘটে পূজার উৎসবস্থলে। প্রকাশিত হয় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
সম্প্রীতিবিধ্বংসী কোনো প্রচেষ্টা দুর্গাপূজার সর্বজনীনতাকে বিনষ্ট করতে পারবে না। বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে গ্রথিত ঐকতানের কাছে তা পরাভূত হবেই। আপামর জনতা দুর্গোৎসবে শামিল হয়ে উৎসবের আমেজে যে ঐক্য চেতনায় বাধা পড়েছে তা ছিন্ন করার ক্ষমতা কারোর নেই। কোনো ঠুনকো আঘাতে এ বন্ধন কোনো দিন ছিন্ন হবে না।
বাঙালির জীবনে শারদীয় দুর্গোৎসব এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিরূপ। বাঙালি যে অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তা প্রতিবছরই প্রমাণিত হয় দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই দুর্গোৎসব হচ্ছে সম্প্রীতির আর বাঙালির আনন্দ-উচ্ছ্বাস উদযাপনের উৎসব—এক মহামিলনধর্মী সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক উৎসব।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সংস্কৃত বিভাগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই