Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তরুণ সংবাদকর্মীর চোখে তোয়াব খান

এমদাদুল হক তুহিন
৭ অক্টোবর ২০২২ ১৬:১৮

একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য ও প্রবীণ সাংবাদিক সদ্য প্রয়াত তোয়াব খানকে (তোয়াব ভাইকে) নিয়ে লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের। উনার মৃত্যুর পর এই ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠে। কিন্তু এমন প্রবীণ ও দেশবরেণ্য একজন সাংবাদিককে নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস করতে পারিনি।

আমার সাংবাদিকতা পেশার প্রথম সম্পাদক তোয়াব ভাই। জনকণ্ঠে তিন বছরেরও কম সময় কাজ করেছি। তিন বছরে ১৫৬ সপ্তাহ। সে হিসাবে ১৫৬টি রিপোর্টিং মিটিংয়ে উনার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল। যেহেতু জনকণ্ঠে তিন বছরের কিছু কম সময় কাজ করেছি ও শনিবারের বেশকিছু রিপোর্টিং মিটিং মিস করেছি, ধরে নিই অন্তত ১২০টি রিপোর্টিং মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম। সে হিসাবে ১২০ দিন তোয়াব ভাইকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এর বাইরে কখনোসখনো লিফটে দেখা, কিংবা বছরে একদিন তোয়াব ভাইয়ের টেবিলে ডাক পড়া। এই অল্প সময়ে রিপোর্টিং মিটিংয়ে যে তোয়াব ভাইকে দেখেছি আমরা সেই দেখার মতো মানুষ সংবাদপত্র জগতে এখন কেউ আছেন বলে আমার মনে হয় না। রিপোর্টিং মিটিংয়ে যখন আইডিয়া দিতাম, তোয়াব ভাই কোনো আইডিয়াকেই ছোট করে দেখতেন না। শেষদিকে এসে চিফ রিপোর্টার ওবায়দুল কবির ভাইয়ের মাধ্যমে আমাকে বিশেষের আইডিয়া দিতেন। শেষদিকে আমার লেখা স্পেশালের প্রায় অধিকাংশই লিড নিউজ হতো। জনকণ্ঠ ছেড়ে আসার কথা জানালে উনি হেসেছিলেন, কিন্তু বাধা দেন নি। তবে ওবায়েদ ভাই বলছিলেন, ‘নামটা হারিয়ে যাবে।’ আজও আমার সেই কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তোয়াব ভাই, ওবায়েদ ভাই ও কাওসার ভাইদের কাছ থেকে আরও শেখার কিছু ছিল। কিন্তু জনকণ্ঠের তখনকার অনিয়মিত বেতনের কারণে এসব হয়ে উঠেনি।

আমার মতে তোয়াব ভাই একজন দার্শনিক। সংবাদপত্রে সকল সাংবাদিকের গুরু। যাকে দেখলেই মন পবিত্র নয়, শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর সব বিনয় যেন তার কাছে মাথা নোয়ায়। একজন তরুণ সংবাদকর্মী হিসেবে কোনদিন কোনো বিষয়ে তার কাছে ধমক খেতে হয়নি। পিআইবি মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর ক্রেস্টসহ ওবায়েদ ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন তোয়াব ভাইয়ের টেবিলের সামনে, তোয়াব ভাই কি বলেছিলেন- ঠিক মনে নেই আজ। হয়তো বলেননি কিছুই। তবে খুশি হয়েছিলেন সেটি বুঝতে পেরেছিলাম।

তোয়াব ভাইয়ের মৃত্যুর পর উনাকে নিয়ে লেখা প্রায় প্রতিটি সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও মতামতধর্মী লেখাই পড়েছি। পড়ার চেষ্টা করেছি। তবে আমার মনে হয় উনাকে নিয়ে আরও বেশি লেখার প্রয়োজন ছিল। আরও বেশি চর্চা হওয়া প্রয়োজন ছিল। আমার মতো যৎসামান্য সংবাদকর্মীর কাছে তিনি আশির্বাদ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

অনেকেই বলেন তোয়াব ভাই সবসময় ক্ষমতার ক্রিম খেয়ে বেঁচেছিলেন। তবে তোয়াব ভাইকেও সব আমলেই অনেক কিছু সইতে হয়েছে। প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ তার শেষকাল। তার অধীনে জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়োগ পেয়েছিলেন, এমন অনেকেই বিভিন্ন সময়ে তার বিরোধিতা করেছেন। তোয়াব ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমাদের সাংবাদিক সমাজের একাংশ কোনো শোক প্রকাশ করেনি। অথচ এটি অবধারিত ছিল।

এ বিষয়ের কিয়দংশ নিয়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান ‘তোয়াব খান: যেখানে ব্যতিক্রম ও অসামান্য’ শীর্ষক কলামে লিখেছেন, ‘পুরো পাকিস্তান আমল ও গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে পেশাদার সাংবাদিকদের যে কতটা ঝুঁকি ও বৈরিতার মধ্যে কাজ করতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তোয়াব খান। সাংবাদিকতা ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। কিন্তু সাংবাদিকতায় স্থিত থাকতে পারেননি। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর সাংবাদিকতা থেকে নির্বাসিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি —দুই আমলেই সরকারি পত্রিকা থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।’

প্রথমেই বলেছিলাম তোয়াব ভাইকে নিয়ে আমার মতো তরুণ সংবাদকর্মীর লিখতে যাওয়া মানে ধৃষ্টতা। তাই উনাকে নিয়ে না লিখে আমার কিছু স্মৃতিকথা কেবল তুলে ধরলাম। সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছি, তোয়াব ভাইকে নিয়ে যারা লিখেছেন তাদের লেখার কিছু অংশ, যা তোয়াব খান সম্পর্কে আগ্রহী সাংবাদকর্মীদের কাজে লাগতে পারে।

জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার মোরসালিন মিজান ‘মৃত্যুর হোক লয়’ শীর্ষক শিরোনামের লেখায় লিখেছেন, “তোয়াব খান চিন্তায় চলায়-বলায় ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক ও স্মার্ট। ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, উন্নত চেতনা, সুরুচি তাকে অন্য অনেকের থেকে আলাদা করেছিল। এত গুণে সমৃদ্ধ হয়েও তিনি ছিলেন নম্র ও বিনয়ী। বেশি কথা পছন্দ করতেন না। স্বল্পভাষী ছিলেন। শুদ্ধচারী ছিলেন। নিভৃতে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশার প্রতি এত ভালবাসা, এত নিবেদন আজকের দিনে শুধু বিরলই নয়, বিস্ময় জাগানিয়া। কবিগুরু যেমনটি লিখেছিলেন, ‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে’, তোয়াব খানের চরণের কাছে সত্যি সব মোহর পড়ে ছিল।”

“বর্ষীয়ান বয়োজ্যেষ্ঠ বিদগ্ধ তোয়াব খান শুধু একটি বা দু’টি পত্রিকার নন, বাংলাদেশের গোটা সংবাদপত্র জগতের জ্যোর্তিময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সম্পাদকদের সম্পাদক হিসেবে জ্ঞান করা হতো তাকে। যুগস্রষ্টা হিসেবে আজীবন শ্রদ্ধা-ভালবাসা পেয়েছেন। তার বোধের গভীরে ছিল উদারনৈতিক চিন্তা ও প্রগতিবাদী দর্শন। সারাজীবন বাঙালিত্বের অহর্নিশ চর্চা করেছেন। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িকতার আপোসহীন চেতনা শত অন্ধকারের মাঝেও মশালের মতো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তার সম্পাদিত সংবাদপত্রে এসবেরই বিপুল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।”

দৈনিক জনকণ্ঠের বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক ওবায়দুল কবির ‘একটি সংবাদেই সবকিছু স্মৃতি’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন, ‘একজন সাংবাদিক কতটা পেশাদার হতে পারেন তোয়াব ভাই ছিলেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত। তাকে কাছ থেকে দেখলে আর কাউকেই দেখারই প্রয়োজন নেই। শুধু পেশা নয়, তার শখ, আহ্লাদ, ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা, গবেষণা সবই ছিল সাংবাদিকতা ঘিরে। সাংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার বাইরে তার আর কোন জগত ছিল না। সামাজিক জীবন দূরের কথা পারিবারিক জীবনও ছিল সাংবাদিকতার কাছে তুচ্ছ। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম পত্রিকার পাতায় চোখ রাখা থেকে শুরু হতো তার দিন। রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, ফিচারসহ সাংবাদিকতার নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাটত সারা দিন। দেশ থেকে প্রকাশিত অখ্যাত পত্রিকাসহ সকল সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলাতেন মনোযোগ দিয়ে। নিয়মিত পড়তেন এদেশে পাওয়া যায় এমন সকল বিদেশী পত্রিকা। এই পাঠাভ্যাস থেকে ধারণা নিয়ে কাজে লাগাতেন পত্রিকায় পাতায়। রাতে ঘুমাতেন হয়তো বিবিসি, সিএনএন অথবা কোন সংবাদ চ্যানেলের পর্দায় চোখ রেখে। প্রায় নব্বই বছরের একজন মানুষের জীবনধারা কিভাবে এমন হতে পারে এটি ছিল এক বিস্ময়।’

এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘এক জীবনে অনেক জীবন’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন, ‘একবার অনেক আয়োজন করে তোয়াব ভাইকে এটিএন নিউজের স্টুডিওতে আনতে পেরেছিলাম। ওই যে বারবার বলছি, তোয়াব খান ছিলেন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক। কাছ থেকে না দেখলে বিষয়টা বোঝানো মুশকিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি অল্প কিছুদিন তার অধীনে কাজ করার। তাকে দেখে বুঝেছি, শিখেছি; সাংবাদিকতার প্যাশন কী জিনিস। আরেক লেখায় লিখেছি, তোয়াব খানের সংসার ছিল, সন্তান ছিল; কিন্তু আসলে তিনি জীবনভর সংসার করেছেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। স্বাধীনতার পর দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় বদলে যাওয়া সরকারি পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তিনি। কিন্তু সরকারি পত্রিকাকেও যে জনপ্রিয়তা এবং উৎকর্ষের চূড়ায় তোলা যায় সেই ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তোয়াব খান। সে সময়ও দৈনিক বাংলা ছিল আধুনিক সাংবাদিকতার প্রকাশ।’

প্রভাষ আমিন আরও লিখেছেন, ‘তোয়াব ভাই অফিসে আসতেন সবার আগে, যেতেন সবার শেষে। এ সময় সবার শিফট বদলে যেত। প্রিয়তম কন্যার মৃত্যুর পরদিন তার অফিসে আসা সংবাদপত্রের ইতিহাসে মিথ হয়ে আছে। শিরোনাম, মেকআপ- সবকিছুর খুঁটিনাটি দেখতেন তিনি।’

আজকের পত্রিকার উপসম্পাদক জাহীদ রেজা নূর তার ‘তৎকালীন সাংবাদিকতা ও তোয়াব খান’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন, “ফলে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠল দাঙ্গার আদর্শ ক্ষেত্র। মোনায়েম খান আর সবুর খান ছিলেন এই দাঙ্গা বাধানোর নাটের গুরু। পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল মানুষ রুখে দাঁড়ালেন। ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ এবং অবজারভার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ১৯৬৪ সালের ১৬ জানুয়ারি অভিন্ন সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। এই সম্পাদকীয় খসড়া তৈরি করেছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এরপর তা চার পত্রিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় সংবাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। অবজারভারের বার্তা সম্পাদক ছিলেন সম্ভবত এবিএম মূসা। আজাদের বার্তা সম্পাদক কে ছিলেন, তা স্মরণে আসছে না। তবে ওই দিন চারটি পত্রিকাতেই প্রথম পাতায় এই সম্পাদকীয় ছাপা হলে দাঙ্গার লেলিহান শিখা স্তিমিত হয়েছিল। সেই কালের কথা যত জানানো যাবে, ততই তা হবে ভবিষ্যৎ সাংবাদিকতার জন্য দামি। যারা জানেন, তারা লিখলে ভালো হয়।”

নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শরিফুজ্জামান পিন্টু ‘যাকে ভয় পেতাম, শ্রদ্ধাও করতাম’ শীর্ষক এক লেখায় লিখেছেন, “পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যা প্রকাশের দিন এগিয়ে আসতে থাকে। ৩ সেপ্টেম্বর পত্রিকার প্রকাশক চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে জানাই বিষয়টি। উনি তোয়াব ভাইকে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নন। বললেন, এটা আপনাদের গুরু-শিষ্যের ব্যাপার। অফিসের সবাই শিরোনামের বিষয়টি নিয়ে ফিসফাস করেন। কিন্তু উনাকে কিছু বলার সাহস কারও নেই। ৩ সেপ্টেম্বর সকালে পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যা প্রেসে পাঠানোর আগে সাহস করে ফোন দিই তোয়াব ভাইকে। প্রেসে পাঠানোর আগে দোয়া চাইলাম উনার কাছে। বললাম, অনেক চাপের মধ্যে আছি তোয়াব ভাই। আপনার অনুমতি ছাড়া শিরোনাম বদলাতে পারব না। উনি বললেন, ‘শিরোনাম কী করতে চাও?’ বললাম, সহজ কথায়- ‘আবার এসেছি ফিরে’। উনি পুরোপুরি একমত নন। এর মধ্যে উনার কাশি হচ্ছিল। আমি ফোন রাখলাম। আবার ফোন করি বাচ্চু ভাইকে। বাচ্চু ভাই এবার বললেন, ‘উনি কিছুটা নরম হয়েছেন। শিরোনাম বদল করতে পারি’।”

সবশেষে বলতে চাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও সাংবাদিকরা অনেক সময় তুচ্ছ। জীবনের প্রতিটি পদে পদে সাংবাদিকদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। হারাতে হয় প্রিয় কর্মস্থল, অগ্রজ-অনুজ সহকর্মী। সম্পাদকীয় নীতিতে কখনো কখনো হারিয়ে যায় নিজস্ব সত্ত্বাও। তোয়াব ভাইয়ের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটেনি, তা নয়। তাই তোয়াব ভাইকে সাংবাদিকতা থেকে ২০ বছর নির্বাসিত থাকতে হয়েছে। শেষ বয়সে আবার দৈনিক বাংলাতেই কর্মজীবন শেষ হয়েছে তার। এতোকিছুর মধ্যেও তোয়াব খানের সাংবাদিক পরিচয়টি ছিল কর্মমূখর অথচ স্থিতধী। আর এটিই তরুণ সংবাদকর্মী হিসেবে তোয়াব খানের কাছ থেকে পাওয়া আমার সবচাইতে বড় শিক্ষা।

লেখক: সংবাদকর্মী

সারাবাংলা/এজেডএস

এমদাদুল হক তুহিন তোয়াব খান


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর