Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হারানো মধ্যবিত্ত


২৭ এপ্রিল ২০১৮ ০৮:০৭

।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।।

‘ফিরে যাই, ফিরে ফিরে চাই’ ধরনের একটা আক্ষেপ আছে বাঙালি মধ্যবিত্তের। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত— এই বিভাজন বহুদিনের। কিন্তু আমরা মনে করছি, মাঝের শব্দটি আর নেই। কবে যেন ‘মধ্যবিত্ত’ সমাজটা হারিয়ে গেল নিঃশব্দে! একুশ শতকে এসে ক্রমশ বদলে গেল মধ্যবিত্ত সমাজের প্রচলিত আদর্শ, ধ্যান-ধারণা-জীবনবোধ।

ভোগ বিলাসী এক নাগরিক সমাজ এখন শক্তিশালী বাংলাদেশে। একটা ‘যা চাই, তা পাই’ দর্শন আছে, যার দখলে সমাজের সবকিছু। দীর্ঘসময় ধরে ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটির যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছিল তা আজ খুঁজতে হয়। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বাইরেও যে একটা জীবন আছে— শিক্ষা–শিল্প–সংস্কৃতি বলে যে কিছু আছে সেই ভাবনা ক্রমশ বিলীয়মান আমাদের রাজধানীতে, বড় শহরগুলোতে। এখনো কিছু লোক হয়ত সাংস্কৃতিক তাগিদ থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে যায়, থিয়েটারে, চলচ্চিত্র উৎসবে, চিত্র প্রদর্শনীতে আর বইমেলায় যায়। কিন্তু সব পাওয়ার দর্শন যেন দ্রুতই মধ্যবিত্তদের স্বপ্নগুলো, ইচ্ছেগুলো, আকাঙ্ক্ষাগুলো বদলে দিচ্ছে।

সংস্কৃতি, শিক্ষা, রুচিবোধের সাথে আধা স্বচ্ছলতা নিয়ে স্বপ্ন বোনার জায়গাটা যেন শেষ হতে চলেছে। কারণ তারও এখন উচ্চবিত্তের মতো জীবন আছে। একটা সময় ছিল বহু সাধনার পর কোনো স্বপ্ন পূরণ হতো। এখন আর কোনও কিছুই মহার্ঘ্য নয় মধ্যবিত্তের কাছে। স্বপ্ন দেখতে হয় না। ইচ্ছে হতে না হতেই মুঠোয় চলে আসে কাঙ্ক্ষিত বস্তু তা সে রঙিন টিভি হোক, স্মার্ট ফোন হোক, ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ি হোক।

হয়ত মনে হতে পারে এখন আর মধ্যবিত্তের আর্থিক কোনো সমস্যা নেই। আছে, আরও বেশি আছে। বিত্তশালীদের সাথে তার দূরত্ব বেড়ে বেড়ে সে পর হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে তার জাগতিক কোনও কিছুর অভাব নেই, কারণ ক্রয়–‌বিক্রয়ের পদ্ধতিটা পাল্টে গেছে। একটা টাকা থাকলেও ফ্রিজ–টিভি–গাড়ি কেনা যায়। প্লাস্টিক মানির বদৌলতে মধ্যবিত্তদের এই উচ্চবিত্তায়ন চলছে অনেকদিন থেকেই। আর সে কারণেই সাংস্কৃতিক বোধ, রুচির জায়গা পরিবর্তিত হয়ে হয়ে ক্রমশ ক্ষীয়মাণ মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব। মধ্যবিত্তের নিজস্বতা, মধ্যবিত্ত মানস হার মানছে ভোগবাদের সর্বগ্রাসী আধিপত্যের কাছে।

বিজ্ঞাপন

প্রবৃদ্ধির মাপকাঠিতে দেশে অগ্রগতি আছে। এখন সরকারি হিসেবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। কিন্তু তবুও দেশ আজ খানা-খন্দকে ভরা, যানজটে স্থবির আমাদের রাজধানী, আর পিছিয়ে পড়া বিশাল বাংলা। পিছিয়ে পড়া এ কারণে যে, বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত নাগরিক সমাজের হাতে। শহুরে ড্রইংরুমে, ক্লাবে, পার্টিতে ঠিক করে নেওয়া হয় কোথায় পাওয়ার প্লান্ট হবে, কোথায় উড়াল সেতু হবে, কারা কাজ পাবে। সিংহভাগের কাজ শুধু দূর থেকে সেটা দেখে যাওয়া, আর হাততালি দেওয়া। মধ্যবিত্তও এখন কেবল হাততালি দেওয়া জনগোষ্ঠী যারা কেবল উচ্চস্তরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

এখন রাজনীতিই সব নিয়ন্ত্রণ করে। বাণিজ্য, শিক্ষা এমনকি সংস্কৃতিও যেসব ছিল মধ্যবিত্তের আসর। মধ্যবিত্ত যখন থেকে রাজনীতি বিমুখ হয়েছে তখন থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতিও তার হাত থেকে চলে গেছে। বাম রাজনীতি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, আর ডানের রাজনীতি রেন্ট সিকিং বা চাঁদাবাজি সংস্কৃতির কাছে বন্দি হয়েছে। রাজনীতি হয়ে উঠল বড় মানুষের বড় বাণিজ্য, যেখানে মধ্যবিত্ত কোনো জায়গা পায় না, তবে চায় ঠিকই। এই রাজনীতি চায় না, মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক, চায় না সভ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা হোক।

এখন রাজনীতি মানে একটা উন্মাদ রাজনীতি, যে রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত মানসিকতা বেমানান। রাজনীতি মানে পেশির ব্যবহার থাকবে, লোভের ঝিলিক থাকবে, জল, জঙ্গল, ভূমি, নদী, খাল দখলে নেওয়ার নীতিই প্রকৃত নীতি হয়ে উঠবে। এই রাজনীতির জমানায় মধ্যবিত্তদের মানবিক মুখটাকে যেন সমাজ অস্বীকার করে।

মধ্যবিত্তের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যহীন এক নাগরিক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চবিত্তরাও নীতি নৈতিকতা, দেশপ্রেম আর জীবন ধারণের বাণী শুনিয়ে যান, তবে নিজেদের জীবনে সেসব পালন করেন না তারা। উচ্চবিত্ত এককভাবে কোনো ভোটে জেতাতে পারে না, কিন্তু তারা ঠিক করে দিতে পারে ভোটের রাজনীতিটা কেমন হবে। তাদের দেখানো পথেই হেঁটে যায় মধ্যবিত্ত। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বহু মানুষের মৃত্যু আমাদের বলে দেয় জীবন দিয়ে উচ্চবিত্তের স্বপ্ন পূরণ করে নিম্নবিত্তরা।

বিজ্ঞাপন

আমাদের স্থানীয় পর্যায়ের সব জনপ্রতিনিধি এখন কেন্দ্রের মুখ, প্রান্তিক মানুষের কেউ না। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিকরা তাই ভেবে দেখেন না কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকরা কোথায় যায়, তাদের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কোথায় লেখাপড়া করে, কিংবা তারা কোথায় হারিয়ে যায়, প্রতিদিন এতো এতো সড়ক দুর্ঘটনায় কত দরিদ্র মানুষ কোথায় চিকিৎসা পায়? আর্থ-সামাজিক অন্বেষণ নেই উচ্চবিত্তের নির্ধারিত ছকে চলা রাজনীতিতে। পুরোটাই কেবল নিজে পাওয়ার, কারা পেল না সেই ভাবনার নয়। সেখানে বড় বেমানান আজ মধ্যবিত্ত।

শাসন মেনে নাও, চেষ্টা করব যাতে তুমিও কিছু পাও -এমন এক দর্শনে পরাভূত এক সময়ের সচেতন মধ্যবিত্ত। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বড় ভূমিকা ছিল নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের। গণতন্ত্রের প্রসারে রাজনৈতিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্য ছিল আমাদের। রাজনীতি আছে ঠিকই, তবে সেই রাজনীতিতো যেন করপোরেট নিয়মের লাভক্ষতির অংক। এই অংকের সাথে পাল্লা দিয়ে সুবিধার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল মধ্যবিত্ত।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর