বিপথগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কারও দায় নেই?
১২ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৪২
আইন কী বলে? থানা থেকে শতগজ বা নির্দিষ্ট এলাকায় প্রকাশ্যে কোন অপরাধ দিনের পর দিন সংগঠিত হলে তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের নয়। নাকি পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর ব্যবস্থা নেয়ার কথা? অপরাধ দেখেও যদি পুলিশ অবহেলায় পাশ কাটিয়ে যায়, তাহলে সমাজে এ কারণে যে বিরুপ প্রভাব পড়বে এর দায় আসলে কার উপর বর্তায়?
মূল কথা হলো যে কোন অপরাধ সমাজে বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি করে, এটাই স্বাভাবিক। অপরাধের প্রভাবে পরিবেশ নষ্ট হয়। স্বাভাবিক জীবন যাপনকে ব্যাহত করে। তাই দায়িত্বশিল জায়গা থেকে কাজের কাজটুকু করলে অপরাধের বিস্তার হয় না।
তবে অপরাধ দমনে পুলিশের একটা অনিহা কিন্তু আমরা সব সময় দেখি। যে কোন ঘটনার ক্ষেত্রে থানা কর্তৃপক্ষ একটা সোজা উত্তর দেয়, এলাকাটি আমাদের নয়। এতে মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়। সাধারণ মানুষ যদি থানার সীমানা জানত তাহলে তো হতোই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল কাজ হলো জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দুই কাজের মধ্যেই সকল ঘটনা যুক্ত। তাহলে কোনকিছুই এড়িয়ে যাওয়া আইন বা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। সীমানার কথা বলে কোন ঘটনা যদি থানা কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যায়, এতে তো কারো জীবনও বিপন্ন হতে পারে! এই ভাবনা মাথায় রেখে সবার আগে উচিত সীমানার দোহাই না দিয়ে যে কোন ঘটনায় পুলিশকে ইতিবাচক সাড়া দেয়া।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, যেসব শিশুর জন্য রাস্তা বসবাসের স্থান অথবা জীবিকার উপায় হয়ে গেছে, তাদের পথশিশু বলা হয়। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ি যদি বলি রাজধানী ঢাকায় পথশিশুর সংখ্যা কত? এর প্রকৃত চিত্র কারো কাছে নেই। তাই বলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাবে?
কমলাপুর রেলওয়ে থানা থেকে স্টেশনের ছাদ বা পুরো প্লাটফর্ম কতদূর? অনেকেই হয়ত বিষয়টি শুনে অবাক হবেন। অবাক হওয়ারই কথা। কারণ এই পুলিশ স্টেশনের আশপাশজুড়ে রাত-দিন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। আর এই অপরাধে যুক্ত একদল ছিন্নমূল অসহায় পথশিশু। এই দলে ছেলে- মেয়ে উভয়েই রয়েছে। যাদের মূল ঠিকানা হলো পথ।
তারা প্রকাশ্যে ডান্ডি সহ নানা নেশায় বুদ হয়ে থাকছে সব সময়। নেশা আর জীবন চলানোর টাকা সংগ্রহে ছিনতাই, চুরি সহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। প্রকাশ্যে যৌনাচার করছে। চোখের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে তাদের জীবন। এসব শিশুদের সুপথে ফেরাতে পুলিশের কী কোন দায় নেই?
সবুজবাগ বা খিলগাঁও থানা এলাকার খিলগাঁও রেল গেইট বা বাসাবো এলাকায় রাস্তার উপর প্রতিদিন অন্তত ৫০জনের বেশি মাদকাসক্ত কিশোর-কিশোরীদের মানবেতর চিত্র চোথে পড়ে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, এসব শিশুদের মাঝে মধ্যে খাবার আর অর্থের লোভ দেখিয়ে অজ্ঞান করে সদরঘাটের কোন একটি স্থানে নিয়ে গিয়ে শরীর থেকে রক্ত নেয়া হয়!
খিলগাঁও রেল গেইট থেকে বাসাবো মোড়ের মাঝখানে প্রতিদিন নিরাপত্তা চৌকিতে পুলিশ তৎপর থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ পাশেই একদল শিশু রাতদিন নেশায় নিজেদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এ নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এটা কোন ভাবেই হতে পারে না? পুলিশের দায়িত্বের তালিকায় কী তাহলে এসব শিশুদের ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ না নেয়ার কথা বলা রয়েছে?
শাহজাহানপুর থানা থেকে সবুজবাগ-খিলগাঁও থানার দূরত্ব দুই কিলোমিটারের মধ্যে হলেও এই এলাকার কিশোর অপরাধী বা পথ শিশু অপরাধীদের দল দুই শতাধিকের বেশি হয়ত হবে। নেশাগ্রস্থ হয়ে পথে তাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার পথে, অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার। পল্টন মডেল থানা এলাকার ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলাতেও একই চিত্র। এগুলো কী সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে নাকি দায়িত্বে অবহেলা? কোনটি জাননিা।
তেমনি মতিঝিল-পল্টন-শাহবাগ-রমনা-যাত্রাবাড়ি-তেজগাঁও-মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি থানা এলাকাতেও পথশিশুদের একই চিত্র দেখা যায়। নেশাগ্রস্থ এসব ছেলে মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে। গোল হয়ে বসে একজন আরেকজনকে মুখে খাবার তুলে দেয়। যাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায় কারো নেই।
আর শিশুরাই হচ্ছে শিশুদের পিতামাতা! অকাল মাতৃত্বের কারণে কিশোরীর জীবনও তো বিপন্ন হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- পথে থাকা কিশোরীও হয়ত তার সন্তানের প্রকৃত বাবার পরিচয় বলতে পারবে না। কারণ সংঘবদ্ধ নেশাকরা কিশোরদের সবাই একজন কিশোরীকে স্ত্রীর মতো ব্যবহার করে।
রাজধানী শহরে এমন অসহায় নেশাগ্রস্থ শিশুর সংখ্যা কত এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এসব শিশুর প্রতি তো সমাজের দায় রয়েছে। একজন শিশু জন্মের পরেই সে রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার রাখে। রাষ্ট্র কী এসব শিশুর অধিকার নিশ্চিত করেছে? এটি যে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় তা নয়, দায় সবারই রয়েছে। তবে অপরাধ দমনের দায় তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোন ভাবেই এড়াতে পারে না।
চোখের সামনে পুষ্টিহীন শিশুরা নেশা খেয়ে দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে; তা সবার চোখ এড়িয়ে যাবে, এটা হয় না। পুলিশের পক্ষ থেকে ভাসমান এসব শিশুদের অপরাধ থেকে ফিরাতে কখনও বাধা দেয়ার নজির নেই, যা সত্যিই কষ্টদায়ক।
সামাজিক দায়িত্বের জায়গা থেকে এসব শিশুদের সুপথে আনার পরিকল্পনা যদি পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া হয় তাহলে এটি হবে একটি বড় দৃষ্টান্ত। এজন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দিকে না তাকিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকেও একটি প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। সমাজের বিত্তবানদের থেকে অনুদানে গড়ে তোলা প্রকল্প থেকে শিশুদের আলোরপথে নেয়া কষ্টসাধ্য কিছু নয়। এই শিশুদের থেকে প্রকৃত শিক্ষার মধ্য দিয়ে মেধাবী মুখ কী বেরিয়ে আসতে পারে না?
সমাজের বঞ্চিত এই অংশটুকু কিন্তু রাষ্ট্রের মূল জনশক্তিরই অংশ। অর্থাত কর্মক্ষম জনশক্তি যদি বিপথগামী হয় তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। এই জনশক্তিকে উৎপাদশীলতা, গবেষণা বা উন্নয়ন যে কোন পর্যায়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। অভিভাবকহীন এসব শিশুদের থেকে কেউ কেউ নিজের মেধা দিয়ে দেশের মুখ আলোকিত করতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ সৃষ্টিশিলতায় বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে গর্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে না, তা বলা য়ায় না। এজন্য সুযোগ নিশ্চিত করা দরকার।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্ক্যান বাংলাদেশ বলছে, ‘দেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এসব শিশুদের মধ্যে মাদকাসক্ত ৮৫ শতাংশ। খাবারের সংগ্রাম করছে ৮০ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতন ও শোষণের শিকার ৪৬ শতাংশ’।
পুলিশ বলছে, দেশে ১১ লাখ পথশিশু কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত। তাদের প্রায় অর্ধেক মাদকাসক্ত। পুনর্বাসন না করলে এই পথশিশুদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাদের মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য পুলিশ বিশেষ উদ্যোগও নেয়ার কথা বললেও পথের অপরাধ কিন্তু পথেই রয়ে গেছে।
২০১৫ সালের ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘প্রতিটি শিশুই স্কুলে যাবে। একটি শিশুও ঝরে পড়বে না, রাস্তায় ঘুরবে না, টোকাই হবে না। তারাও স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে।’ বিষয়টি তদারকি করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর পথশিশুদের পুনর্বাসনে কমলাপুর ও কারওয়ান বাজারে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হলেও এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। এক কথায় বললে দায়িত্বশিলরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি বলেই পথশিশু বাড়ছে।
পুলিশের হিসাব বলছে, ঢাকার ২২৯টি স্থানে পথশিশুদের অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে। পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত। ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্ত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে এবং মেয়েশিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মেয়ে পথশিশুরা যৌনকর্মেও জড়িয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। অথচ পথশিশুরা এসবের নাগালের বাইরে থাকছে।
এই তথ্যগুলো দেশের জন্য সত্যিই খুব উদ্বেগজনক। বাস্তবতাই বলছে, শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে নজর দেয়া খুবই জরুরি। কারণ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নকারি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিশু অধিকার রক্ষায় বদ্ধ পরিকর। শিশুরা যদি সুস্থ ধারায় বড় হতে না পারে তাহলে তাদের প্রকৃত বিকাশ ঘটবে না। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটিই হবে বড় রকমের বাঁধা।
পরিচয়হীন পথের শিশুদের সুপথে ফেরাতে জোড়ালো পদক্ষেপ নিতেই হবে। পথে শিশুদের দিনের পর দিন নেশা খেতে দেখে কেউ যেন আর বলতে না পারে, থানা থেকে অপরাধের ঘটনাস্থল কতোদূর। এগিয়ে চলার বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রাস্তায় অমানবিক অবস্থায় পড়ে থাকার দৃশ্য মোটেই সুখকর হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বিপথগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কারও দায় নেই? মত-দ্বিমত রাজন ভট্টাচার্য