Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বিশ্ব

অলোক আচার্য
১৫ অক্টোবর ২০২২ ১৩:৫৯

বিশ্ব এখন অন্য যেকোনো দশকের চেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই সংকট যে আগামী বছর বেশ তীব্র হতে পারে সে আশঙ্কাও রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অধিক খাদ্য উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনই বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের মুহূর্তে একটি দেশকে নিরাপত্ত দিতে পারে। সুতরাং আমাদের উচিত এক ইঞ্চিও জমি অনাবাদী না রেখে খাদ্য উৎপাদনের মনোনিবেশ করার। গত জুন মাস থেকেই জাতিসংঘ বিশ্বের সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়ে সতর্ক করে আসছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর আশঙ্কা বৈশ্বিক মন্দার কবলে পরলে বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। বিশ্বের ৪৮ টি দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ এখন চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর মতে বিশ্ব চরম খাদ্য সংকটের দিকে যাচ্ছে। সেই সংকট মোকাবেলায় আমাদের এখন থেকেই কাজ করতে হবে। একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের জন্যই প্রধান চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশগুলো সমণ্বিতভাবে এ সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে কারণ পৃথিবীতে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে। এই সমস্যা আমাদের আগেও ছিল কিন্তু সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে। যুদ্ধ সবাই শেষ চাইলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ নেই বিপরীতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের নতুন সৈন্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বড় আকারের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও! যদিও এটা একটি সম্ভাবনা মাত্র। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য মানুষই দায়ী। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো যে মানুষগুলো এই সমস্যার তৈরি করেছে তারা কিন্তু খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে না। খাদ্যে যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও ধনী দেশসহ সকলেই ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫টি দেশের ২০ কোটি ৫১ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগবে এবং ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। সোমালিয়ার উপকূলবর্তী তিনটি অঞ্চলে অক্টোবর থেকে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রবল খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থাপনার এ ভয়ানক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সব জিনিসপত্রের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম। বেড়েছে সার ও কীটনাশকের দাম। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সরবরাহ খরচ। সবদিক থেকে ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশেই বেড়েছে খাদ্য পন্যের দাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২১ টি দেশ ৩০ ধরনের খাদ্য উপকরণ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু দেশ খাদ্য রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য শস্যের মূল্য ৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সাথে রপ্তানি মূল্য সূচক কমেছে ২ শতাংশ। মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রথম হলো খাদ্য। বিশ্বজুড়েই খাদ্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। যদিও গত জুলাইয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন একটি সমঝোতায় পৌছালে খাদ্য সরবরাহ শুরু করে ইউক্রেন। এরপর বিশ্বে খাদ্যের বাজার একটু স্থিতিশীল হয়। এই দুই দেশ বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। যুদ্ধের সাথে সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ভারতসহ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোতে চলতি বছর উৎপাদন কম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে এ তথ্য জানা যায়।

বিজ্ঞাপন

আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র হচ্ছে। এছাড়াও মূল্যস্ফীতি বাড়ায় উন্নত দেশগুলোতেও খাদ্যপণ্যের মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানা যায়, জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ড এক তথ্যে জানিয়েছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধে বিশ্বজুড়ে চরম খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে বিশ্বের ৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছে। তবে এ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে তো মারাত্বক খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ুর সাথে মানবসৃষ্ট পরিবেশ এর জন্য দায়ী। কম বৃষ্টিাতের ফলে নষ্ট হয়েছে সোমালিয়ার হাজার হাজার একর জমির ফসল। পানি ও খাদ্যশূন্য হয়ে মারা গেছে কৃষকদের গবাদিপশু। সম্প্রতি বিশ্বের দুই শতাধিক এনজিওর গবেষণা প্রতিবেদন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, বিশ্বে কেবল ক্ষুধার কারণেই প্রতি চার সেকেন্ডে একজন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিবৃতিতে এনজিওগুলো বলেছে, ৭৫টি দেশের বিভিন্ন সংগঠন আকাশচুম্বী ক্ষুধার মাত্রা এবং তা মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুপারিশ নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে। এতে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- বিশ্বের ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন তীব্র ক্ষুধার্ত। আর ক্ষুধার্ত মানুষের এই সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একুশ শতকে বিশ্বে আর দুর্ভিক্ষ ঘটবে না বলে বিশ্ব নেতারা প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সোমালিয়ায় আরও একবার দুর্ভিক্ষ আসন্ন। বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অনাহারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। বিশ্বের দুই শতাধিক এনজিও’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন প্রায় ১৯ হাজার ৭০০ জন মানুষ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছেন।

পৃথিবী এখন মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছে। বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীত ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর মধ্যে একটি হলো সুদের হার বৃদ্ধি করা। সম্প্রতি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বলেছে, ২০২৩ সালের মধ্যেই মন্দায় পড়বে ব্রিটেন। মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়াবে কমপক্ষে শতকরা ১৩ ভাগ। বিশ্ব এখন মূলত বড় ধরনের অর্থনৈতিক খাদ্য সংকটের পরিস্থিতির মুখে দাড়িয়ে আছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে খাদ্য সংকট থেকে দরিদ্র দেশগুলোতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। উন্নয়নশী বিশ্বের দেশ এবং এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এই মন্দার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ সংকট কোটি কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রান্তে ঠেলে দেবে। ফলে নজিরবিহীন অপুষ্টি ও ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে, যা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। পৃথিবীতে ক্ষুধা যুদ্ধের আগেই বড় সংকটের বিষয় ছিল। এখন তা আরও তীব্র হয়েছে। ২০২২ সালকে সর্বনাশা এক ক্ষুধার বছর’ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলা প্রকল্পে জন্য বিশ্বব্যাংক যেদিন ১২ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত তহবিল ঘোষণা করেছে।

আমাদের হাতে যুদ্ধ বন্ধ করার বিকল্প নেই। অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না। এটা একটি মানবিক বিপর্যয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যেখানে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। এই দারিদ্রতার কারণেই মূলত ক্রয়ক্ষমতা কমে এবং মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। করোনার ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কারণ দফায় দফায় লকডাউন থাকায় বন্ধ থেকেছে উৎপাদন কার্যক্রম। মানুষ কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে যখন ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা চলছিল সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে এসেছে। একটি ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই আর একটি ধাক্কা মানুষের নাভিশাস ফেলতে বাধ্য করছে। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রতিদিনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে। আগামী কয়েকমাসে পৃথিবী একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়ার মতো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো প্রথমত করোনার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ,করোনার শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এর সাথে বহুদিন ধরে চলে আসা সমস্যাগুলো যেমন- বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব সংঘাত,জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা এবং শরণার্থী সংকট। এখন এসব সমস্যা আরও বেশি তীব্র হওয়ার মুখে। কারণ বিভিন্ন দেশ খাদ্য সংকটের মুখে দাড়িয়ে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়েই তীব্র শরণার্থী সংকট চ্যালেঞ্জের মুখে দাড় করিয়েছে। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা দাড় করা কষ্টসাধ্য।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারাবিশ্বেই দারিদ্রতা গ্রাস করছে। ভয়াবহভাবে দারিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসাথে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। সেটা সামাল দেয়া বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জের। দারিদ্রতা, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, রিজার্ভ কমে যাওয়া, খাদ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ভোগাবে। যদিও এর সাথে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন খরা, বন্যা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী এই সময় অত্যন্ত জরুরি। আর তা সম্ভব না হলে সত্যি সত্যি এই পৃথিবীকে খাদ্য সংকটে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় বিশ্ব মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর