ফের বেড়েছে ডেঙ্গু: সকলের সতর্কতা প্রয়োজন
১৭ অক্টোবর ২০২২ ১৫:১৯
ডেঙ্গুর অবাধ বিচরণ রাজধানী ছাপিয়ে এখন দেশের জেলাগুলোতে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে রোগী। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অভিযোগ, মশা নিধনে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু অনীহার কারণে রোগীরা মশারি টানাচ্ছেন না। তবে ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গুর পরিস্থিতি দিন দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, বরিশাল, যশোর ও ফরিদপুরে গেল ২৪ ঘণ্টায় ২৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা অভিযোগ করেছেন, মশা নিধনে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তেমন কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের নির্দেশে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার জন্য লোকবল, লজিস্টিকস, জায়গা তৈরি রাখার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত রোগী ভর্তির পাশাপাশি আবার কত ডেঙ্গু রোগী আসবে তা কেউ জানে না। এ কারণে জায়গা তৈরি করে রাখা হচ্ছে, কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় ফেরত না যায়। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধন ও ঝোপঝাড় ধ্বংসের পাশাপাশি দিনে ও রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবশেষ হিসাবে মারা গেছেন ৭৫ জন। এরমধ্যে ৪৮ জনই ঢাকার বাইরের। আর পুরুষের তুলনায় এবার নারীদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। ডেঙ্গুর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০ বছরের উপরে বয়স- এমন রোগীদের আক্রান্তের পরিমাণ বেশি (৬২%)। তবে বয়স্ক রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। মারা যাওয়াদের এক তৃতীয়াংশের বয়সই চল্লিশের উপরে। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে গুরুত্ব দেন না। পরিস্থিতি বেশ খারাপ হওয়ার পরেই কেউ কেউ হাসপাতালে আসছেন। এই বিলম্বের কারণে হাসপাতাল আসার পরপরই মৃত্যুর হার বেশি। বর্তমানে ডেঙ্গুর চারটি ধরণ আছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪।
২০১৮ সালের পর ডেঙ্গুর ডেন-১ ধরনে মানুষের আক্রান্ত হতে দেখা যায়নি। ২০২১ সালে সব মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল ডেন-৩ ধরনে। এ বছর ডেন-৪ ধরনের প্রকোপ বেশি। আবার ডেন-৩ ও ডেন-১ ধরনেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ডেঙ্গুর তিনটি ধরণ দেশে এখন সক্রিয়। এটি ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। ২০০০ সালে দেশে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। প্রতিবছরই মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে থাকে।মানুষকে সচেতন থাকতে হবে করতে হবে, নিজের বাড়িতে এডিস মশা না থাকার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আর জ্বরে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। যেভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবেই প্রতি বছর এভাবে ডেঙ্গু হানা দেয়। শিশুদের এই সময়ে হাত পা ঢাকা জামা কাপড় পরানো উচিত। তারা দিনে ঘুমালে মশারি টানিয়ে দেয়া উচিত।
ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে আসে এডিস মশার মাধ্যমে। বর্ষায় বাসাবাড়িতে পানি জমে এই মশার বংশবিস্তার বেশি ঘটে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়। মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরের বছরগুলোতে এর প্রকোপ খুব বেশি ছিল না। তবে ২০১৯ সালে তা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছর দেশে ডেঙ্গুতে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষাধিক মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। এখন ডেঙ্গুর পরীক্ষা কেউ করছেন না। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বর হলেই কোভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গুপরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। এছাড়া সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো সফল করার পাশাপাশি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব নিজ নিজ বাড়ির চারপাশগুলো যেন এডিস মশার অভয়ারণ্য না হয়ে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। প্রায় প্রতিবছরই মশাবাহিত ভাইরাস থেকে জ্বরে কাবু হয় ঢাকার মানুষ। এবারে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
২০ আগস্ট হল, বিশ্ব মশক (মশা) দিবস। ১৯৩০ সাল থেকে প্রতি বছরের এই দিনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মশা দিবসের কথা প্রথম বলেন ‘স্যার ডোনাল্ড রস’। ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট, যেদিন প্রমাণিত হয়েছিল মশাবাহিত রোগে স্ত্রী এনোফিলিস জাতীয় মশাই দায়ী। এ আবিষ্কার তাকে ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। বাংলাদেশে ২৯ প্রজাতির মশা থাকলেও এডিস প্রজাতির মশা দ্বারা সংক্রমিত এ বছর ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। এডিস মশা হলো ডেঙ্গু জ্বরের বাহক। বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ভেতরেই এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। অসচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে ছড়ায় ডেঙ্গু ভাইরাস। এই ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর। এডিস ইজিপ্টাই নামক এক ধরনের মশা এ ভাইরাস বহন করে। এ মশা কাউকে কামড়ালে তিনি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রকট। বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে। সাধারণত শহর, নগর ও বন্দর এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি। কারণ ওইসব অঞ্চলের অভিজাত এলাকার নালা নর্দমা ও বড় বড় দালান কোঠা ও স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার প্রকোপ বেশি থাকে। তবে বস্তি বা গ্রামের বাসিন্দাদেরও অপরিচ্ছন্নতার কারণে ঝুঁকি থেকেই যায়। এদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস শিশুদের বেশি আক্রমণ করে। ফলে তীব্র প্রকোপে শিশুরা মৃত্যুযন্ত্রনা ভোগ করে। আবার অনেকেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। ২০২১-এ সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর আগে চলতি বছরের ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকলেও আমরা নিরাপদ নই। ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু মশাই এই রোগের একমাত্র বাহক, সুতরাং মশার আবাস ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে পারলেই এডিস নির্বংশ হবে সমূলে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় এডিস মশার বংশ নাশ। তাই বসতবাড়ির এ রকম আবদ্ধ জলাধার ধ্বংস করতে হবে। ফ্রিজের বা এসির পানি দুই দিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে। বাসার বারান্দায়, টেরিসে বা কার্নিশে খোলা টব থাকলে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। রাস্তার আশপাশের খানাখন্দ ভরাট করে ফেলতে হবে।কিন্তু অনেক নগরবাসী সচেতন হলেও এখনও অনেকে আছেন যারা সচেতন হচ্ছেন না। তারা তাদের বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখছেন না। বাসায় মোটামুটি দায়সারা ভাবে কাজ করছেন সকলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে পরিস্কার রাখতে হবে বাসাবাড়ি, পাশাপাশি এমন জনসমাগম এড়িয়ে মানতে হবে করোনা স্বস্থ্যবিধি। তাহলে দুই মানব শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও মশামুক্ত করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শহর আমাদেরকে পরিষ্কার রাখতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি করপোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও কম নেই। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতায় সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে আসতে হবে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের দিকে না তাকিয়ে পাড়া-মহল্লায় তরুণেরা দল বেঁধে নিজেরাই নেমে পড়তে হবে আমাদের নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে। ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই মাঠে কাজ করছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। সরকার মশা মারবে, টিকা আনবে, হাসপাতাল বানাবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। করোনাভাইরাস যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য মুখ-নাক ঢেকে রাখতে হবে। এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। প্রাণ বাঁচানো ফরজ। তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেকেই সাবধান থাকতে হবে। করোনা বা ডেঙ্গু উৎসব চেনে না। সাবধান না হলে আমরা যে কেউ যখন তখন আক্রান্ত হতে পারি। ডেঙ্গুর সতর্কতাগুলো আমাদের অজানা নয়। কোনোভাবেই যেন মশা আপনার নাগাল না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ফের বেড়েছে ডেঙ্গু: সকলের সতর্কতা প্রয়োজন মত-দ্বিমত সৈয়দ ফারুক হোসেন