Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইতিহাসের মহাশিশু হয়ে চিরস্মরণীয় থাকবেন শেখ রাসেল

তাপস হালদার
১৭ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৪১

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেল। তিনি ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

শেখ রাসেলের নামকরণেরও একটি ইতিহাস আছে। শেখ রাসেলের জন্মের দু’বছর আগে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভের মধ্যে কূটনৈতিক ও স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল। এক পর্যায়ে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন নোবেলজয়ী বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। যুদ্ধ থামাতে তিনি জোরালো প্রতিবাদ মূখর হয়ে উঠেছিলেন। রাসেলের যুক্তির পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল। দু-পক্ষই এক পর্যায়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব দুজনেই বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের অনুরাগী ছিলেন। সেজন্যই মহান বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে বঙ্গবন্ধু তার ছোট ছেলের নাম রাখেন রাসেল। এই নামকরণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে রাসেলকে নিয়ে একটি মহৎ স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল নক্ষত্র। নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা। তিনি হয়তো রাসেলের মধ্যে তেমন কিছু দেখতে চেয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু রাসেলকে নিয়ে কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি লিখেছেন, ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মধ্যে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। তিনি ’১৪-১৫ এপ্রিল আরো লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্য হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে নিলে আমার গলা ধরে আব্বা-আব্বা করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে আব্বা -আব্বা করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কি? ওর মা বলল, বাড়িতে আব্বা-আব্বা করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে। রাসেল আব্বা-আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে,‘তুমি আমার আব্বা।’

বিজ্ঞাপন

দেশরত্ন শেখ হাসিনাও রাসেলের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইতে লিখেছেন, ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রায় তিন বছর পর আব্বা গনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান, তখন রাসেলের বয়স চার পার হয়েছে। এর মধ্যে ওর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, খেলার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ পরপরই আব্বাকে দেখে আসত। আব্বা নিচে অফিস করতেন। আমরা তখন দোতলায় উঠে গেছি। ও সারাদিন নিচে খেলা করত। আর কিছুক্ষণ পরপর আব্বাকে দেখে যেত। মনে মনে বোধ হয় ভয় পেত যে, আব্বাকে বুঝি আবার হারায়।

আবার পরবর্তীতে পিতা বঙ্গবন্ধুকে যখনই কাছে পেয়েছে তখনই ছায়া সঙ্গীর মত পাশে থেকেছে। ১৯৭২ সালে জাপানি চলচ্চিত্রকার Nagisa Oshima নির্মিত ‘Rahaman Father of Bengal’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্রে জাপানি সাংবাদিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লক্ষ্য করেছি একটি ছোট্ট ছেলে আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করে। ছেলেটি কে? কেন সে সবসময় আপনার পাশে থাকে? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছেলেটির বাবা সবসময় কারাগারে থাকতো। ফলে সে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি তার বাবা, তাই সবসময় তাকে কাছে রাখি।’

মানুষকে আপ্যায়ন করা রাসেল পরিবার থেকেই পেয়েছেন। রাসেলের একজন গৃহ শিক্ষক ছিলেন নাম গীতালি দাসগুপ্ত। তাকে রাসেলের শর্ত ছিল যদি তিনি প্রতিদিন দু’টো করে মিষ্টি খান তাহলেই সে পড়তে বসবে। বাধ্য হয়েই শিক্ষয়িত্রীকে প্রতিদিন মিষ্টি খেতে হতো। এছাড়া তিনি যখন টুঙ্গিপাড়া যেতেন তখন গ্রামের ছোট বন্ধুদের জন্য প্রতিবারই জামাকাপড় নিয়ে যেতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সকলের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারী এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বলল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কন্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ ভাবে আঘাত করতে লাগল। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। এক সৈন্য শেখ রাসেলকে আলাদা করে ফেললে সে তার মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে যাওয়ার আকুতি জানায়। ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। এক সৈন্য তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওযার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে মায়ের রক্তমাখা মরদেহ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কন্ঠে শেখ রাসেল মিনতি করে,‘আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ কিন্তু রাসেলের আর্তনাদ হায়নাদের মন গলাতে পারেনি। নরপশুরা শেখ রাসেলকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। রাসেল ছিল ঘাতকদের শেষ শিকার। রাসেলকে হত্যার পর নরপশুরা উদ্ধত কন্ঠে তাদের উচ্চ কর্মকর্তাদের খবর দেয়,‘স্যার, সব শেষ’।

এ প্রসঙ্গে শেখ রাসেলের বড় আপা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বেদনার্ত হৃদয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ছোট্ট রাসেলকে। বাবা, মা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা তখন কি রকম ব্যাথায় কষ্টে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল, কী কষ্টই না ও পেয়েছিল, কেন কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল? আমি কি কোন দিন এই ‘কেন’র উত্তর পাব?

ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বিরল নয়। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে মাত্র এগার বছরের নিরপরাধ শিশুকে হত্যা করার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নেই। শিশু হত্যা মহাপাপ। কিন্তু এমন মহাপাপের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছিল। যা বাঙালির অমোচনীয় কলঙ্কের ইতিহাস। বাঙালির যেমন গর্বের ইতিহাস আছে, তেমন সত্য কলঙ্কের ইতিহাসও। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যার সূচনা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল জাতির পিতাকে সবংশে নির্মূল করতে; যার কারণেই শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয়। ১৯৮৫ সালে সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস কর্নেল রসিদকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ছোট্ট এই শিশুটিকেও আপনাদের কেন হত্যা করতে হয়েছিল?’ রসিদের দাম্ভিক উত্তর ছিল, ‘শেখ মুজিবকে সবংশে নির্মূল করার জন্য রাসেলকে হত্যা করার দরকার ছিল।’

শেখ রাসেলের জীবনকাল স্বল্প হলেও অনেক ঘটনাবহুল। তার দৈনন্দিন কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে শিশুদের অনেক কিছু শেখার আছে। শিশুরা যদি রাসেলের জীবনী জেনে নিজেদেরকে বড় করে তাহলে আদর্শ শিশু গড়ে উঠবে। যাদের হাত ধরে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটি আদর্শ নাগরিক সমাজ গড়ে উঠবে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ রাসেলের আদর্শ, মানবিক গুণাবলি, মূল্যবোধ, আবেগ ও ভালোবাসা তুলে ধরার জন্য দ্বিতীয় বারের মত পালিত হচ্ছে ‘শেখ রাসেল দিবস’। শেখ রাসেল বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর, তরুণ শুভবুদ্ধিবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম। আজ শেখ রাসেলের ৫৯ তম জন্মদিন হলেও তিনি কোন দিন আর আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠেন নি। তিনি এখনো ছোট্ট রাসেল হয়েই আছেন। তিনি ইতিহাসের মহাশিশু হয়ে চিরস্মরণীয় থাকবেন।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইতিহাসের মহাশিশু হয়ে চিরস্মরণীয় থাকবেন শেখ রাসেল তাপস হালদার মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর