নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা: কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে
২৪ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৫৫
গত ১৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সাথে মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনারগণ। মতবিনিময় শেষে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বন্ধের সিন্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুর রউফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘যখন ভোটাররা ভোট দিতে পারে না। একজনের ভোট আরেকজন দেয়, তখন নির্বাচন কমিশন বসে থাকবে কেন? স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের এই অধিকার আছে। তাদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে জনগণ ভোট দিতে পারছে না। কারচুপি হচ্ছে। তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা বলেছি দরকার হলে বারে বারে বন্ধ করেন।’ মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হলেও তখন কেন ব্যবস্থা নিতে পারেননি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। পেছনেরটা টেনে এনে জাতিকে আর অন্ধকারের মধ্যে ফেলবেন না।’ আবদুর রউফ সাহেবের কথা শুনে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের সেই বিখ্যাত পংক্তিটি মনে পড়ে গেল, ‘এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!’ জনাব আবদুর রউফ যদি সেদিন বিএনপি সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তার দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তা ছিল এককথায় প্রহসনের নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধা নিয়ে জিয়াউর রহমান প্রথমে সেনাপ্রধানের পদ দখল করেন। সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদও দখল করেন। ১৯৭৭ সালের ৩০মে নিজের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের আয়োজন করেন। বিচারপতি এম ইদ্রিস কমিশনের সে ভোটে ভোটার উপস্থিতির হার দেখানো হয় ৮৮.১ শতাংশ। উপস্থিত ভোটের জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট ৯৮.৯ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ২.১ শতাংশ। এটাই ছিল বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের প্রথম পদক্ষেপ। এরপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে নিজে দল গঠন করে ক্ষমতাতে পাকাপোক্ত করতে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। সেখানে তিনি রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় নিজে দল গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। যা ছিল সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী। জিয়ার মৃত্যুর পর আরেক স্বঘোষিত সামরিক শাসক এরশাদও একই সাথে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের পদ দখল করেন। তিনিও তার পূর্বসূরি জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দল গঠন করেন এবং ১৯৮৬ সালের ৭মের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে এরশাদ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার অপচেষ্টা করেন। কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দেন। তারপরও ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ একটি প্রহসনের নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে আওয়ামী লীগসহ সকল বিরোধীদলগুলো এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলো একমত হয়েছিল, স্বৈরাচার এরশাদের অধীনে কোনোমতেই অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। তাই বিরোধী দলগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, এরশাদের পতন ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে লক্ষ্যে জনগনের সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। এবং তার নেতৃত্বেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হয়। এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তারপর ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপনির্বাচনে বিএনপি যে ন্যাক্কারজনক ভোট কারচুপি করেছিল তা গনতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় রচিত হয়। ভোট কেন্দ্র দখল, জোর করে প্রকাশ্যে সিল মারা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে করে বিএনপি ভোট কারচুপির সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে গিয়ে নির্বাচনের পরিস্থিতি দেখে হেলিকপ্টারে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তৎকালীন সরকারের কাছে নতজানু হয়ে তিনি সেদিন কোন ভুমিকা নিতে পারেন নি। বরং সরকারের তল্পিবাহক হয়ে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনগন যখন স্বৈরাচার পতনের পর গনতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল তখন মাগুরা উপনির্বাচন গনতন্ত্রের গায়ে স্থায়ী ক্ষত এঁকে দেয়।
আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সকল বিরোধীদল বিএনপির অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের সকল সংসদ সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। বিরোধীদলগুলোর আপোষহীন আন্দোলন ও নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও বিএনপি অনড় অবস্থানে থেকেও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রহসনের নির্বাচন করে সাদেক কমিশন। নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৯টি আসনে জয়লাভ করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল রশিদকে নির্বাচিত করে সংসদে নিয়ে আসেন এবং তাকে বিরোধীদলীয় নেতা বানান বেগম খালেদা জিয়া। এছাড়া আরেক খুনী মেজর হুদাকে চুয়াডাঙ্গা থেকে নির্বাচিত করে পরিত্র সংসদকেই অপবিত্র করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগণের আন্দোলনে খালেদা জিয়া ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করে পদত্যাগে বাধ্য হন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর শান্তিপূর্ণভাবে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান লতিফুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারের শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর। যদিও লতিফুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেই এমন কিছু কর্মকান্ড করেন যা নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ব্যাকফুটে চলে যায়। ফলে নির্বাচনে বিএনপি- জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে।
বিএনপি ক্ষমতায় গিয়েই আবার সেই পুরানো খেলা শুরু করে। ২০০৫ সালে ২২মে কারো সাথে কোন রকম আলোচনা না করেই তাদের আজ্ঞাবহ বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয় বিএনপি। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সমালোচিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ক্ষমতা গ্রহণ করেই তিনি বিএনপিকে বিজয়ী করতে এজেন্ডা নিয়ে নামেন। তৈরি করেন এক কোটি সাতাশ লক্ষ ভুয়া ভোটার। এছাড়া নির্বাচন নির্বিঘ্নে পরিচালিত করতে সকল প্রকার নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে তিনশ জন ছাত্রদলের ক্যাডারকে উপজেলা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। এসব অপকর্মের জন্য আজিজ কমিশনের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল তখন। একপর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন হলে আজিজ কমিশনেরও পতন ঘটে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হুদা কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থায় বেশকিছু সংস্কার করেন। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রনয়ণ করেন। ফলে আজিজ কমিশনের এক কোটি সাতাশ লক্ষ ভুয়া ভোট বাতিল হয়ে যায়। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স চালুর মাধ্যমে ভোট লুটের হার কমে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়।
গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বন্ধ করার মন্তব্য নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। সেখানে অনিয়মের অভিযোগে পুরো নির্বাচনই বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন বাতিল করা এটাই বাংলাদেশে প্রথম। গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনে কতটা অনিয়ম হয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেদিন নির্বাচনী এলাকায় ভোট নিয়ে কোন ধরণের সংঘর্ষ হয়নি, নির্বাচন নিয়ে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কিংবা রিটার্নিং কর্মকর্তা কোন অভিযোগ করেননি। তারপরও নির্বাচন কমিশন সিসিটিভির মাধ্যমে মনিটরিং করে অনিয়ম হচ্ছে মনে করে নির্বাচন বন্ধ করেছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে। এখানে বর্তমান সরকার কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেনি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে গাইবান্ধা উপনির্বাচন। নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীন সেইটা বর্তমান হাবিবুল আউয়াল কমিশন প্রমান করেছে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
তাপস হালদার নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা: কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে মত-দ্বিমত