গণমাধ্যম: আশা নিয়েই এ ঘর বাঁধতে হয়
২৭ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৪২
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু এগুতে পেরেছে? এ প্রশ্ন রেখেই সংবাদ, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা- এই ত্রয়ীর সুলুকসন্ধান করা যাক! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, রেডিও বা বেতার, সংবাদপত্র, সাময়িকী, ব্রোশিওর, নিউজলেটার, বই, লিফলেট ইত্যাদি হল গণমাধ্যম। মোবাইল ফোন বা সেল ফোন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটকেও অনেক সময় নতুন-যুগের গণমাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জনসভা এবং বিশেষ ঘটনায় সমবেত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানও গণমাধ্যমের একটি ধরন। একুশ শতকের আজকের যে উৎকর্ষ তাতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সভ্যতার ক্রমবিকাশে এলো কাগজ, কালি ও কলম। আধুনিক যুগে এসেছে কম্পিউটার। এ থেকেই মুদ্রণ বা ভাব বিনিময়ে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। ভাব বিনিময় বলতে যোগাযোগ। আর যোগাযোগের বিষয়টার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের এখন সোনালী সময়ে বা গণমাধ্যম এখন যৌবনে বলে অনেকে মত প্রকাশ করছেন। সত্যি কথা বলতে কি যেকোনো প্রতিকূলতার ভেতর, রুদ্ধদ্বার অবস্থায় কথা বলার মাধ্যমটি বা যোগাযোগের মাধ্যমটিই যে শক্তিশালী হবে এটিই স্বাভাবিক।
তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ওপেন সিক্রেট ব্যাপার হচ্ছে, যত নিয়ম-কানুন সবই কাগজেই আবদ্ধ। বাস্তবে তা মানতে কেন যেন আমাদের অনীহা। গণমাধ্যমও এই প্রভাবদুষ্টের বাইরে নয়। স্বাধীনতার আগের গণমাধ্যমের বাস্তবতা অবস্থান আর স্বাধীনতাপরবর্তী বাস্তবতা দুটো ভিন্ন। গণমাধ্যম স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। সেটা অনেকক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আবার অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে। একাত্তরপরবর্তী গণমাধ্যমের ঘাট মাঠ অলি গলির যে পেখম, তাতে অনেকটা ক্ষতিও হয়েছে। রুচি দর্শন মতবাদগত বা যুক্তিস্বচ্ছতার জায়গায় একটা গোলমেলে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে কারো এথিকস প্রকাশ করার জন্য আগ্রাসী ভূমিকায়ও দেখা গেছে গণমাধ্যমকে। যখন পূর্বনির্ধারিত কোনো এজেন্ডা থাকে তখন নির্লজ্জ হবেই, এবং তা হয়েছেও।
পেপার পত্রিকা ইলেকট্রিক মিডিয়ার এই প্রসারতার আগের সময়ে মানুষের চিন্তাগত, মতাদর্শগত যোগাযোগটা হতো বইয়ের মাধ্যমে। তখন বই-ই হয়ে উঠত- গণমাধ্যমের স্মারক। তখন বই বলতে যা বোঝায় আমরা মানে পাঠকরা তাই পেতাম। এখন বইয়ের সেই জায়গাটি নষ্ট হয়ে গেছে। অসংখ্য কুখাদ্য-অখাদ্য বইয়ের চেহারা সুরত নিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। গণমাধ্যমের এই বড় একটি মাধ্যমটি ম্লান হতে শুরু করেছে।
এবার আসা যাক টেলিভিশনে। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে সবেমাত্র একটি টেলিভিশন ছিল, বাংলাদেশ টেলিভিশন। সাদা কালোর যুগ পেরিয়ে বর্তমানে টেলিভিশন পৌঁছেছে রঙিনে। সংখ্যাটাও আর একের ভেতর নেই যুক্ত হয়েছে অর্ধশতাধিক নানা মানের নানা গোষ্ঠীর টেলিভিশন। এ ছাড়া টেলিভিশনসদৃশ কিছু চাইনিজ জঞ্জাল- স্মার্ট মুঠোফোন। সবাই এই মাধ্যমকে ব্যবহার করছে যেমন খুশি তেমন। এটা ভালো হতো যদি নৈতিকতার পক্ষের হতো। কিন্তু নৈতিকতা রক্ষায় কোনো মনোযোগ নেই আধুনিক বাঙালির। তারা যুগের সব গিলছে। চাইনিজ জঞ্জাল কম দামে বুঝে নিয়ে এক একজন ফজলে লোহানীর ভাব নিয়ে পরিমল হয়ে যাচ্ছেন। তারা ক্ষুদিরাম বা উল্লাসকর নন। তারা আধুনিকতার আশ্রয়ে মানব-মানবীর প্রেমকে কলুষিত করে পাড়ায় মহল্লায় অনলাইন টেলিভিশন চালাচ্ছেন। এক একজন যেন লিয়ার লেভিন। তাদের আশ্রয় মুক্তির গান নয়; গ্রামের রহিমা-সখিনার গরিবিয়ানা বাথরুম-বেডরুম। আধুনিক ভিডিও স্ক্রিপ্ট। আবার টেলিভিশনের মূলধারাও নানা গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত। চারপাশে ন্যায় ও অন্যায়ের সহযোগে অঢেল কামাই ‘হালাল’ করতে হবে। তো গণমাধ্যম বা টেলিভিশন চ্যানেলই এক্ষেত্রে আশ্রয়। এক সময় টেলিভিশনের পর্দায় মুখ দেখাতে অনেক প্রথিতযশাকে অডিশনে পাস করতে হত। এখন অভিনেতা-অভিনেত্রী-কলাকুশলীর চেয়ে নির্মাতা বেশি। সবাই টিভিব্যক্তিত্ব। এর মাঝে সব পদ আছে। চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে ক্যামেরাম্যান। তো ব্যবহার হচ্ছে ভালোই। একটি চ্যানেলের লাইসেন্স দে বাংলা মা, সব লুটে পুটে খাই।
এবার আসা যাক সংবাদপত্রে। সব মাধ্যমের মতো সংবাদপত্রও অস্থিরতার পথেই। বরং একটু বেশি মাত্রায়। তার যে একটু বেশি কদর। ছাপা অক্ষরের বিষয়ই আলাদা। এমন ‘সুনাম’ নিয়েই বাংলাদেশে রয়েছে ‘অগুনতি’ দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক। তারা সবাই হন্যে দেদারসে কামাইয়ে। ব্যক্তিস্বার্থে যা করতে হবে তাই করা সই। ছাপা অক্ষরের মূল্যকে যুগ-যুগের ভুল প্রমাণই সকলের উদ্দেশ্য। এ গরীব ও ক্ষুদ্র দেশের বাস্তবতায় সরকারও এর লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। সরকারের মাঝেই গণমাধ্যমের অপব্যবহারকারীদের বসবাস। ফলে গণমাধ্যমের কলুষতা বাড়ছেই। এক হিসাবে জানা যায় দেশের দৈনিক পত্রিকার নব্বই ভাগের সম্পাদক প্রকাশক নিজেই। তাদের টাকার পাঠ আছে, কিন্তু গণমাধ্যম পাঠ কতটুকু তা পাঠক না জানলেও গণমাধ্যমকর্মীরা জানেন। তারা প্রত্যেকে এক একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রধান। নিজের আখের গোছাতে গণমাধ্যমের আশ্রয় নিয়েছেন। মালিক-সম্পাদক হয়ে গণমাধ্যমের বারোটা বাজাচ্ছেন।
এদিকে সাধারণ মানুষ, যারা পাঠক তারা কষ্টের টাকা খরচ করে গণমাধ্যম পাঠ করছেন। মাঝে মাঝে আবিষ্কার করছেন একই ঘটনা ভিন্ন গণমাধ্যমে ভিন্ন। আরো দেখছেন এক একটি গণমাধ্যম এক একটি দলের মুখপত্রের ভূমিকায়। এক একটি গণমাধ্যম এক একটি ঘটনাকে ভিন্ন মোড় বা দৃষ্টি থেকে দেখছে। অবশ্যই নিজ স্বার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে। এতে অভাবনীয় সব দেখতে পারছে জনগণ। তার অনেকগুলোই মর্মস্পর্শী-বেদনার।
গণমাধ্যম হয়ে যাচ্ছে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা। কারো না কারো থলেতে আছে। সব ক্যাঙ্গারুকে আবার কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। সময়ের ভেদে সরকারের রুষ্টতায় পড়েছে সব গণমাধ্যম। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সরকারের সময় পর্যন্ত। গণমাধ্যমের মূল কাজটি কোনোভাবেই করা যাচ্ছে না! দেশের বাইরে গিয়ে করা যায়। বৈশ্বিক ব্যবস্থাও কি অন্য এক খোপের মধ্যে নয়? কথা আসে গণমাধ্যমের কতটুকু স্বাধীনতা চাই? এও যুগ-যুগের প্রশ্ন। গণমাধ্যমকর্মীরাও কতটা স্বাধীন বা স্বাধীন থাকতে চান? এও বিবেকের প্রশ্ন।
গণমাধ্যম নানা অপকর্মের ভাগিদার পুঁজিবাদি গোষ্ঠীর খেলার বিষয়। কথিত এক পেশিশক্তির নেতার কথায়- গণমাধ্যমকর্মীরা কুকুরের মতো। আসলে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের কুকুরই বলতে চেয়েছেন বা বলেছেন। অনেকে তখন বলেছেন নীতির প্রশ্নে তারা চাকরি পকেটে নিয়ে ঘুরেন। মানে মালিকের যেকোনো অন্যায় আবদারে চাকরি ছাড়তে প্রস্তুত থাকেন। তারপরও কথা থাকে কোনো গোষ্ঠীর খোপে থেকে আপনি নিজেকে কতটুকু স্বাধীন ভাবতে বা রাখতে পারেন? এবং এর বাইরে যাওয়ারও কি সাধ্য আছে সবার?
তাই তো আমরা গণমাধ্যমের ‘মূর্খ’ মালিকের হয়ে হেন কাজ নেই যা করি না। আবার অন্যের হয়ে গেলে আগেরজনের চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করি। আমরা কথায় কথায় শক্তিধরদের তোয়াজ করি, ক্ষমতার বাইরের মানুষদের অবহেলা ও অপমান করি। ফের যখন ক্ষমতার বদল হয় আমরা বোল পাল্টাই। আমরা গণমাধ্যমকর্মী। পুঁজিবাদী সমাজের বাইরে যেতে পারি না। যেতেও হয় তো চাই না। না হলে নানামাত্রা ও রূপের গণমাধ্যমকর্মী না হয়ে পিওর গণমাধ্যমকর্মী হতাম। এবং এভাবেই একদিন গণমাধ্যম পুঁজিবাদের সীমানা ছাড়িয়ে যেত। আমরা পেতাম একটি স্বাধীন প্লাটফর্ম।
তখন আর গণমাধ্যমকর্মী ‘কাম ড্রাইভার’ হত না। বকলম টাকাওয়ালা সম্পাদক হতেন না। আমরা তাকে স্যার স্যার যপে যেতাম না। তার তরে অনেক কিছুই করতাম না। আমরা চেষ্টায় থাকতাম একজন লিয়ার লেভিন হতে। আমরা মরিয়া হতাম একজন মোনাজাত উদ্দিন বা সিরাজুদ্দিন হোসেন হতে। আমরা ভিক্ষুকের টাকা, পতিতার টাকার ভাগ নিতে যেতাম না। আমরা মাথা কেটে বসিয়ে এক পত্রিকার রূপকে হাজার পত্রিকা বানাতাম না। আমরা অশুভ গোষ্ঠীর ভাগ হতে গণমাধ্যম খুলতাম না। জনগণের জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটিয়ে তাদের বিশ্বাস নিয়ে খেলতাম না। আমরা হতাম সংবাদপত্রশিল্পের অংশ। গণমাধ্যম হতো সত্য ও সুন্দরের। শুধুই স্লোগানসর্বস্ব হত না। আর কখনো গণমাধ্যমকর্মীকে এমন প্রশ্ন শুনতে হতো না- আর কী করেন? কিংবা আপনি সাংঘাতিক! কিংবা ঠিকভাবে চলতে পারেন তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
গণমাধ্যম একটি ক্ষমতাধর মহান প্ল্যাটফর্ম। তাই এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকেই মহান হতে হবে। কোনো এক সময়ে তা হবে এ আশা কি উচ্চাশা? স্বপ্ন না দেখলে তা ধরা দিবে কীভাবে?
স্বপ্নবাজ ও ‘ব্যতিক্রম’ না থাকলে গণমাধ্যম টিকে আছে কীভাবে? হয়তো এ লেখায় ব্যতিক্রম নিয়েই কথা বা হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে পেশার তরে বা গণমাধ্যমের তরে কিংবা ‘সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা’ এ কথা রক্তে ধারণ করে রাখা মানুষরা বিস্তর আছে, তাই এ পেশা টিকে আছে। তবে কি একান্ন বছরের স্বাধীনতায় আমাদের গণমাধ্যম এখনও হাঁটি হাঁটি পা পা করছে? তবু আশা নিয়েই তো ঘর করতে হয়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি