পঁচাত্তরের রক্তাক্ত নভেম্বরের ষড়যন্ত্র উন্মোচন জরুরি
৩ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৫৬
সাল ১৯৭৫। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা একটি বছর। যার সূচনা হয়েছিল ১৫ আগস্টে, আর এর রেশ রয়ে যায় পুরো বছরজুড়ে এমনকি পরবর্তী প্রায় দেড় দশকে বিভিন্ন রক্তাক্ত ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল বাংলাদেশ।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানটি হতে যাচ্ছিল তার প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার এই রক্তাক্ত পালাবদলের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থানের কারণ নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা থাকলে ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ফলশ্রুতি হচ্ছে নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। তার আড়াই মাস পর ৩ নভেম্বর জেলে বন্দি অবস্থায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই আড়াই মাস দেশে কোনো বৈধ সরকারের অস্তিত্ব ছিল না। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে খুনি মেজর ও কর্নেলদের নির্দেশে ঢাকার শাসন পরিচালিত হচ্ছিল। এই সময়ে খন্দকার মোশতাক সামনে থাকলেও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাশালী।
নভেম্বরের শুরুর কয়েকটি দিন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের উত্তাল ও রক্তাক্ত কয়েকটি দিন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দেশটিতে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয় তারই একটি পরিণতি ছিল এই সাতটি দিনের রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ।
নভেম্বরের ৩ তারিখের প্রথম কয়েকটি প্রহরে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়ার মতো দুটি ঘটনা ঘটে- একটি সেনা অভ্যুত্থান এবং ঢাকা কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড। কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে খুন হন ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান। এরপর মধ্যরাত পার হবার পরই খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবন ঘেরাও করার জন্য যায় একটি ইনফ্রেন্টি ইউনিট, রেডিও স্টেশন দখল করে নেয় আরেকটি সেনাদল। বঙ্গভবন ঘিরে তখন এত বেশি সেনা সমাবেশ হয়েছিল যে ভেতরে থাকা মেজর ডালিম এবং মেজর নুরসহ সেনা কর্মকর্তারা আর পাল্টা কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আর এরই মধ্যে আকাশে যুদ্ধবিমানও উড়তে দেখা যায়।
তবে ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার ঘটনাটি তাৎক্ষনিকভাবে জানাজানি হয়নি। ঘটনাটি সেনা অফিসারদের কাছে পৌঁছে ৪ঠা নভেম্বর সকালের দিকে। ৩রা নভেম্বরের পরের কয়েকটি দিন কার্যকর দেখা যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের গণবাহিনীকে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন এই গণবাহিনী পরবর্তী অভ্যুত্থানে একটি মূল ভূমিকা পালন করে। এরাই ৭ নভেম্বর জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে। আবার ওইদিন সকালেই ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফ, কর্নেল কে এন হুদা এবং ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারকে। খালেদ মোশারফসহ এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কার নির্দেশে এবং কেন হত্যা করা হয়েছিল তার কোন সুনির্দিষ্ট তদন্ত হয়নি এবং সেই হত্যার কোন বিচারও এখনো পর্যন্ত হয়নি।
১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বর এই তিন হত্যাকাণ্ডের মধ্যবর্তী সময়ে দেশে নৈরাজ্য চলাকালে এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে সামনে না আসা পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে কী চলছিল- বিশ্লেষকরা নানা প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসতে চান। তাদের প্রথম প্রশ্ন ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিরোধের ডাক দিতে পারল না কেন? বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং চার জাতীয় নেতার হত্যার মধ্যবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী ও কমরেড মণি সিংহের মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা কী ছিল? সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব- যারা একসময় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, পরে তার রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ, তারা এই মধ্যবর্তী সময়টাতে কী করছিলেন?
চার জাতীয় নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিসংগ্রামের চার অধিনায়ক। তারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের আদর্শে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তার দৃঢ় অনুসারী। তাদের বাঁচিয়ে রাখলে তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আবার ঐক্যবদ্ধ হবে এবং জিয়া-মোশতাক চক্রের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবে, এই ভয় থেকেই ১৫ আগস্টের ঘাতকের দল ৩ নভেম্বরের কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এটাই তো স্বাভাবিক ধারণা। কিন্তু যে প্রশ্নটি সবার আগে সামনে চলে আসে, তা হলো, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনৈক্য ও ভুল কি এই হত্যাকাণ্ডে ঘাতক শক্তিকে সাহস জুগিয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আরো কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল আকস্মিকভাবে। কিন্তু চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল দীর্ঘ সময় কারাগারে রেখে। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, এই দীর্ঘ সময়ে তাদের রক্ষা করার জন্য দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি নিজেদের স্বার্থ-সুবিধা ও তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ভুলে কেন এক হতে পারল না? দেশে যে ফ্যাসিবাদ আসছে তা কেন বুঝতে পারল না? ঘাতকদের হাতে জেলে ঢোকার জন্য অবৈধ প্রেসিডেন্টের অবৈধ অনুমোদনপত্র তুলে দেয়া হয়েছিল কেন? এসব প্রশ্নের জবাব হয়তো ভবিষ্যতে খুঁজে বের করা হবে। লেখা হবে। আমরা কিছু ঘটনাক্রমে চোখ বুলিয়ে আসি।
জেলখানার ভেতর ৪৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর এই চার সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই রাতের বর্ণনা পাওয়া যায় তৎকালীন আইজি প্রিজনস ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্তব্যরত ডিআইজি প্রিজনের প্রতিবেদন থেকে। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর তারা এই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে জমা দিয়েছিলেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘১৫ আগস্টের পর জাতীয় চার নেতাসহ আরো অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে কেন্দ্রীয় কারাগারের রাখা হয়েছিল। নিউ জেলের পাশাপাশি তিনটি কক্ষে তাদের রাখা হয়। ১ নম্বর কক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আটজন বন্দী। ২ নম্বর কক্ষে ছিলেন এ এইচ কামারুজ্জামানসহ ১৩ জন। ৩ নম্বর কক্ষে ছিলেন এম মনসুর আলীসহ ২৬ জন। সেই রাতে ১ নম্বর কক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে রেখে বাকি ছয়জন বন্দীকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ২ নম্বর কক্ষ থেকে এ এইচ কামারুজ্জামান ও ৩ নম্বর কক্ষ থেকে এম মনসুর আলীকে ১ নম্বর কক্ষে নেয়া হয়। এই কক্ষেই তাদের চারজনকে ৩ নভেম্বর রাতের শেষ প্রহরে (মূলত ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ৪টা থেকে ৪:৩৫ টা) একসঙ্গে হত্যা করা হয়।’
প্রতিবেদনে ঘটনার বর্ণনায় তৎকালীন আইজি প্রিজনস উল্লেখ করেন, ‘… মেজর রশিদ আবার ফোন করে আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেল গেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ২. জনাব মনসুর আলী ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪. জনাব কামারুজ্জামান- এই ৪ জন বন্দীকে যেন তাকে দেখানো হয়।’
‘এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালো পোশাক পরা ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে পৌঁছান। ডিআইজি প্রিজনের অফিসকক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, বন্দীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে। আমি তাকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে ও ডিআইজি প্রিজন ফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম সেখানে পৌঁছেছেন কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দেই এবং তাকে বলি, কী ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন মেজর রশিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে ক্যাপ্টেনের বন্দীদের গুলি করার ইচ্ছার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন, সে যা বলছে তাই হবে। তখন আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরোল্লিখিত বন্দীদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতো লাগছিল এবং আমাদের কারও তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না।’ প্রতিবেদনে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘তার নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বোল্লিখিত ৪ জনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাদের শনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দীদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি এক নম্বর ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে।’
মূলত ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে নভেম্বর মাসের শুরু পর্যন্ত একাধিক কেন্দ্র থেকে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। প্রথমটি ছিল বঙ্গভবনকেন্দ্রিক, যেখানে খুনি সেনা অফিসারদের সেবাদাসে পরিণত হওয়া খন্দকার মোশতাক তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট খেলছিলেন। ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ চেষ্টা করেছিলেন সেনাবাহিনীর ভেঙে পড়া চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধারের। তার প্রচেষ্টার মধ্যে এক ধরনের পেশাদারি ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি জিয়ার চাতুর্যের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে একটি সেনা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়। অন্যদিকে জাসদের ভূমিকাও এ সময় পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে তার ‘রোমান্টিক বিপ্লবের’ মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খুনিচক্র উপলব্ধি করতে পেরেছিল পরিস্থিতি দ্রুত তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। যেহেতু তাদের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে খতম করে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করা। তাদের মনে হয়েছিল, এই জটিল পরিস্থিতিতে কোনো রকমে যদি খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনতে সক্ষম হন ও তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে পারেন, তাহলে হয়তো বন্দি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জেল থেকে মুক্ত হয়ে আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পুনর্বাসন করবেন। এতে নিশ্চিতভাবে তাদের বিপদ। জেলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বন্দি থাকলেও বঙ্গবন্ধুহীন দলের নেতৃত্ব দিতে পারতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারলে বঙ্গবন্ধুহীন আওয়ামী লীগকেও আবার ক্ষমতায় আনতে পারেন তারা। সে চিন্তাতেই খুনিরা ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে নিমর্মভাবে হত্যা করে, যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।’
এর পর আসে ৭ নভেম্বর। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) লিখেছেন, ‘১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর দেশের ভেতরে যে চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়, তা আরও ভয়াবহ রূপ নেয় ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা ক্যু ঘটার পর। এই ৩ নভেম্বর ভোরে খালেদ মোশাররফের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই খন্দকার মোশতাক ও বঙ্গভবনে অবস্থানরত খুনি মেজরদের হুকুমে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে জেলের ভেতরে হত্যা করা হয় চার জাতীয় নেতাকে। ওই সময়ে জেনারেল জিয়া খালেদ মোশাররফের অনুগতদের হাতে বন্দি। এই সুযোগে জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের (অব.) অতি বিপ্লবী আবেগে তাড়িত হয়ে ব্যাপকভিত্তিক প্রস্তুতি ছাড়া অস্থির হয়ে এবং অসংগঠিত অবস্থায় হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করার উদ্যোগ নেন। এর মাধ্যমে শুরু হয় ৭ নভেম্বরের পাল্টা ক্যু এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ড।’
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদারের মতে, ‘৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ছিল খুবই সংকীর্ণ এবং সেনাবাহিনীর তখনকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও রেষারেষির ফল। এর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ, নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কোনো কিছুরই সংশ্রব ছিল না। ফলে তা টেকসই হয়নি, বরং খালেদ মোশাররফ নিজের জীবন দিয়ে নিজের ভুলের খেসারত দিয়েছেন।’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ‘৭ নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমানের পেছনে যখন সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল তখন জাসদ ছিটকে গেল।’ কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘জাসদ তখন সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত ছিল না এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও জাসদকে সমর্থন দেয়নি।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘৬ নভেম্বরের মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসে একদল সৈন্য অস্ত্রাগারের কপাট খুলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সূচনা করে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। অনুঘটকের কাজটি করেছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘…৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় বসল জাসদের বিপ্লবী পার্টির ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা। হঠাৎ করেই সেখানে তাহের এসে উপস্থিত হন এবং ঢাকা সেনানিবাসে নিজ গৃহে অন্তরীণ জিয়ার হাতের লেখা একটা চিরকুট পড়ে শোনান। চিরকুটটা ইংরেজিতে। বাংলা তরজমা করলে তার অর্থ হবে-আমি বন্দি, নেতৃত্ব দিতে পারছি না। আমার লোকেরা তৈরি। তুমি যদি নেতৃত্ব দাও, আমার লোকেরা তোমার সঙ্গে যোগ দেবে।’
‘…রাত ১২টায় শুরু হয় অভ্যুত্থান। প্রথম প্রহরেই জিয়া মুক্ত হন। ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই জিয়া-তাহেরের সমীকরণ ভেঙে যায়। ভোরে বেতারের বুলেটিনে সবাই জানতে পারেন, সিপাহি বিপ্লব হয়েছে এবং জিয়া মুক্ত হয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক-লরি ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে। আমজনতা পথের পাশে দাঁড়িয়ে উল্লাস করে, হাততালি দেয় এবং অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো ট্যাংকে বা সেনাবাহিনীর ট্রাকে চড়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।’
‘…জিয়া-তাহেরের এই ‘বিপ্লব’ ছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। ৭ নভেম্বর সকালে বন্দি অবস্থায় খালেদ নিহত হলেন। তার সঙ্গে তার দুজন সহযোগী কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারও নিহত হন। এই তিনজনই ছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা।’ আসলে ক্ষমতার ত্রিভুজ লড়াইয়ে জিয়া-তাহেরের সম্মিলিত শক্তির কাছে খালেদ হেরে গিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে দেশ প্রবেশ করেছিল অন্ধকার গলির ভেতরে। সংঘাতহীন উন্নত শান্তিময় বাংলাদেশ চাইলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বরের কলঙ্ক ও অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে হবে। তাই রাষ্ট্রের স্বার্থে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জুয়েল সরকার পঁচাত্তরের রক্তাক্ত নভেম্বরের ষড়যন্ত্র উন্মোচন জরুরি মত-দ্বিমত