আ.লীগ-বিএনপির বাড়াবাড়ি, জাপা-জামায়াতের রসের হাঁড়ি
৪ নভেম্বর ২০২২ ২৩:০৮
বিএনপি ‘বাড়াবাড়ি’ করলে তাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে আবার জেলে পাঠিয়ে দেবেন বলে সাফ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জেলহত্যা দিবসের আলোচনায় হুঁশিয়ারিটি দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন কোন বিবেচনায়, খালেদা জিয়ার বোন ও ভাইয়ের আবেদনে মানবিক দয়া করে তার শাস্তি বন্ধ রেখে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই মানবতার বিপরীতে বিএনপি এখন সরকারকে ধমকায়। পালানোর পথ মিলবে না বলে প্রধানমন্ত্রীকে শাঁসায়। বিএনপির এই ‘বাড়াবাড়ি’ তিনি আর সহ্য না করার বার্তা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ বার্তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ব্যাখ্যার অংশে তিনি বিএনপিকে ‘বাড়াবাড়ি’ বারণ করে বলেছেন- প্রয়োজনে জেলে যাবেন, কিন্তু পালাবেন না। বিএনপিকে কঠিন পরিণতি ভোগের সতর্কতাও দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন- তারা নন, ‘বাড়াবাড়ি’ করছে সরকার। এ বাড়াবাড়ির প্রমাণ হিসেবে তিনি দাঁড় করিয়েছেন খালেদা জিয়াকে আবার জেলে পাঠানোর হুমকি, বিএনপির সমাবেশগুলোতে বাধা, পরিবহন মালিক- শ্রমিক সংগঠনগুলো দিয়ে ধর্মঘট করানোকে। বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির গণসমাবেশগুলোতে প্রতিবন্ধকতা মাঝেও সপ্তাহখানেক আগেও সরকারের তরফে আশ্বাস ছিল নির্বাচন পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে আর জেলে নেওয়া হবে না। আইনমন্ত্রীর এ বার্তাটির মাঝেই প্রকাশ্যে আদালত প্রাঙ্গনে খালেদা জিয়ার মামলা আদালতে নয়, রাজপথে সমাধান হবে, এমনকি আগামী নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন মর্মে রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়েছেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। ‘খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়া আগামী নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না’ হুমকিও দিয়েছেন এ আইনজীবী। কোনো আইনজীবীর আদালত অঙ্গনে এমন ধৃষ্টতা এক ধরনের তাড়না সরকারের জন্য। তারওপর পালাবার পথ না পাওয়ার আস্ফালন!
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর প্রধান ক্ষমতাহীন দল বিএনপির এ ‘বাড়াবাড়ি’ বাহাসের ফাঁকে সংসদ থেকে পদত্যাগের গর্জন দিয়ে ভ্যালু বাড়ানোর রিহার্সাল সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির। একেক সময় একেক কথা এবং ২০১৪-এর মতো লাস্ট রাউন্ডে ইউ টার্নে ক্ষমতার ভাগ নেয়ার কৌশলে সামনেও আশা দেখছে দলটি। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এরশাদের মতো বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও এ কাজে পারঙ্গম বলে বিশ্বাস তার ঘনিষ্টদের। তার স্টাইলে ভিন্নতা আছে, মার্জিত ইমেজও আছে। বড় ভাই এরশাদের মতো চোখের ওপর পল্টি দেন না তিনি। বেশ কিছুদিন ধরে গরম-গরম কথা বলছে জাতীয় পার্টি। বার বার শোনাচ্ছে ‘তারা সরকারের সঙ্গে নেই’। এরমধ্যেই সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকি দিয়ে একদিনের ব্যবধানেই আবার সংসদে ফিরে গেছে। রবিবার জানিয়েছিল, রওশন এরশাদের পরিবর্তে জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারের সিদ্ধান্ত চায়। এ দাবি না মানা পর্যন্ত আর সংসদে যাবে না। পরদিন সোমবারই সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে সদস্যদের নিয়ে অধিবেশনে গিয়ে হাজির হন জিএম কাদের।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির এ মহরতে জামায়াত কেন পিছিয়ে থাকবে? তারা এগোচ্ছে দলের নাম বদলের পুরনো খেলায়। এমনিতেই তারা মাঠ ছাড়া। তবে, রাজনীতিতে নিষিদ্ধ নয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনহীন। নাম পাল্টানো, নিষিদ্ধ হওয়া, পরে ফাঁকফোকরে সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার বিশেষজ্ঞ দল জামায়াত। এবার জামায়াত বা ইসলাম ধরনের শব্দ ব্যবহার না করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি-বিডিপি নামে নিবন্ধনের আবেদন করেছে ইসিতে। এর আগে, ২০২০ সালের ২ মে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের একটি গ্রুপ নিজেদের সংস্কারপন্থী ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করে ইংরেজি নাম এবি পার্টির (আমার বাংলাদেশ পার্টি) ব্যানারে। নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করা আছে এবি পার্টিরও। এবি পার্টি বা বিডিপির সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্বীকার করছে না জামায়াত। আবার বিডিপি-এবি নেতারাও জামায়াতের নাম মুখে নেয় না। যদিও দল দুটির প্রায় সব শীর্ষ নেতাই শিবির-জামায়াত সম্পৃক্ত।
জামায়াতের লুকোচুরির এ অভিজ্ঞতা কিন্তু বহু পুরোনো। পাকিস্তান আমলে মাওলানা মওদুদীর অভিভাবকত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামীয়া পার্কে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে জন্মের পর থেকেই। পাকিস্তানপন্থী এই দল এক সময় ভারতের মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতাও করেছে। আবার ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরোধীতা করেছে। বাষট্টিতে আইয়ুব খানের মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতাও করেছে। দু’বছর পর চৌষট্টির ৪ জানুয়ারি জামায়াতের রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। গ্রেফতার করা হয় মওদুদীসহ জামায়াতের ৬০ নেতাকে। এর মধ্যে ছিলেন গোলাম আযমও। ঐ বছর অক্টোবরেই আবার নিষেধাজ্ঞাটি ওঠে যায়। ওই জামায়াতই আইয়ুব খানের সামরিক আইন ঘোষণার সময় পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেয়। পঁয়ষট্টিতে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জোটেও যায়। দলটির এভাবে সময়ে-সময়ে, এদিকে-ওদিকে আগ বাড়ার ধারাবাহিকতা স্বাধীন বাংলাদেশেও।
একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকার জামায়াতকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করে। দলটির নেতারা তখন গা ঢাকা দেন। দেশও ছাড়েন কেউ কেউ। বিজয়ের আগেই পাকিস্তান চলে যান গোলাম আযমসহ কয়েকজন। বঙ্গবন্ধুর আমলে দালাল আইন প্রত্যাহার ও পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির পর সাতাত্তরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কথিত বহুদলীয় গণতন্ত্র জামায়াতকে মাহেন্দ্রক্ষণ এনে দেয়। ৭৯ এর সংসদ নির্বাচনে জামায়াত নাম লুকিয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ছদ্মাবরনে ৬টি আসনে জেতে। পরে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে গঠন হয় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ভারপ্রাপ্ত আমীর করা হয় আব্বাস আলী খানকে। আশির দশকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমান্তরালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে জামায়াত। ছিয়াশিতে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ১০ আসনে জিতে মিশে যায় সংসদীয় রাজনীতির স্রোতে। আবার ওই সংসদ থেকে আওয়ামী লীগের আগেই পদত্যাগ করে আন্দোলনের হিরোইজম দেখায়।
এরশাদ পতনের পর বিএনপির সঙ্গে নেপথ্য বোঝাপড়ায় একানব্বইর সংসদ নির্বাচনে ১৮ আসনে জিতে অবস্থান আরো পোক্ত হয় জামায়াতের। সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন জুগিয়ে দুটি সংরক্ষিত আসনও নেয়। এর বছরকয়েকের মাথায় অবস্থান নেয় বিএনপির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির সঙ্গে ত্রিদলীয় লিয়াঁজোতে বিএনপির বিরুদ্ধে মহাবিপ্লবী হয়ে যায়। অতি সাহসী হয়ে ছিয়ানব্বইতে একক নির্বাচনে সংসদে সিট নেমে আসে ৩টিতে। এরপর আওয়ামী লীগ বিরোধী হয়ে আবার মিত্রতা বিএনপির সঙ্গে। ২০০১ সালে রাখঢাক না রেখে বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে ১৭ সিটে জিতে দুই মন্ত্রীত্ব নিয়ে সরাসরি চলে আসে রাষ্ট্রক্ষমতায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষনেতাদের মৃত্যুদণ্ড, মাওলানা সাঈদীর যাবজ্জীবন, সাবেক আমির গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড জামায়াতের রাজনীতিতে সিডর বইয়ে দেয়। তারওপর ইসিতে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু, দলটি নিষিদ্ধ হয়নি। তাই এবার এখন পর্যন্ত সিদ্ধ হওয়ার ঝামেলা নেই। জামায়াত নামে ইসির নিবন্ধন মিলবে না নিশ্চিত হয়ে এখন রসের হাঁড়িতে ঢুকতে চায় বিডিপি বা এবি পার্টির আড়ালে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই