কবে হবে এমন বাংলাদেশ
৭ নভেম্বর ২০২২ ১৬:২৩
ছোটবেলা থেকেই বই পুস্তকে পড়ে আসছি সৌদি আরব হচ্ছে বেদুইনের জাতি, মরুভূমিতে বসবাসের জাতি। হাজার হাজার মাইলের পর মাইল কোনো পানি নেই। বৃষ্টিও নেই। নেই গাছপালা। আছে শুধু ধুধু বালুচর। আর এবার নতুন করে দেখলাম মক্কা আর মদীনায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। একই সাথে দেখলাম সড়ক আর সড়ক। যেদিকেই চোখ যায় শুধু সড়ক আর সড়ক। সড়কে জ্বলছে বাতি।
গত ১৫ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত সৌদি আরবের মক্কা, মদীনা, তায়েফ, রিয়াদ, আল কাসিম, হাইল ও জেদ্দা এলাকা সরেজমিনে ঘুরে সৌদি আরবের অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
সৌদি আরবের রাস্তা
সৌদি সরকার অভাবনীয় সাফল্য আনতে পেরেছে রাস্তা ঘাটের উন্নয়নে। ট্রাফিক সিস্টেমও হয়েছে ডিজিটাল। কোথাও কোনো যানজট নেই। নেই থামানো গাড়ি। কোনো গাড়ি উল্টোও যায় না। মাঝেমধ্যে সিগনাল পড়ছে সবাই তা মানছেও। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, একটি শহরের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা জরুরী। সড়ক ব্যবস্থা যেদেশের যত উন্নত সেই দেশ তত উন্নত। সৌদি আরবে ঘুরে দেখা যায়, সব জায়গায় শুধু রাস্তা আর রাস্তা। উন্নত আর কমপক্ষে চার লেনের রাস্তা। মক্কা, মদিনা আর রিয়াদে ছয়, আট, দশ এমনকি বার লেনের সড়কও রয়েছে। শহরের বাইরে কমপক্ষে চার লেনের রাস্তা রয়েছে। কোনো গাড়ি উল্টো যাবে না। এমনকি এক হাত দুরত্বও না। কেউ রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাতে পারবে না। পার্কিংও করতে পারবে না। সড়কে যে গতি সীমা দেওয়া আছে তাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
সড়কে নেই ট্রাফিক পুলিশ
হাজার হাজার কিলোমিটার চলাচল করলেও সড়কে কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। সবই চলছে অটো সিস্টেমে। রাস্তায় কিছুদুর পরপর ক্যামেরা স্থাপন করা আছে সেই ক্যামেরা অটো কাজ করছে। গাড়ির গতি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই ফ্ল্যাশ মারে ক্যামেরা। রং পার্কিং করলে বা উল্টো গেলেও ফ্ল্যাশ খেতে হয়। ফ্ল্যাশের কিছুক্ষণের মধ্যে চালকের মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ আসে জরিমানা কত হয়েছে। আরেকটি ম্যাসেজ চলে যায় চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের কাছে। কমপক্ষে শত কিলোমিটার পর একটি করে চেকপোস্ট রয়েছে। সেই চেক পোস্টে রাডারের মাধ্যমে অভিযুক্ত গাড়িকে আটকানো হচ্ছে। গাড়ি সাইডে নিয়ে কৈফিয়ত চাওয়া হচ্ছে।
মসৃণ সড়ক
পুরো সড়কে কোথাও কোনো বিট নেই। এক লেনের গাড়ি আরেক লেনে যাচ্ছে না। বড় গাড়ির জন্য লেন আলাদা। ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন এবং বেশি গতির গাড়ির জন্য লেন আলাদা। গাড়ি চলাচলের সময় মহাসড়কে কোনো সিগনাল নেই। তবে শহরে মাঝেমধ্যে সিগনাল (অটো সিগনাল) পড়লে নির্ধিদায় তা মানছে সবাই। অটো সিগনাল থাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আমরা মক্কা থেকে রিয়াদ প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পারি দিলাম মাত্র ৮ ঘণ্টায়। কোনোরকম ক্লান্তি ছাড়াই। মহাসড়কে যেখানে পেট্টোল পাম্প সেখানে উন্নতমানের মসজিদ, সাথে থ্রি ও ফাইফ স্টার মানের ওয়াশরুম, কফি শপ ও খাবার হোটেল ছিল। মহাসড়কে কোথাও যেহেতু থামার নির্দেশনা নেই এবং বাজারঘাটও নেই তাই সকলে পেট্টোল পাম্প স্টেশনেই বিরতি নেয়। প্রতিটি সড়ক, পাম্প স্টেশন ও মসজিদ কমপ্লেক্স এতটাই পরিস্কার যে কোথাও কেউ থুথুও ফেলেন না। হাতে ব্যবহার করা টিস্যু, বোতল ও অন্যান্য খালি প্যাকেট সবাই নির্দিষ্ট স্থানে ফেলছেন।
সড়কে চলাচলে নেই ক্লান্তি
শত শত কিলোমিটার এমনকি একদিনে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেও কোনো ক্লান্তি আসে না। সড়ক ও যোগাযোগ বিদদের মতে, যেসব সড়ক মসৃন বা উঁচু নিচু নয়, বিট (গতি রোধক) নেই, থামতে হয় না, সিগনাল নেই এমন সড়কে চলাচল করলে ক্লান্তি ভাব সহজে আসে না। আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে মাঝেমধ্যে ফ্রেস হওয়ার ব্যবস্থা থাকা, চা বা কফি খাওয়া, ওয়াশরুমে যাওয়া, হাত মুখ ধৌত করার ব্যবস্থা থাকলে সহজে ক্লান্তি আসে না। সৌদি আরবে ঠিক এমনটাই রাখা হয়েছে। যার কারণে হাজার কিলোমিটার পথ যেমন তাড়াতাড়ি পাড়ি দেওয়া যায় আবার কোনো ক্লান্তিও আসে না।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি-গাড়ি
সৌদি আরবের যেসব ছোট বড় ভবন রয়েছে তার প্রতিটিতেই এসি লাগানো রয়েছে। প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টাই এসি ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথাও ফ্যান চোখে পড়েনি। আমরা যেখানেই থেকেছি সেখানে অন্তত ফ্যান চোখে পড়েনি। যতক্ষণ রুমে অবস্থান করেছি সবসময় এসি চালানো হয়েছে। একটি সেকেন্ডের জন্যও বিদ্যুৎ যায়নি। চলার পথে যত মসজিদে নামাজ আদায় করেছি প্রত্যেকটিতেই এসি করা। পাশাপাশি প্রতিটি মসজিদে ফ্রিজ রয়েছে। সেই ফ্রিজে ফ্রি পানি (বোতল জাত) ও খেজুর রাখা আছে। যখন যার যেটি প্রয়োজন সেটি নিচ্ছেন।
অন্যদিকে সকল গাড়ি এসি করা। প্রাইভেট কার, ট্যাক্সি (ভাড়ায় চালিত) কিংবা বাস সবই এসি লাগানো। গাড়ির পেছনে কোনো বাম্পার লাগানো নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি গাড়ির পেছনে বাম্পার লাগানো রয়েছে।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে যখন এসব নিয়ম কানুন চোখে পড়ে তখন স্বাভাবিকভাবেই নিজের দেশকে এরকম অবস্থানে দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে জাগে আমার দেশটাও যদি এরকম হতো! সবাই যদি নিয়ম মানত! বিশেষ করে সড়কের শৃঙ্খলাটা যদি থাকত! এক্ষেত্রে কথা আছে, আমাদের তো কোনো নিয়মই নেই। কোথাও নিয়ম থাকলেও তা খাতা কলমে সীমাবদ্ধ। কবে হবে আমাদের অটো ট্রাফিক সিস্টেম! কবে বন্ধ হবে সড়কের জগা খিচুরি যানবাহনের চলাচল!
রিয়াদ থেকে মদিনায় যাওয়ার পথে বাংলাদেশি গাড়িচালক কথায় কথায় বলছিলেন, দেশে গেলে নিজের নামে থাকা গাড়িটা বিক্রি করে যেতে হয়। আবার সৌদিতে ফিরে আসলে নতুন করে নিজের নামে আনতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে গেলে গাড়িটা বিশ্বস্ত কারো নামে করে যাই। আবার ফিরে আসলে ওই ব্যক্তি আমার নামে করে দেয়। সৌদির সিস্টেম (গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন) এতটাই সহজ যে নিমিষেই কাজ হয়ে যায়। কোনো প্রকার ভোগান্তি নেই। কোনো ট্যাক্স নেই, আলাদা কোনো ফিও নেই। তাই যখন তখন নিয়ম মানা যায়।
এতক্ষণ যা লিখেছি তা নিয়ে হয়তো বাংলাদেশে বিতর্ক থাকতে পারে। বলা হতে পারে, বাংলাদেশের জিডিপি আর সৌদি আরবের জিডিপি এক নয়। সৌদি আরবের তেল খনি রয়েছে। পানির মতো তেল উঠছে। তা বিদেশে রফতানি করছে। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। তারা অনেক কিছু করতে পারেন। আমি বলব, আমাদেরও অনেক কিছু রয়েছে। আমাদেরও রাস্তা ঘাট এখন অনেক উন্নত হয়েছে। সেখানে শুধু সিস্টেম দাঁড় করানো দরকার। উদ্যোগের দরকার। সেই সিস্টেমেই সবাই চলবে। অফিসিয়ালি সিস্টেম করা দরকার। সেই সিস্টেমেই সবাই চলবে। মনে রাখা দরকার, সৌদি আরবে যেসব শ্রমিক বা লোক আইন মেনে চলছে তারা বাংলাদেশেরই নাগরিক। সুতরাং তারা সৌদিতে আইন মানলে বাংলাদেশে কেন মানবে না। বাংলাদেশেও আইন বা সিস্টেম মেনে চলবে তবে তার আগে সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি