জামায়াতের নিবন্ধনের কৌশল, নতুন বোতলে পুরনো মদ
১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৫:০৮
গত ২৬ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে একটি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। প্রায় একশটি দল আবেদন করলেও এই একটি দল নিয়ে ব্যাপক হইচই শুরু হয়েছে। কারণ নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতারাই পরোক্ষভাবে বিডিপি দলটি গঠনের সাথে জড়িত।
দলটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চান ও জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে স্বাক্ষর করেছে কাজী নিজামুল হক। আনোয়ারুল ইসলাম একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল করতো পরবর্তীতে কিছুদিন বিএনপি করার পর আইন পেশায় গিয়ে জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির মজলিশে শুরা কমিটির সদস্য। অন্যদিকে নিজামুল হক ছাত্রশিবির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আবেদনের সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির যে ১৫ সদস্যের তালিকা দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই জামায়াত কিংবা শিবিরের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিল কিংবা আছে।
২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম বারের মতো রাজনৈতিক দল গুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সেসময় ৩৮ টি দলকে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও একটি। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে জামায়াতের নিবন্ধনকে চ্যালেঞ্জ করে তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টি, সম্মিলিত ইসলামী জোটের নেতারা একত্রিত হয়ে হাইকোর্টে একটি রীট আবেদন করে। তাতে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে শর্ত পূরণ না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে পারে না। রীটের প্রেক্ষিতে জারি করা রুলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১লা আগস্ট ২০১৩ জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে। যার ফলে জামায়াতের নির্বাচনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। আদালতে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণায় জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রতীকে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দলীয় ভাবে অংশগ্রহণ নিতে পারেনি।
নতুন নামে দল করার চেষ্টা জামায়াতের নতুন নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবিধানিক ভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতের রাজনীতিও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আবার চালু হয়। তারপরই জামায়াত প্রথমে মাওলানা আবদুর রহিমের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক নামে একটি দল গঠন করে। দলটি ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ছয়টি আসনে জয়লাভ করে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর বহুদলীয় গনতন্ত্রের আড়ালে জামায়াতকে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনে। প্রথমে গোলাম আজম নেপথ্যে থেকে আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির করে জামায়াত নিজ নামে রাজনীতিতে ফিরে আসে। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালেই গোলাম আজম জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব নেন।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালে আসন তিনটিতে নেমে আসলেও ২০০১ সালে বিএনপির সাথে নির্বাচনী জোট করে ১৭টি আসন পায় এবং জোট সরকারের মন্ত্রী সভায়ও গুরুত্বপূর্ণ দুইটি মন্ত্রীত্ব লাভ করে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুইটি আসন লাভ করে। তারপর থেকে দলীয় পরিচয়ে আর কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে নি।
নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর বলেছেন,বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সব শর্ত পূরণ করলে ভিন্ন নামে নিবন্ধন পেতে পারে। এখন যদি কোনো নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে এবং তাদের সনদ আমাদের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাদের মধ্যে কোনো যুদ্ধাপরাধী না থাকে এবং অন্য সব শর্ত পূরণ করে, তাহলে আপনি কাউকে জামায়াতের লোক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবেন না। তবে এখন জামায়াতে ইসলামী হিসেবে কোনো দলের নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ নেই। আইনগত ভাবে নির্বাচন কমিশনার হয়তো সঠিক কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিই করে ধর্মকে পুঁজি করে। সেখানে তাদের আদর্শ থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি আতঙ্কের নাম জামায়াত-শিবির। হত্যা, নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন, আগুন সন্ত্রাস সহ বিভিন্ন সহিংসতার জন্য তারা নানা ভাবে সমালোচিত। বাংলাদেশের জন্মের সূচনা থেকে ধারাবাহিক ভাবেই তারা এসব করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তার করতে জামায়াত ও তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির তৈরি করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে সংগঠন। সেসময় তারা সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাত করে। যা যুদ্ধাপরাধ মামলায় আদালতের রায়ে বারবার উঠে এসেছে। যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে দলটি ঘৃণিত। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের জন্য সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জামায়াত শিবির একটি আতঙ্ক।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকরের পর জামায়াত কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়লেও আন্ডারগ্রাউন্ডে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বিডিপি দল গঠন প্রকৃয়া তাদের সেই কার্যক্রমের ফসল। বিডিপি নির্বাচন কমিশনে আবেদনের জন্য পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র জমা দিয়েছে।এটা পাগলেও বিশ্বাস করবেনা যে, যাদের কোন অস্তিত্ব নেই, তাদের (বিডিপি) পক্ষে এত নথি পত্র দেয়া সম্ভব?
এই দলটি একদিনে তৈরি হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জামায়াত নতুন কৌশল নেয়। দলকে সংগঠিত করতে ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শূরা মজলিসের বৈঠকে নতুন দল গঠনের সিন্ধান্ত হয়। এবং বৈঠকে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে আরো সিন্ধান্ত হয়, আপাতত তারা রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকবে। মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশের মতো কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাবেনা। শুধু দল গোছানোর কাজে মনোযোগ দিবে দলটি। এটি যে জামায়াতে ইসলামীর নতুন দল তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
জামায়াতে ইসলাম রাজনীতিতে টিকে থাকতে নতুন কৌশল নিয়েছে। আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে এ ছক এঁকেছে। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিতদের নিয়ে দল গঠন করছে। দল নিবন্ধিত হয়ে গেলে সবাই একে একে নতুন দলে যোগ দিবে। জামায়াত আর বাংলাদেশে ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এক কথায় বলা যায়, এটি জামায়াতের আরেকটি মোড়ক। নতুন বোতলে পুরনো মদ!
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জামায়াতের নিবন্ধনের কৌশল: নতুন বোতলে পুরনো মদ! তাপস হালদার মত-দ্বিমত