সের্গেই ল্যাভরভের ঢাকা সফর
১৯ নভেম্বর ২০২২ ১৩:৩০
দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন রাশিয়ার পররাস্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। সাম্প্রতিক বছরগুলোত রাশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের কোন মন্ত্রীর এটিই প্রথম সফর। তিনি আসছেন ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোট আইওআরএ – এর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে। ইউক্রেন-রশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শীর্ষ পর্যায়ের কোন রুশ মন্ত্রীর ঢাকায় এই সফরের বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। রাশিয়ার দিক থেকে একটি হচ্ছে, মস্কো বার্তা দিতে চায় যে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। দ্বিতীয়টি বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাশিয়া নিশ্চয়ই চাইবে বাংলাদেশ থাকুক তাদের পাশে। আর বাংলাদেশের দিক থেকে প্রচেষ্টা থাকবে ইউক্রেন -রাশিয়ার যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান, মনোভাব ব্যাখ্যা করে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন এর বিরুপ প্রভাব না পরে সে ব্যপারটি নিশ্চিত করা। অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছু সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা।
ল্যাভরভের সফরের দিকে চোখ থাকবে পশ্চিমাদেশগুলোর। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পশ্চিমা শক্তিগুলো চাইছে বাংলাদেশ তাদের পক্ষে থাকুক। এজন্য তাদের নানা ধরণের উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। সে চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত না রাশিয়া, না পশ্চিমা জোট সরাসরি কারোর পক্ষ নেয়নি। জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচবারের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ দুইবার রাশিয়ার পক্ষে, দুবার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং একবার ভোটদানে বিরত ছিল। ফলে রুশ পররাস্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের দিকে পশ্চিমা জোটের গভীর নজর থাকবে।
অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, প্লাটফর্ম, প্রতিষ্ঠানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রাশিয়া। দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের অবস্থান। রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলতে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত আছে। এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়া বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে চাইছে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য,আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দিকে নজর তাদের। বাংলাদেশকেও তারা তাদের পাশেই চায়। ঢাকা সফরে সে চেষ্টাই থাকবে ল্যাভরভের।
রাশিয়া বাংলাদেশের পরিক্ষীত সুহ্রদ। দু:সময়ের বন্ধু। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে রাশিয়ার খুবই ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্ঠায় তিন তিনবার ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। তা না হলে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন বিলম্বিত হতো। ফিলিস্তিনের মতো দীর্ঘকালীন অনিশ্চয়তায় পড়তো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গপোসাগরের দিকে এগিয়ে আসছিলো। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া তাদের নৌবহর পাঠালে যুক্তরাস্ট্রের উদ্দেশ্য ভেস্তে যায় । স্বাধীনতার পর আমদানি-রপ্তানির কোন কার্যক্রমই চালানো যাচ্ছিলনা। কারণ ডুবে যাওয়া ৪০টি জাহাজ আর পাকিস্তানীদের পেতে রাখা অসংখ্য মাইনের জন্য অকেজো ছিল চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। এই বন্দর মাইন মুক্ত করা ছিল ব্যয়বহুল,জটিল এবং ঝুঁকিপুর্ণ কাজ। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েও পান নি। রাশিয়া নিজে থেকেই এগিয়ে আসে। ভাইস এডমিরাল সের্গেই জুয়েনকোর নেতৃত্বে রাশিয়ার নৌ বাহিনীর ২৪ টি কারিগরী জাহাজ ও এক হাজার নৌসেনার ২ বছরের চেষ্টায় মাইন মুক্ত হয় চট্টগ্রাম বন্দর। শহীদ হন ২২ বছর বয়সী রুশ নৌসেনা ইউরি ভিক্তোরভিচ রেদকিন। অত্যন্ত জটিল, ঝুঁকিপুর্ণ এবং ব্যয়বহুল এই কাজের জন্য রাশিয়া একটি টাকাও নেয়নি।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের পুর্নগঠনেও ছিল রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশের বিদ্যুতের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হতো রাশিয়ার নির্মাণ করে দেয়া সিদ্ধিরগঞ্জ ঘোড়াশাল বিদ্যুত কেন্দ্রে। রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ যখন কোন দেশকে পাচ্ছিল না তখন অর্থায়ন সহ এই কেন্দ্র নির্মাণে এগিয়ে আসে রাশিয়া। আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও সহায়তা দিতে তারা আগ্রহী।
মুক্তিযুদ্ধকালিন সময় থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং সহযোগিতামূলক। বাংলাদেশ সব সময়ই এটি মনে রাখে। ল্যাভরভের এই সফরে সেটি আরো ঝালাই হতে পারে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে রাশিয়া নিজেই যখন উদ্যোগী তখন বাংলাদেশ নিজেদের কিছু স্বার্থের ব্যাপারে দেনদরবার করতে পারে। বৈশ্বয়িক ও আঞ্চলিক নানা বিষয়েই আলোচনা হবে। তবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই আলাদাভাবে জোর দিবে মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ে। চীন ও রাশিয়া উদ্যোগী হলে রোহিঙ্গা সমস্যাটির সমাধান হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিকজান্তার প্রধান আন্তর্জাতিক মুরুব্বী রাশিয়া ও চীন। আর্ন্জাতিক অঙ্গনে এই দুই দেশের সমর্থন এবং তাদের কাছ থেকে কেনা অস্ত্রশস্ত্রে বলিয়ান হয়েই মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিপীড়ন চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কোন সায়ই দিচ্ছে না।
লুহানেস্ক এবং দনিয়েস্কে রুশদের উপর জাতিগত নিপীড়ণের যে আভিযোগে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ঠিক সে রকমেরই ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও। একই ধরণের জাতিগত নিপীড়ণের ঘটনায় রাশিয়ার দুই ধরণের ভূমিকার ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চয়ই কথা বলবে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রাশিয়ার সহায়তা চাইবে। ল্যাভরভের এই সফর থেকেই স্পষ্ঠ হবে রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে তারা কতটুকু সহায়তা করবে।
জ্বালানি এবং বাণিজ্য নিয়েও নিশ্চয়ই ।আলোচনা হবে। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অনেকদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশের আগ্রহ আছে আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। রাশিয়া এরই মধ্যে জানিয়েছে তারা এ ক্ষেত্রেও সহায়তা দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে কাজ করছে রাশিয়ার সরকারি সংস্থা গ্যাসপ্রম। সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারেও রাশিয়ার সহায়তা চাইতে পারে।
জ্বালানি সহায়তার ক্ষেত্রে রাশিয়ার তেল হতে পারে দুই দেশের জন্য নতুন ক্ষেত্র । রাশিয়ার বিপুল তেলের ক্রেতা ছিল ইউরোপ। কিন্তু ইউক্রেনে আক্রমণের পর ইউরোপে তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ। এখন রাশিয়ার নতুন রাপ্তানি অঞ্চল এশিয়া। এ বছর রাশিয়ার সিংহভাগ তেল কিনেছে ভারত, চীন,সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, তুরস্ক এবং শ্রীলংকা। চীন, ভারতকে ভর্তুকি দামে তেল দিয়েছে রাশিয়া। শ্রীলংকাকে দিয়েছে ডেফার্ড পেমেন্টে ( বিলম্বিত দাম পরিশোধে)। রাশিয়ার তেল পেয়ে শ্রীলংকা সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ সৌদি আরবের কাছে ডেফার্ড পেমেন্টে তেল দেয়ার অনুরোধ করেছে। রাশিয়ার কাছ থেকেও এ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। পাওয়া যেতে পারে ভারতের মতোই ভর্তুকি মূল্যে। কিন্তু বাংলাদেশে রাশিয়ার তেল পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই। সৌদি আরব ও কুয়েত বাংলাদেশে তাদের তেলের জন্য পরিশোধনাগার তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়াকেও তাদের তেল পরিশোধনের জন্য বাংলাদেশে শোধনাগার তৈরির কথা বলতে পারে বাংলদেশ। এতে তেল আমদানির নতুন দীর্ঘকালিন উৎস পাওয়া যাবে। ইউরোপের সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বোধহয় খুবই কম। সে ক্ষেত্রে এশিয়ার তেল ক্রেতাদের দিকেই নজর থাকবে রাশিয়ার। বাংলাদেশ এ সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে।
তৈরি পোষাকের বড় একটি বাজার রয়েছে রাশিয়ায়। বাংলাদেশের তৈরি পোষাকের সুনাম সম্পর্কে রাশানরা জানে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এতদিন বাংলাদেশের পোষাক গেছে রাশিয়ার বাজারে। এখন সরাসরি এ বাজার ধরার চেষ্টা করতে পারে বাংলাদেশ। রাশিয়ায় ওষুধের বড় বাজার রয়েছে। ভারত প্রচুর ওষুধ রপ্তানি করে রাশিয়ায়। বাংলাদেশের ওষুধের ব্যাপারে রাশান আমদানিকারকদের প্রবল আগ্রহ রয়েছে। ভিন্ন পথে বাংলাদেশ থেকে কিছু ওষুধ য়ায় রাশিয়াতে ।
ইউরোপের সঙ্গে রুশদের সম্পর্কের অবনতির কারণে অন্য অঞ্চলের রপ্তানিকারকদের জন্য রাশিয়ার হোম আ্যাপ্লায়েন্সের মার্কেটে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারত এ সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশও ফ্রিজ, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, ইস্ত্রি, ওভেন, ব্লেন্ডার ইত্যাদি হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য নিয়ে রাশান বাজারে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। রাশিয়ায় রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাংকিংয়ের যে সমস্যা রয়েছে তা দুর করতে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা আরো জোরদার করা দরকার। ল্যাভরভের সফরের মধ্য দিয়ে এসব ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুলে যেতে পারে।
অনেকেই হয়তো বলবেন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সময় এসব বিষয়ে আলোচনার অর্থহীন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে কোন সম্পর্ক করতে গেলেই পশ্চিমা জোটের চাপের মুখে পড়তে হবে । তা ঠিক। তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যাপারে ছাড়ও পাওয়া যেতে পারে। যেমন পেয়েছে ভারত, শ্রীলংকা। তাছাড়া এ যুদ্ধ একদিন থামবে। তখন রাশিয়ার সঙ্গে অন্য দেশের আমদানি-রপ্তানি সচল হবে। কিন্তু এখন থেকেই তৎপর না হলে তখন আর ভালো সুযোগ পাওয়া যাবেনা। ভারত, ভিয়েতনাম, তুরস্ক যেভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে ওরাই তখন রাশিয়ার বাজারের অধিকাংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নিবে।
সের্গেই ল্যাভরভের সফরে রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ , আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, নিজেদের আন্তর্জাতিক অবস্থান, পারস্পরিক সমর্থন, ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দিয়েই এসব বিষয়ে কথা বলবে। রাশিয়া চাইবে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও সমর্থন। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা , জ্বালানি তেল,গ্যাস উত্তোলন, রাশিয়ার বাজারে গার্মেন্টস, ওষুধ, হোম অ্যপ্লায়েনস ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ব্যাপারে রাশিয়ার সহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা করা দরকার বাংলাদেশের।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি