গণমাধ্যমকে মুক্তপথের সন্ধান রাষ্ট্রকেই দিতে হবে
৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:২১
কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের ওয়ব পেইজের অপিনিয়ন অংশে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। একটি জরিপের ভিত্তিতে এতে বলা হয়েছে, সংবাদের শিরোনাম আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি নেতিবাচক। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭টি মাধ্যমের ২৩ মিলিয়ন শিরোনাম জরিপ করে প্লস ওয়ানের এই জরিপে বলা হয়েছে ২০০০ সাল থেকে এই নেতিবাচক শিরোনাম বেশি বেশি করে দৃশ্যমান হচ্ছে।
এমন একটা ধারণা বাংলাদেশেও আছে। যারা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর থাকেন, তারা অভিযোগ করেন যে সাংবাদিকদের চোখে ভালো কোন খবর চোখে পড়েনা, শুধু নেতিবাচক খবর দেখেন। খারাপ সংবাদই ভাল সংবাদ, এটাই যেন সাংবাদিকতার রীতি। আসলেও তাই। প্রশ্ন হলো, সবকিছু ইতিবাচক হলে, ঠিকঠাক মতো চললে সেটা খবর হবে কেন? যারা অভিযোগ করছেন, তারা ভুলে যান যে, ভালো কিছু করার জন্যই তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং সেটা খবর না। যখন এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই খবর জন্ম নেয়।
গণমাধ্যমের পক্ষে খারাপ খবরের চেয়ে ভাল খবর দেয়াটাই আসলে কঠিন। দুর্ঘটনা, দাঙ্গা, মহামারি, বন্যা, যুদ্ধ, গণমৃত্যু ইত্যাদি ভয়ঙ্কর তথ্যেই সাংবাদিকের বিচরণ। তবে সাংবাদিককে লিখতে বা বলতে হয় সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে।
সারাবাংলা বাংলা ডট নেট আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। একটা স্বল্প সময়ের জন্য আমিও এর সাথে জড়িয়ে ছিলাম। সেই জায়গা থেকেই বলছি, যেকোন মাধ্যমের জন্য সময়টা এখন বেশি চ্যালেঞ্জিং। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন গণমাধ্যম ও এর কর্মীদের লড়াইটা অনেক বিস্তৃত হয়ে পড়ে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং তার যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল সেখানে কতটা এগুতে পারছে দেশ সেটাই এ যুগের একটি আধুনিক অনলাইনের সম্পাদকীয় নীতি হতে হবে। সমাজে অপ্রীতিকর সংঘাত আছে, দ্বন্দ্ব আছে এবং সেখানেই লুকায়িত আছে। এই পোর্টালটি কতটা মানুষের কথা বলতে পারছে আর কতটা মালিক ও শাসকের মুখপত্র হয়ে উঠছে, সে বিবেচনা করতে হবে নিজেকেই। এটি শুধু নিরপেক্ষতার প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন ন্যায্যতার। একটি অনলাইন বানিজ্যিকভাবে কতটা সফল তার চেয়ে বড় বিষয় সে কতটা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে পেরেছে, সাধারণের মাধ্যম হয়ে উঠতে পেরেছে।
সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে অকুতোভয় সাংবাদিকতার নজির চায় মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটি কঠিন। একটি বিদ্বেষ ও বিভাজিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পাঠকের সামনে ভয়হীন সৃজনশীলতা নিয়ে উপস্থিত হওয়া সহজ কাজ নয়।
যেহেতু সবকিছু এখন দৃশ্যমান, তাই গণমাধ্যমকেও মানুষের কাছে নিয়মিত মূল্যায়িত হতে হয়। কোন মাধ্যম কতটা সত্য প্রকাশ করছে, কতটা ন্যায্য আচরণ করছে সেটা প্রকাশিত। মানুষ সাংবাদিকদের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমস্যা হলো মানুষ যা চায় সেটি সাংবাদিকরা দিতে পারছে না। প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থায় মানুষের ভাবনা নেই, রাজনৈতিক সংস্কৃতি অত্যন্ত নিম্নমানের। সাংস্কৃতিক অবক্ষয় চলছে, চলছে সাম্প্রদায়িকতা জোয়ার। শিক্ষা ব্যবস্থা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এবং এসব কারণেই সাংবাদিকতাও ঠিক পথে নেই। মানুষকে নির্মোহভাবে সত্য তথ্যের সেবা দেয়া এই সমাজে খুব বেশি সম্ভব নয়। কত কাহিনী চেপে যেতে হয়, তা সে সরকারেরই হোক, বেসরকারি হোক বা বিজ্ঞাপন দাতাদের হোক বা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হোক – সেটা সাংবাদিকরা ভালো করেই জানেন।
নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা, নিয়মিত আক্রমণ আর সীমিত আইনগত সুরক্ষা – এটাই আজকের বাংলাদেশের গণমাধ্যম বাস্তবতা। অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে চাকরির অনিশ্চয়তার সঙ্গে এদেশের সাংবাদিকদের কাজ করতে হয় ভয় আর আতংককে সঙ্গী করে। কাজ করতে হয় মালিক আর শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করে। রাজনীতির কারবারি আর সুশীলদের দিক থেকেও নেই সহযোগিতার হাত। নির্ভয়ে, নির্মোহভাবে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করার মুক্ত পরিবেশ ক্রমেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। সাংবাদিকতার পেশায় ঝুঁকি যত বাড়ছে তত নেমে যাচ্ছে সংবাদের মান। রাজনৈতিক বিভাজন আর মালিকদের স্বার্থে সেলফ সেন্সরশিপই এখন সাংবাদিকতা।
গণমাধ্যমকে যদি সমাজের দর্পণ বলা হয়, তাহলে তাকে মুক্তপথের সন্ধান রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজকে বুঝতে হবে সংবাদ মাধ্যম হল গণতন্ত্রের শক্তি ও রক্ষাকবচ। শক্তিশালী গণতন্ত্রের স্বার্থেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার সঙ্গে আপস না করে কাজ করবেন পেশাদারীত্বের সাথে, সেটাই হোক সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চাওয়া। রাষ্ট্র ও সমাজ নিশ্চয়ই সেটাই চাইবে। সারাবাংলাকে শুভেচ্ছা।
লেখক: প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা, গ্লোবাল টেলিভিশন
গণমাধ্যমকে মুক্তপথের সন্ধান রাষ্ট্রকেই দিতে হবে মত-দ্বিমত সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা