নারীর সত্যিকার জাগরণে বেগম রোকেয়ার আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে হবে
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:২২
৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। নারী মুক্তির কথা ভাবতে গেলে যে মহিয়সী নারীর কথা প্রথমেই আমাদের সবার মনে পড়ে। তিনি হলেন বেগম রোকেয়া। যার পূর্ণ নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। যিনি ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও উপলব্ধি করেছিলেন নারীর জীবনের শৃঙ্খল মুক্তির কথা। তিনি শুধু নারী হিসেবে চিন্তা করেছিলেন না, তিনি মানুষ হিসেবে একটি দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নারীর মুক্তি প্রয়োজন, সেটি যৌক্তিকভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের নিগুঢ় উপলব্ধি থেকে নারী জাতির অবনতির নানা দিক পর্যালোচনা করে নারী জাতির মুক্তির জন্য জীবনভর নানা বই, প্রবন্ধ, কথা লিখে গেছেন। নারীর মুক্তি প্রসঙ্গে যে বইগুলো তিনি রচনা করেছেন তার বিভিন্ন উদ্ধৃতি প্রসঙ্গের প্রেক্ষাপটগুলো এখনো যেন বেশ প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তার লেখাগুলো পর্যালোচনা করলে আমার কাছে একটি বিষয় প্রতিয়মান হয়, নারীর জীবনের এই শৃঙ্খল মুক্তির জন্য অন্তরায় হিসেবে সমাজের বদ্ধমূল ধারণা, কুসংস্কার, প্রথাগত সামাজিক নিয়ম, সর্বোপরি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার একটা প্রভাব রয়েছে বলে তিনি তার নানা প্রমাণ ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন নানা লেখায়। পাশাপাশি তিনি এও চিহ্নিত করেছেন যে নারী জাতির মুক্তির জন্য স্বয়ং নারী জাতিকেই তাঁর নিজ জীবন দর্শন ও উপলব্ধি সম্পর্কে পরিষ্কার হতে হবে। নিজের সীমাবদ্ধ জীবন দর্শনকে পরিবর্তন করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে আমরা যদি নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন এবং জেন্ডার সমতার কথা ভাবি তাহলে দেখতে পাই চারপাশে জেন্ডার সমতা কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প সুদীর্ঘকাল ধরে চলমান রয়েছে কিংবা দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার পাশাপাশি আমরা যদি দেশের চলমান ঘটনাগুলোকে একটু সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে, তার প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত ফলাফল যেকোন বিবেকবান মানুষকেই একটু বিষন্ন করবে, কিংবা চিন্তিত হওয়াটাও স্বাভাবিক বিষয় মনে করি।
আমাদের সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ চলছে কিন্তু আমরা এত উদ্যোগ আর বর্ণাঢ্য কার্যক্রমের ভিড়েও নারীর প্রতি সহিংসতা যেন থেমে নেই বরং নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো দিন দিন আরও বৈচিত্র্যময় হচ্ছে। বর্তমান সময়ে অনলাইন ও জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলো দিন দিন নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। অনলাইনে আপত্তিকর ও অবমাননাকর মন্তব্য নারীর জীবনেকে অসহনীয় করে তুলছে। যার দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই আত্মহননের মতো পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের মাঝে কিছু অব্যক্ত প্রশ্নের উদয় হয়, সেটি হলো তাহলে আমাদের এতো প্রচেষ্টা আর উদ্যোগগুলো কোথায় প্রতিফলিত হচ্ছে? এই যে দেশব্যাপী নানা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেখানে হাজারো মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে, সেগুলো কি মানুষের মনোজগতে কোন ধরণের ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারছে না? নাকি আমাদেরকে কর্মকান্ড বাস্তবায়নে কোন ঘাটতি আছে? নাকি সাম্প্রতিককালে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে মানুষের মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে আমাদের কর্মপন্থাগুলো যুগোপযোগী কিনা? এ প্রশ্নগুলো আমরা অনেকেই ভাবি না, গতানুগতিক কাজ করার জন্য সবাই কাজ করছে, সবাই জীবিকার তাগিদে দৌড়াচ্ছে। এগুলো পর্যালোচনা করা দরকার। এমনকি নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা মানুষেরও উপলব্ধির জায়গায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করি। চিন্তা করতে হবে গৃহিত পদক্ষেপটি আসলে নারীর মনোজগতকে কিভাবে পরিবর্তন করবে কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বা প্রতিকারে কিভাবে ভূমিকা রাখবে। সেটি বিশ্লেষণ করা খুব জরুরী। না হলে, গতানুগতিক কাজের সুফল পাওয়া খুব কষ্টকর হবে।
বেগম রোকেয়া’র ‘অর্ধাঙ্গী’ লেখায় তিনি ধর্মীয় নানা প্রেক্ষাপটকেও নারীর মুক্তির পথে অন্তরায় হিসেবে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন নানা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটকে, যেখানে নারীর দাসত্বকে টিকিয়ে রাখার উদাহরণগুলো সুক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করেছেন। তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, চিরাচরিত বিশ্বাস আর সংস্কৃতির কারণে অনেক নারীরা জীবনের প্রচলিত এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে চান না। তারা চান না চলে আসা দীর্ঘদিনের শৃঙ্খলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন পট পরিবর্তন করার। নিষ্ক্রিয় থেকেই জীবনে দামি গহনা, অন্ন, দামী বস্ত্র আর বিলাসিতার জীবনকেই প্রকৃত জীবন হিসেবে ভেবে থাকেন। কিন্তু বেগম রোকেয়া নারীর জীবনের যে প্রকৃত চেতনা থাকা প্রয়োজন, সেটিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতগুলো কিভাবে নারীর জীবনকে শাসন করছে, কিভাবে নারীর জীবনকে বিকলাঙ্গ করছে, তিনি জীবনের এই বাস্তব চিত্রগুলো আমাদের সামনে তাঁর নানান লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। নারীসহ মানুষের মুক্তচিন্তার জন্য কিছু প্রশ্ন রেখে গেছেন। যেখানে চিন্তার উদ্রেক তৈরির মাধ্যমে নারী তার আসল মুক্তির পথ অন্বেষণ করতে পারবে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নারীদের নিজেদের অচেতন ও নিম্ন মানসিকতা নিয়ে আক্ষেপের সুরে নারী হয়েই নারীর উদ্দেশ্য নারীর অধঃপতন থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। তিনি এই জগৎ সংসার থেকে বিদায় নিয়েছেন ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। আমাদের মাঝে তিনি নেই বহুবছর। কিন্তু বাংলাদেশ ও নারী জাগরণের প্রশ্নে বেগম রোকেয়া এতো বছর পরও আমাদের মাঝে খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি যে প্রশ্নগুলো আমাদের মাঝে রেখে গেছেন, নারীর মুক্তির জন্য সে প্রশ্নের উত্তরগুলো খোঁজা খুব জরুরী। কারণ তিনি যে প্রশ্নগুলো রেখে গেছেন সেগুলো যৌক্তিকভাবে যদি কোন মানুষ ও নারী সেগুলোর উত্তর খুঁজতে পারেন, তাহলে তিনি নিজ অধঃপতনের দিকগুলো উন্নতি চেষ্টা করতে পারবেন, ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ নামে তিনি যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তার বদলে সত্যিকার অর্থেই তখন নারী জাতির মুক্তি ঘটবে বলে বিশ্বাস করি।
বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন, ৯ ডিসেম্বর, “রোকেয়া দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। আমার বিশ্বাস, নারী জাতির মুক্তির লক্ষ্যে বেগম রোকেয়াকে চর্চা করার বিকল্প নেই। কারণ তিনি নারীর জীবনের দাসত্বের শৃঙ্খল মেনে নিয়ে একটি সুন্দর শৃঙ্খলিত জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং তিনি নির্দিষ্ট শাসনের বলয়ের মাঝে থেকেও নারী মুক্তির জন্য নিজের জীবনের উপলব্ধিগুলোকে ব্যক্ত করেছেন নানা ভাবে। সংগ্রাম করেছেন। সমাজে বিরাজমান তৎকালীন কঠোর নিয়মের মাঝেও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে নিজের কন্ঠকে উচ্চকিত করেছেন। সেই সাথে নারীর জীবনের প্রতি ধর্মীয় যে অপব্যাখ্যা ও বৈষম্যমূলক রীতিনীতি বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। রোকেয়া দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বৈষম্যহীন ও সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বেগম রোকেয়ার জীবনাদর্শ ও নারী শিক্ষার প্রসারে তার অবদান আমাদের নারী সমাজের অগ্রযাত্রায় এক অন্তহীন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’ আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত। তবে নতুন প্রজন্মের মাঝে বেগম রোকেয়ার বাণী ও চেতনাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। সেগুলো চর্চা ও অধ্যয়ন করতে হবে। অন্তনির্হিত ভাব অনুধাবন ও অন্বেষণ করতে হবে। সেগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে। তবেই বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টা ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। নারী খুঁজে পাবে মুক্তির প্রকৃত পথ।
লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক
সারাবাংলা/এজেডএস