রক্তের আখরে লেখা এ বিজয়
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:৫১
‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, জেগেছে বাঙালি জেগেছে – জয় বাংলা।’
সত্যিই আমরা বিজয়ী। বাঙালি বিজয়ের জাতি। দেশ হয়েছে স্বাধীন। এমনি এক চিরন্তন জিজ্ঞাসায় গেলো বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও পালন করেছি। অর্ধশতবর্ষ অতিক্রম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় প্রজন্ম তরুণদের আড়ালে চলে যাচ্ছে পাকিস্তানি আমলের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃতি।
আমরা বাঙালিরা ২৪ বছরের পাকিস্তানি পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙেছি একাত্তরের ডিসেম্বরে। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছি মহান বিজয়।
তাতে বদলে যায় বিশ্বমানচিত্র। উদিত হয় রক্তের আকরে লেখা সবুজ জমিনে আঁকা বিশ্বমানচিত্রে বিশ্বচিত্রিত একটি নাম- বাংলাদেশ। একটি শব্দ, কয়েকটি বর্ণমালা। পেয়েছি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভৌগোলিক সীমানা। এর জন্য আমাদের দিতে হয়েছে চড়া মূল্য।
স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাক দেন যিনি, তিনি হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নেতৃত্বে ছিল তাঁরই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আর তত্ত্বাবধানে ছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন ঘর ছাড়ে। আপনজন ফেলে গিয়েছিল পাক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে; বুলেট হয়ে, মুক্তির নেশায়। স্যালুট দেই সেইসব বীর বাঙালি শহিদদের, যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের আজকের স্বাধীকার চেতনায় সমৃদ্ধ নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে লাখো-কোটি সালাম সেইসব অগ্রপথিকদের, যাঁরা আমাদের দিয়ে গেছেন এমন একটি গৌরবের উপলক্ষ।
কিন্তু শঙ্কা জাগে মনে! একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত প্রেতাত্মা না আবার উগ্র জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আছরে প্রাণ ফিরে পায়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায়, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, সমভ্রম হারিয়েছেন ৩ লাখ মা-বোন; আর লাখ লাখ লোক হয়েছেন বাস্তুচ্যুত। উদ্বাস্তু হয় কোটি লোক। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা শুধু ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাই ঘটায়নি তারা; ধ্বংস করেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে শিল্পকারখানাসহ মূল্যবান সব স্থাপনা। আর জনপদ পরিণত করেছে শশ্মানে।
কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা যখন নিশ্চিত বুঝে যায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই অর্থাৎ দেশটি শিগগির স্বাধীন হতে চলেছে; ঠিক তখনই তারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, জামায়াত ও তাদের সহযোগীদের সহায়তায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে শত শত বুদ্ধিজীবীদের; যারা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সেই মহান শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসই পালিত হয়ে গেছে গত ১৪ ডিসেম্বর। এতকিছুর পরও কিন্তু পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক ও বাঙালির প্রস্তুতি
দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যমন্ডিত সমৃদ্ধ বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি সুগভীর অনুরাগ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতাভিত্তিক বৈষম্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, আমলাতান্ত্রিক জিম্মি থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছা ইত্যাদি সব কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী।
সমগ্র পাকিস্তানে এক ব্যক্তির এক ভোটের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরও দেয়া হয়নি বাঙালিদের শাসন করতে। বরং উল্টো বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইতিহাতের জঘন্যতম গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে। এমনি অগ্নিগর্ভ বাংলায় সেদিন সমগ্র জাতি একই মোহনায় মিলিত হয় শত-শতাব্দীর ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে। তিনি ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এর আরও আগে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মহাসমুদ্রে উচ্চকিত তর্জনির বজ্র নির্ঘোষে জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই মহাসরণীয় রাষ্ট্রনায়কোচিত ও কর্তৃত্বব্যঞ্জন ভাষণ, যা গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতাকে টপকে এটি এখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠভাষণ হিসেবে স্বীকৃত।
বঙ্গবন্ধু তার নাতিদীর্ঘ ভাষণে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা, অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবিলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোনো উসকানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পরামর্শের পর ঘোষণা করেন- ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে …এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম – জয় বাংলা।’
মূলত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
২৫ মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পোষ্য টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল খাদিমের অপারেশন ‘সার্চলাইট’-এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীর রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে পাকিসেনাদের হাতে বন্দি হবার আগে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সই করে যান। তা রাতের প্রথম প্রহরে পাঠান বলদা গার্ডেনে স্থাপিত ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। এতে তিনি বলেন, ‘এটাই তার শেষ নির্দেশ- যুদ্ধ চালিয়ে যাও। যুদ্ধ চলবে বাংলার মাটি থেকে একজন শত্রু নির্মূলের আগ পর্যন্ত।’
এ ঘোষণা চট্টগ্রামে পৌঁছে ওয়্যারলেসে। অপারেটররা এ ঘোষণা পৌঁছে দেন এমআর সিদ্দিকীর স্ত্রী কোহিনূর এবং জহুর আহমেদ চৌধুরীর স্ত্রী নূরুন্নাহার জহুরের কাছে। পরে বেতার ঘোষণা পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পরদিন ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে ফের ঘোষণাটি পাঠ করানো হয় জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে।
স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা নিষ্পন্ন বিষয়; যা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত তথ্য।
তাছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত দলিলপত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ব্রিটেনের বিদেশ মন্ত্রকের অনেক গোপনীয় নথি ও প্রামাণ্য তথ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত তথ্য-প্রমাণের উল্লেখ রয়েছে।
অন্যদিকে ৩ মার্চ ঢাকার পল্টনে ছাত্রলীগের আহূত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেয়া হয় জাতীয় পতাকা ও স্বাধীনতার ইশতেহার – ‘জয় বাংলা’।
এ সভায় ঘোষিত হয় ১০টি সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হচ্ছে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালি জাতির পিতা’।
মুক্তির সনদ ও ধ্বনি
পাক সরকারি নির্যাতন-নিষ্পেষণ যতই বাড়তে থাকে, ততই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬ দফা কর্মসূচি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচি সংযুক্তিতে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে নতুন মাত্রা পায়। এতে আন্দোলন দমনে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র (১৯৬৮ খ্রি.) বলিরপাঁঠা বানানোর পদক্ষেপ নিলে বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির চেতনায় আসে গণজোয়ার। শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় নয়, বাঙালি সংস্কৃতির একটি সংগ্রামী চরিত্রও দানা বাঁধে। সেদিন আমাদের অন্যকোন পরিচয় ছিল না, ছিলাম বাঙালি। আমাদের অন্যকোন লক্ষ্য ছিল না, গন্তব্য ছিল একটাই – স্বাধীনতা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশেষক্ষেত্রে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। আর তা হলো- আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল, টেলিভিশনের প্রারম্ভিক সুর মূর্ছনা দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান – ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা’ এবং ‘জয় বাংলা’ নেহায়েত ‘জিন্দাবাদ’ এর সমার্থক বা প্রতিশব্দ নয়; এটি হচ্ছে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির ধ্বনি।
‘বাংলাদেশ’ তার নাম
১৯৭০ সালের জুন মাসে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে তোলা ‘জয় বাংলা বাহিনী’র নেতা আ স ম আব্দুর রবের হাতে বঙ্গবন্ধু তুলে দেন যে পতাকাটি, সেটিই পরবর্তীতে চিহ্নিত হয় জাতীয় পতাকা হিসেবে এবং ৩ মার্চ ঘোষিত হয় ‘পতাকা দিবস’ হিসেবে।
ইতোমধ্যে যে জাতির উত্থান ঘটেছে, সেটি বাঙালি জাতি। এর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন এ দেশটির নাম কী হবে তা আগেই ঠিক করা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভা লাখো জনতার উপস্থিতিতে ইশতেহারে ঘোষণা করেন, স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ ঘোষণা করা হয়েছে (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক, সংবাদ ৪ মার্চ ১৯৭১ খ্রি.)।
তাছাড়া ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি ঘোষণা করেছিলেন- দেশটি যদি স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সংগীত হবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক ৪ জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রি.)।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ: দুটি নাম একটি ইতিহাস
বস্তুত একজন রাজনৈতিক নেতার গোটা জীবন সংগ্রাম যখন একটি দেশের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে অভিন্নভাবে জড়িয়ে যায় এবং সেই সংগ্রামের পরিণতিতে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে, তখন দেশ ও নেতার নাম একীভূত হয়ে পড়ে। একটি থেকে অন্যটিকে ভিন্ন করে দেখার সুযোগ থাকে না। বিশ্বের বহু দেশেই নেতার নামের সঙ্গে দেশের নাম জড়িত হয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। তদ্রুপ বাংলাদেশ তেমনি একটি দেশ, যার নামের সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম জড়িত একাট্টা হয়ে। তিনিই জাতির জনক। যেমনভাবে এসেছে ভিয়েতনামের হোচিমিন, চীনের মাও সেতুং, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, যুগোশ্চাভিয়ায় মার্শাল টিটো, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন, মিসরের নাসের, ভারতে মহাত্মা গান্ধী ও পাকিস্তানে জিন্নাহর নাম।
উল্লখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রতিবিপ্লবী ও স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের একটি ক্ষুদ্র চক্র বিশ্বনন্দিত নেতা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যাতে বাঙালি জাতি বিশ্বদরবারে রাজনৈতিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তজ্জন্য আন্তর্জাতিক মদতে সাবভারশন বা নাশকতা চালানো হয়; যা থেমে নেই আজও। শেখ হাসিনার ওপর উপর্যুপরি প্রাণনাশের চেষ্টা সেই সংকেত দেয়।
হ্যান্ডশেকে নয়, রক্তে কেনা এ বিজয়
বিজয় দিবস বিশ্বের বুকে বাঙালির একটি অহঙ্কারের নাম। বিশ্বের প্রতিটি জাতির জীবনে কিছু দিন আছে- যা সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতির মানুষের কাছে উপস্থিত হয় অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে। যেসব দিনের স্মৃতি তাদের সব সময় উজ্জীবিত করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে প্রেরণা দেয়, শক্তি জোগায় দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। যেমন- ফ্রান্সের বাস্তিল কারাগারের পতন দিবস ১৪ জুলাই (১৭৮৯ খ্রি.), রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হওয়ার দিবস ৭ নভেম্বর (১৯১৭ খ্রি.)।
ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১ খ্রি.) একটি পরম গৌরবের, আনন্দের, অবিসরণীয় ও অনন্য সাধারণ দিন। এছাড়া ২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস। এরকম দিবস দিবস আছে সব দেশেরই। কিন্তু শতকরা ৯৫ ভাগ দেশেরই বিজয় দিবস নেই, আছে বাংলাদেশের। জিন্নাহ্ আর মহাত্মা গান্ধী মানচিত্র কেটে ব্রিটিশের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে স্বাধীনতার সনদ নিয়েছেন। সেই সুযোগ ছিল না আমাদের। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। আমাদের এই অর্জিত স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে বুকের তপ্ত রক্ত ভিজিয়ে।
বিজয়ের ঋণপত্র
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৫১ বছর হলেও আসলে সুসংঘবদ্ধ সমাজ হিসেবে আমাদের বয়স সাড়ে ৪ হাজার বছরের ওপরে। পরাধীন একটি জাতি, যাদের ইতিহাস হচ্ছে অবহেলা, বঞ্চনা আর শোষণের। এর কবর রচনা করে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে নিজস্ব সত্তা নিয়ে ও স্বাধীনভাবে মাথা উঁচিয়ে বেঁচে থাকতে ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি রাষ্ট্র্র দিয়ে গেছেন যে বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনি অন্যকেউ নন- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কাছে বাঙালি জাতির শত-শতাব্দীর ঋণপত্র পরিশোধের নয়। দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্তি হতো না বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এবং তাঁর দু’বার মৃত্যুর রুজু ও যৌবনের ১৪টি বছর কারাগারের প্রহসন মাড়িয়ে আপসহীন নেতৃত্ব না পেলে।
পাদটীকা
আমাদের নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই শহিদদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি তারা সম্মান করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। আর ঘৃণা করবে সাম্প্রদায়িক আত্মপ্রবঞ্চকদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারও যেদিন প্রজাতন্ত্রকে সম্মান করবে, সেদিন উচ্চস্বরে বলা যাবে আমরা স্বাধীন, বিজয়ী ও মুক্তিকামী।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক; সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি