পাকিস্তান জন্মলগ্নেই স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর রুদ্ধদ্বার বৈঠক
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:১১
১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ শাসনাধীন শোষণ-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে শেখ মুজিবও পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ছাত্রনেতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। যতীন্দ্র ভাটনগর কর্তৃক ১৯৭১ সালে ভারত থেকে রচিত ‘‘Mujib: The Architect Of Bangla Desh: A Political Biography’ শীর্ষক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ওই সময়ের রাজনীতি সম্পর্কে বলেন, ‘He (Sheikh Mujib) was active Muslim student leader, and had personally campaigned for Pakistan. But his concept of Pakistan was entirely different from that of Jinnah, Liaquat Ali and others.’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত ভাগের অনুমোদনের পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩রা জুন ১৯৪৭ তা ঘোষণা করে। এ সময় শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের স্বাধীনতা বাঙালীর ওপর নতুন ধরনের শাসন ও শোষণ চাপিয়ে দিবে। কারণ তিনি মুসলিম লীগ নেতাদের বুর্জোয়া চরিত্র অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর ভাবী পাকিস্তানের নানাবিধ সমস্যার কথা আলোচিত হয়। সাথে সাথে রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেই প্রশ্নটিও গণমাধ্যমে ও রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান পায়। তরুন নেতা শেখ মুজিবকেও বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে। ড. মাযহারুল ইসলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ শীর্ষক জীবনীগ্রন্থে বলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত বুঝতে পেরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ‘সিরাজদ্দৌলা হলে’ ছাত্র ও যুব-নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদার কক্ষে মিলিত হন শেখ মুজিব। তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করেন। তিনি তাদের বিশ্লেষণ করে বোঝান যে মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করলেও জনগণ চায় অর্থনৈতিক মুক্তি। এই মুক্তি আনতেই হবে। উক্ত সভায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব বলেন: “স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে যেতে হবে, কেননা, আমার আশংকা হচ্ছে, এ স্বাধীনতা সত্যিকার স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। মুসলীম লীগের বুর্জোয়া মনোবৃত্তি ও পশ্চিমা প্রাধান্য থেকে আমার এই আশংকা হচ্ছে।” এসব কথা একান্ত সাক্ষাৎকারে বন্ধুবৎসল্য লেখক ড. মাযহারুল ইসলামকে বলেন বঙ্গবন্ধু। উল্লেখ্য যে, উক্ত বৈঠকে শেখ মুজিবের সহপাঠী কে.জি মোস্তফা অন্যান্যদর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রজীবনেই শেখ মুজিব দূরদর্শীসম্পন্ন নেতা তা তার ওই উক্তির মাধ্যমেই অনুধাবন করা যায়।
যতীন্দ্র ভাটনগর ‘Mujib: The Architect Of Bangla Desh: A Political Biography’ গ্রন্থে বলেন ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তানের জন্ম হলে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে আনন্দ উৎসব পালিত হয়, কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের ঘরে দিনটি তেমনভাবে পালিত হয়নি। যতীন্দ্র ভাটনগর আরো বলেন পাকিস্তানের ইতিহাস শুরু হয় অদম্য মুজিবের নেতৃত্বে একদল যুবকের মোহভঙ্গের মধ্য দিয়ে।
পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর মুসলিম লীগ দুই ভাগ হয়। এক ভাগ ভারতবর্ষে হলো ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ ও আরেক ভাগ হলো ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ পাকিস্তানের গর্ভনর নিযুক্ত হন। খাজা নাজিমুদ্দিন হন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন শেখ মুজিব। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তিও হন তিনি। ড. মাযহারুল ইসলাম বলেন অল্পদিনের মধ্যেই স্বাধীনতাকামী যুবকদের নিয়ে শেখ মুজিব ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক লীগ’ গঠন করেন। পরে ক্ষমতাসীনদের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বিপরীতে ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করেন তিনি।
মুসলিম লীগ সরকার প্রথম আঘাত হানে বাংলা ভাষার ওপর। বঙ্গবন্ধু দেশভাগের পরপরই যুব সম্মেলনে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। এছাড়া ভাষার দাবিসহ ২১-দফায় স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু। তমুদ্দন মজলিসের কর্মসূচি নিস্ক্রয় হয়ে পড়লে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি তমুদ্দন মজলিসের কর্মসূচিতেও যোগ দিতেন। তাঁর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশনা এবং ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে ধর্মঘটে সরাসরি নেতৃত্বদান ও গ্রেফতার ভাষা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ভাষা দাবি দিবস ও ধর্মঘট পালন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় নেতা ভাষাসংগ্রামী কামরুজ্জামান লিখেছেন- ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের নির্দেশ দেন ১৪৪ ধারা জারি করলে তা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আইন পরিষদ ঘেরাও করতে।’ ধারাবাহিকভাবে মুসলিম লীগ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ১৯৫৬ সালে বাংলাভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্জন করতেও বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম।
একদিনের ঘোষণায় বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টিলগ্নেই বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ভাষা আন্দোলন ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন-এর দাবিতে দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম-আন্দোলন করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে আজকের এই দিনে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। এজন্যই তিনি জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী।
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রিয় কমিটি
সারাবাংলা/পিটিএম/এএসজি
পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর রুদ্ধদার বৈঠক মত-দ্বিমত মাহামুদুল হক