Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় ৪র্থ শিল্পবিপ্লব: সমৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা

ড. এ. কে. এম. জাকির হোসেন
১৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:১৭

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কারের পথ ধরে সভ্যতা একধাপ থেকে অন্যধাপে প্রবেশ করেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে পরিবর্তনের প্রবাহ বিদ্যমান। তিনটি শিল্প বিপ্লবে ভর করে মানবতা এখন স্মার্ট টেকনোলজি বা ডিজিটাল বিপ্লবে উপনীত। বলা যায়, বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ইতিহাসই সমাজসভ্যতা বিকশিত হওয়ার ইতিহাস তথা শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস। শিল্প-কারখানাসমূহে অটোমেশন বা আংক্রিয় ব্যবস্থায় স্ব জনবলে দ্রুতগতিতে পণ্য উৎপাদন ও তথ্যপ্রযুক্তির ধারণা ব্যবহার করে কিভাবে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা পর্যায়ে সহজে পরিষেবা নিশ্চিত করা যায় সে ধারণা থেকে জার্মানিতে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণাগত সূত্রপাত হয়।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাগ্রে ১৯৭২ সালে দেশের বিশাল জনরাশিকে জনসম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়ে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনকে একটি নব্য স্বাধীন দেশের জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির ওপর জাতীয় দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষার জন্য শিক্ষা নয় বা আজ্ঞাবহ কেরানি তৈরির জন্যও শিক্ষা নয়। আমি চাই আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষা ব্যবস্থা।” বিশ্বের অন্য কোন নেতা এত স্বল্প শব্দে স্বদেশের শিক্ষানীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন কি না সেটি জানা যায়নি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন অবশ্যই অনন্য ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকালীনও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন সমভাবে প্রযোজ্য। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মূল শ্রোতধারার শিক্ষায় রূপান্তরের লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ন্যূনতম ৫০ ভাগে উন্নীতকরণের অগ্রাধিকার দিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছে। বিষয়টি জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।

বিজ্ঞাপন

দুনিয়ায় ঘটে চলেছে অভাবিত সব অটোমেশন, দূর নিয়ন্ত্রিত কিংবা স্মার্ট ফোন ও স্মার্ট ডিভাইস-কেন্দ্রিক সহজিয়া ব্যবস্থাপনা। এত সব উৎপাদন সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতির বিপরীতে আমাদের কৃষি, শিল্প, বিপণন ও পরিবহন ব্যবস্থা, শ্রমবাজার পিছিয়েই আছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যা রোবোটিক প্রযুক্তির সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তার নির্ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিকে বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে প্রসারিত করবে এবং স্মার্ট পর্যবেক্ষণের মধ্যে ফসলে নিখুঁত উৎপাদন কৌশলকে অনেক সহজ করে তুলবে। এ প্রযুক্তিটি সামান্য মানবিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের ডেটা থেকে রিয়েল-টাইম তথ্য পুনরুদ্ধার করে ফসল ব্যবস্থাপনাকে অনেক সহজ করে দেবে। যা মানুষের পক্ষে করা অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে গ্রহণ করার জন্য সেন্সর IoT নেটওয়ার্ক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং বড় তথ্যভাণ্ডার (Big Data) একত্র করে বিশ্লেষণপূর্বক নির্ভুলভাবে তা কৃষিতে প্রয়োগ করা হবে। ফলে কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যম হিসেবে প্রিসিশন এগ্রিকালচার (Precision Agriculture) নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, কৃষি আবহাওয়ার তথ্য, ফসলে আগাম রোগ পোকামাকড়ের উপস্থিতি নির্ণয় করা, মাটির পিএইচ, পুষ্টিগুণ ও আর্দ্রতা পরিমাপ করা, ফসলের পরিপক্কতার সময় নির্ণয় এবং ফসলের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ, স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা এবং ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন আলু চেইন প্ল্যাটফর্মের সকলের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সহায়তা করা সম্ভব হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গতি, পরিসর এবং গভীরতা ঠিক কীভাবে বিকশিত করা উচিত, তা নিয়ে বিশ্বের দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ জরুরি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় জনগোষ্ঠীকে যেসব দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন, তার প্রায় পুরোটাই নির্ভর করবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। শিক্ষাক্রম হলো নিজস্ব আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক চাহিদার আলোকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সুনির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত ও পূর্ণাঙ্গ একটি পথনির্দেশ। আগামী দিনের সৃজনশীল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সমস্যা সমাধানে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার দিকনির্দেশনাও থাকে শিক্ষাক্রমে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী প্রত্যাশিত শিক্ষাক্রম এবং কৃষির রুপান্তরে গবেষণা কেমন হওয়া উচিত, তা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে পাঠ্যবইকেন্দ্রিক শিক্ষাক্রম চিন্তা থেকে বের হয়ে কর্মনির্ভর, দক্ষতাভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলোকে কৃষির রূপান্তরের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহন করতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জনে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মানে আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সেন্সর IoT নেটওয়ার্ক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AJ), বড় তথ্যভাণ্ডার (Big Data), আই এটি (IoT) ও স্মার্ট এগ্রিকালচার, ডেটা বিশ্লেষণ ও ক্লাউড কম্পিউটিং, রোবোটিকস ইন এগ্রিকালচার, ড্রোন এগ্রিকালচার ভিত্তিক কৃষি বিষয়ক সাবজেক্ট উচ্চশিক্ষায় ও গবেষনায় অন্তর্ভুক্তিকরণ অত্যন্ত জরুরি।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এইসব প্রযুক্তি এমন একটি স্মার্ট কৃষি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা তৈরি করবে, যা পরিবেশকে সমুন্নত রেখে উন্নত করে তুলবে ফসলের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশল এবং কৃষিতে আনবে টেকসই পরিবর্তন। নতুন প্রযুক্তিগুলোর কাজ কীভাবে মানবিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করবে, জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ সমুন্নত রাখবে এবং রাষ্ট্রে, সমাজে ও ব্যবসায়ে মানবিকতা, দেশে দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের সহনশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি নতুন মূল্যবোধ তৈরি করবে, তার পর্যালোচনাও চলছে বিশ্বজুড়ে। এমনকি মানুষ হওয়ার অর্থ ভবিষ্যতে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে; সে বিষয়ে বোঝাপড়াও দরকার। এ অবস্থায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিককেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য বাংলাদেশ সরকার, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সবাইকে কাজ করতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৌশল ব্যবহার করে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্থানীয় সমস্যার সমাধান, জীবন ও পরিবেশের উন্নতি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের সকলকে একসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষা একদিকে যেমন মানুষের অধিকার, তেমনি অন্যদিকে তা এক সামাজিক পুঁজি। এ মানব পুঁজির যথাযথ প্রযুক্তিনির্ভর বিকাশ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে তার সম্পৃক্তি দেশের সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গতি সঞ্চারিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নপুরণ ও ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের পর্যায় পেরিয়ে শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী ও উন্নত জনপদ ।

লেখক: ভাইস-চ্যান্সেলর, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় ৪র্থ শিল্পবিপ্লব: সমৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা ড. এ. কে. এম. জাকির হোসেন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর