গুজবের ডামাডোলেও দেশে আছে অনেক সুসংবাদ
২১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:৫৩
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে ‘দেশ গেল, দেশ গেল’ করে গুজবের ডালপালা মেলানো হচ্ছে বেশ কিছুদিন থেকে। গুজবে বলা হচ্ছে, ‘দেশে টাকা নেই, খাদ্য নেই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেই’ ইত্যাদি। দলটির পক্ষ থেকে যেন দেশে-বিদেশে এক গুজব সেল গঠন করা হয়েছে। আর এই গুজবের আগুনে তুষ ছিটাচ্ছে জামায়াতসহ অন্যন্য সমমনা দলগুলো। বিএনপি-জামায়েতের এই গুজবের কারণে দেশের মানুষ বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে যে সেটি বোঝা যায়। এমনিতেই করোনা অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যায় এতটাই বেড়েছে যার কারণে মানুষ একপ্রকার দিশেহারা এবং সংক্ষুব্ধও। সংক্ষুব্ধতাটা সরকারের উপরই গিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে আবার গুজবের ডামাডোল!
এ কথা সত্য সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও চলমান সঙ্কট খানিকটা আছড়ে পেড়েছে। তবে যতটা গুজব ছড়ানো হচ্ছে তার ১০০ ভাগের ১০ ভাগও সত্য নয়। পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি অনেকটাই ভাল। আশপাশের সার্কভুক্ত দেশগুলোর দিকেও যদি তাকানো যায় তাহলেও দেখা যাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো। বাংলাদেশ পরিস্থিতি আরও ভালো হত যদি সরকার পরিচালনাকারী দলে দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী হানা না দিত। সরকারী দলের নাম ভাঙিয়ে পাহাড়সম দুর্নীতির পাহাড়টাকে ভাঙা যেত। গত ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। প্রচুর সাফল্য এবং অর্জন আছে। কিন্তু সেই সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এই দুবৃত্তপনা ও দুর্নীতি। নিশ্চয়ই আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ দুবৃত্তপনা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিবে। একই সাথে গুজবের বিপরীতে সরকারী দলের তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। আশা করব এ ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের মনে আশা জাগাবে।
গুজব এমন পর্যায়ে যে বিএনপি জামায়াতপন্থী মানুষের সাথে কথা বলে মনে হয় যেন আওয়ামী লীগের সময় ফুরিয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতায় আসা সময়ের ব্যাপর মাত্র। গত ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের সাথে এক প্রকার স্ট্যান্টবাজি করা হল। বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলা শুরু করেছিল, ১০ ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। বিএনপি জামায়াতের নিয়োগপ্রাপ্ত পেইড অনলাইন গুজবকারীরা বিদেশে বসে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইনে সমানে গুজব ছড়িয়ে গেছে।
কদিন আগে এক ভিডিওতে দেখলাম যাতে বলা হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে বিমান টিকিট সঙ্কট দেখা দিয়েছে গত নভেম্বর থেকে। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা নাকি দেশ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত! এসব কথাবার্তা শুনি আর মনে মনে হাসি। কী এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে যে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে? খালেদা জিয়া কে? হ্যাঁ তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এখন তিনি দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তার কথায় কেন দেশ চলবে? আর দেশে কী এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে যে আওয়ামী লীগ নেতারা দেশ ত্যাগ করবে? বরং এসব গুজবকারীই নানা বিতর্কিত কর্ম করে বিদেশে পালাতক থেকে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। দেশত্যাগ করতে পারে দুর্নীতিবাজরা আর এসব অনলাইন গুজবকারী যারা এখনও দেশে বসে কাজটি করছে। বিদেশে বসে অনলাইনে গুজব সৃষ্টিকারীরা ভাবে বাংলাদেশ বুঝি আফগানিস্তান হয়ে গেছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের আফগান পরিস্থিতির ভয় দেখায় বাংলাদেশকে। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশের বাস্তবতা যে ভিন্ন, বিদেশে বসে সেই খবর তারা রাখলেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে আতঙ্কিত করতে চায়।
এ কথা সত্য যে দেশে কয়েক মাস ধরেই দুশ্চিন্তার বড় বিষয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সেটিকে আরও উসকে দিচ্ছিল প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান এ দুটি উৎস থেকে টানা দুই মাস (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) আয় কমেছে। সুখবর হলো, সদ্য বিদায়ী নভেম্বর মাসে প্রবাসী আয় কিছুটা বেড়েছে। অন্যদিকে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে গত নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা চলতি বছরের ১১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। গত বছরের নভেম্বরে রপ্তানি হয়েছিল ৪০৪ কোটি ডলারের পণ্য। রপ্তানির সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সূত্র মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের পোশাকের মূল বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পোশাক বিক্রিতে ধস নামে। তাতে রপ্তানির ক্রয়াদেশ আসাও কমে যায়। তবে ক্রয়াদেশ আবার আসতে শুরু করেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসীদের পাঠানো আয়ও নভেম্বরে কিছুটা বেড়েছে। নভেম্বরে প্রবাসীরা বৈধ পথে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছরের নভেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। সেই হিসাবে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মাসে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
আমাদের খাদ্য উৎপাদনেও সুসংবাদ রয়েছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে এ বছর। শুধু তাই নয় এবার শীতকালীন সবজিরও বাম্পার ফলন হয়েছে সারা দেশে। এখন প্রয়োজন সিণ্ডিকেট পেরিয়ে কৃষক যাতে ন্যায্য দাম পায় সেই ব্যবস্থা করা। সেই সাথে ব্যাপকভাবে সবজি নষ্ট হয় প্রতিবছর। নষ্ট যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে উব্দৃত সবজি ব্যাপকভাবে বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। আশপাশের দেশের কথা বাদ দেই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে বিদ্যুতের জন্য এখনও হাহাকার আর অন্ধকারে নিমজ্জিত সেখানে আমাদের দেশে নভেম্বর মাস থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। সামনে আরও উন্নতির আশা করা হচ্ছে। সেদিন বাজারে গিয়ে দেখলাম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমেছে। যে ডিমের ডজন ১৫০-১৬০ টাকায় উঠেছিল এখন তা ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের দাম বেশ কমেছে। গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৬০০-৬৫০ এ নেমেছে। তবে এখনও অসংখ্য পণ্যের দাম ১০০% বর্ধিতই রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার এবং দেশিয় সিণ্ডিকেট এর জন্য দায়ি। আন্তর্জাতিক বাজারকে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু দেশীয় সিণ্ডিকেট আমরা চাইলে ভাঙতে পারি। দেশের মানুষের স্বার্থে সেটি ভাঙতেই হবে।
নিন্দুকেরা যাই বলাবলি করুক না কেন সামগ্রিকভাবে খাদ্য নিয়ে বলতে চাই বাংলাদেশে কখনোই খাদ্য ঘাটতি হবে না। প্রধান খাদ্যপণ্য চালের চাহিদা বছরে সাড়ে তিন থেকে পৌনে চার কোটি টন। সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। এই সময়ে চালের মোট মোট ব্যবহার ছিল ৩ কোটি ৬৫ লাখ টন। সে অনুযায়ী গত বছর চালের ঘাটতি ছিল মাত্র সাড়ে ছয় লাখ টন। চলতি অর্থ বছর আরও বেশি উৎপদনের আশা করা যাচ্ছে। চাল উৎপাদনে আমরা বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও রপ্তানি করতে পারি না কিন্তু নিজেদের চাহিদা নিজেরাই প্রায় পুরোটাই মিটাতে পারি। সামান্য কয়েক লাখ টন আমদানি করতে হয়। এফএওর তথ্যমতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। নিজেদের সবজির চাহিদা মিটিয়ে আমরা রপ্তানিও করতে পারি। আরেকটি শর্করা জাতীয় খাদ্য আলু উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে তা রপ্তানি করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত অর্থবছরে দেশে ১ কোটি টনের বেশি উন্নতমানের আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেশে পণ্যটির চাহিদা ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম।
আমিষের প্রধান উৎস মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান এবং চাষকৃত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আমরা মাছ রপ্তানি করি। দেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং ডিম উৎপাদনে স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নাম লিখিয়েছে। নিত্য নতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। ২০ বছর আগেও আম আর কাঁঠাল ছিল এই দেশের প্রধান ফল। বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং পেঁপেতে ১৪তম স্থানে রয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত নানা বৈচিত্রময় ফল উৎপাদিত হচ্ছে। যা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছি আমরা।
তবে বেশকিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনে আমরা খাকিটা পিছিয়ে আছি। যেসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডাল, ভোজ্যতেল, দুধ, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০-২১ লাখ টন। এর বিপরীতে দেশে তেলজাতীয় শস্য থেকে ভোজ্যতেল পাওয়া যায় ৪ থেকে ৫ লাখ টন। ফলে ঘাটতি থাকছে ১৪-১৫ লাখ টন। দেশে বছরে ডালের ২৫-২৬ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ৮-৯ লাখ টন। দেশে বছরে চিনির ১৪-১৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম-বেশি ১ লাখ টন। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক মোট চাহিদা প্রায় ২২-২৩ লাখ টনের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৯-২০ লাখ টন। দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টন আদার বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ কম-বেশি দুই থেকে আড়াই লাখ টন। আর বছরে ছয় লাখ টনের ওপর রসুনের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমবেশি পাঁচ লাখ টন। আমদানির মাধ্যমে এসব খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে হয়। খাদ্যের এই খাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার একটি অংশ ব্যায় হয়।
যেসব পণ্য ঘাটতি রয়েছে আমরা আর একটু যত্নশীল হলেই চাহিদার পুরোটা না হলেও চালের মত বেশির ভাগটাই নিজেরাই উৎপাদন করা সম্ভব। যত্নশীল হলে প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব। সিণ্ডিকেট ভেঙে অনেকাংশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে দেশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব। জ্বালানী শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতি দমন করা সম্ভব। এই কাজগুলো করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড শান্তি আর স্বস্তিতে দিন যাপন করতে পারত। আর গুজব নয়; আমরা চাই সুসংবাদ চারিদিকে।
লেখক: তথ্যচিত্র নির্মাতা ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
গুজবের ডামাডোলেও দেশে আছে অনেক সুসংবাদ মত-দ্বিমত সাজ্জাদ কাদির