লাইফ ইন এ মেট্রো
২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:২০
মানুষ নগরপ্রিয়। ভাগ্যের চাকা নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছুতে কত চেষ্টা তাদের ! রাজধানী ঢাকায় বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে তারা অর্থনৈতিক মুক্তির সন্ধান করে। ক্ষমতার পুরোপুরি বিকেন্দ্রীকরণ সাধিত হলে এমনটি অবশ্য দেখতে হত না। অতটা করে আর কি ! শাসনরীতির রূপ ও অবয়বে তাই পরিবর্তন আনা জরুরি। সবাইকে কেন পল্লী জীবন ছেড়ে শহরমুখী হয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে কর্মজীবি হতে হবে?
বাংলাদেশ কৃষি ও নদী মাতৃক দেশ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কৃষি ও মৎস্যজীবি হয়েও সৎ পন্থায় জীবিকা অর্জন করা যায়। প্রজন্মের কেউ কেউ এমন আয়োজনে থেকে এই খাতের উদ্যোক্তাও হচ্ছেন। সামাজিক ঝুঁকি নিয়ে তারা বলছে, আমার পরিচয় ফার্মার। এই সংখ্যাটি বাড়তে হবে। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন তাগিদ রাখছেন বহুদিন ধরে। তিনি বারংবার করে বলছেন, এক ইঞ্চি আবাদী জায়গা যেন পড়ে না থাকে।
আমার নিকট বন্ধু ও পরামর্শক প্রায় বলেন, “তোমাদের দেশে সমুদ্র, নদী, খালবিল, হাওড়, পুকুর যা রয়েছে তা দিয়ে শিক্ষিত প্রজন্ম মন দিয়ে কাজ করতে পারলে মৎস্য সম্পদ দিয়েই দেশের ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ আছে।”
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপট বিচার করলে তিনটি ব্যর্থতার আদলে সীমাবদ্ধতা রয়েছে আমাদের। এক, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী না করতে পারা। দুই, কৃষি সমাজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রদানে বৈপ্লবিক ভুমিকা না রাখতে পারা তথা কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পায় না। তিন, মৎস্যজীবীদের সাথে ক্রেতার দূরত্ব তৈরি হওয়াই রাষ্ট্রসহ কোন পক্ষই সুষমভাবে আর্থিক সুবিধাভোগি হতে পারছে না।
জীবন, পল্লী ও নগরময় আদ্রতায় মেঘের ভেলা হয়ে আবর্তিত। একটি, প্রকৃতির রাজ্যের মত। অন্যটি, যান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, কৃষি ও মৎস্যজীবি ইস্যুতে সমাধানপ্রসূত ভাবনায় সিক্ত হয়ে অন্যদিন ধারাভাষ্য দিতে চাই। ঘুরেফিরে মানুষের শহুরে জীবন, সুখ, দুঃখ নিয়ে রাজধানী ঢাকার জীবন নিয়ে আজ একটু এগোন যাক।
প্রায় একযুগের মত হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত তথা বলিউডের একটা চলচ্চিত্র দেখেছিলাম। নাম, লাইফ ইন এ মেট্রো। সিনেমাটিতে বেশ কয়েকটি পরিবার ও সত্তাসমুহের সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন তুলে ধরা হয়েছিল। যেখানে দাম্পত্য সংকট, প্রেম, পরকীয়া, সুখ, কষ্ট, জ্যেষ্ঠ জীবনের একাকীত্ব ঘোচাতে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার উচ্ছ্বাস- ইত্যাদি ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছিল। আমাদের সুপারস্টার পপ গায়ক জেমসের একটি গানও ওই চলচ্চিত্রে বিখ্যাত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে বারবার করে মেট্রো তথা রেলসড়কের যান ট্রেন কে সঙ্গী করে প্রধান ভুমিকায় থাকা চরিত্রগুলোর জীবনযাত্রায় দেখানো হচ্ছিল। আমার ভাল লেগেছিল সিনেমাটি।
২৬ ডিসেম্বর, ২০২২। সন্ধ্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সদ্য কাউন্সিলের পর প্রথম প্রেসিডিয়াম সভা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী শেখ হাসিনার মত আমিও খুব খুশী হয়েছিলাম। যখন জানতে পারি যে, ২৮ ডিসেম্বর বহুল কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেল এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পারব। নেত্রী আমন্ত্রণপত্র পেয়ে আবেগে যখন চোখ ভাসাচ্ছিলেন, আমরা বলতে থাকলাম, সব্বাই যাব।
ঢাকায় নামধারী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের নামে অপশক্তি সুবিধে করতে পারছে না, তা প্রায় একযুগের মত করেই হবে। কেন পারে না ? নগরকেন্দ্রিক জীবনের সাথে অভ্যস্ত ঢাকার জনশ্রেণিও বুঝতে পেরেছে, শেখ হাসিনা সত্যিকারের নেতা ও তিনি একটি শহরকে আধুনিক করার জন্য যা যা করার দরকার, তেমন নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষেরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থায় নেই। তারা ধরেই নেয়, আওয়ামী লীগ জনস্বার্থে সেরাটা দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকার জনবহুল সম্পৃক্ত অফিস ও গার্মেন্টসগুলো নগরের অদূরে সরিয়ে নিলে এবং আর কয়েকটি সড়ক ব্যবস্থা নগরবিদবর্গ কর্তৃক সুপরিকল্পনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে আমরা একটি শ্রেষ্ঠ আধুনিক শহর পেয়ে যাব। এমনিতেই ছুটির দিনে বের হলে বোঝা যায় যে, এই শহরটি কত আধুনিক। সেক্ষেত্রে সুচিন্তা করে জনসংখ্যার আধিক্যতা কমাতে পারলে, সু-আবাসযোগ্য জীবনের গতিপথ প্রমাণ করতে পারবে, ঢাকার জীবন স্বস্তির এবং মৌলিক চাহিদা পূরণেও সকল পর্যায়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে।
মেট্রো রেল। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্রুতিমুলক অঙ্গীকারের অন্যতম দিক ছিল। স্থল পথের মসৃণতা খুঁজতে পুরো শহরজুড়ে ফ্লাই ওভারের মোড়কে আচ্ছাদিত ঢাকা এবার জানান দিয়েছে, মেট্রো রেলের মাধ্যমেও আমরা মানুষের কর্মজীবনকে মূল্যায়ন করতে শিখেছি। তারা যেন অল্প সময়ে যানজটমুক্ত থেকে কর্মস্থল ও আবাসে যাওয়া আসার সমন্বয় করতে পারে, মেট্রো রেল তেমনই প্রকৃষ্ট উদাহরণ বটে। ধন্যবাদ ঘুরেফিরে ওই সেই শেখ হাসিনা পাবেন, অতি অবশ্যই আমাদের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও আলাদা করে পাবেন। পাবেন রেলমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নিতে থাকা সকল দায়িত্বশীল মানুষগুলো। একইসঙ্গে ঢাকাবাসীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। যারা দিনের পর দিন বিশেষত মিরপুরের বাসিন্দারা ধৈর্য নিয়ে কষ্ট করে বিকল্প বা সরু পথ দিয়ে রাত্রি করে বাড়িতে পৌঁছিয়েছিলেন। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের একটা উক্তি মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়।
ঢাকার জনশ্রেণি; নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত- সকল শ্রেণির বসবাসের মধ্য দিয়েই শহরটি দাঁড়িয়ে আছে। আকাশপথ থেকে দৃষ্টি রাখলে দেখা যায় যে, কতটা ঘনবসতিপূর্ণ ! স্থাপনার উপর স্থাপনা।
ঢাকার সর পেশার মানুষগুলোই বিনোদনপ্রিয়। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আসরগুলো তাদের টানে। খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ছুটে যায়। তারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে, ফেব্রুয়ারীর বইমেলার জন্য। বাণিজ্যমেলার জন্য অপেক্ষা করে। পহেলা বৈশাখের দিন; নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে পদযাত্রায় চলে যায় ভোর করে রমনার বটমূলে। তারা হেমন্তের নবান্ন উৎসবপিয়াসী। বসন্ত উৎসবে প্রজন্ম উড়তে চায় ! ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উৎসব ব্যতিত তারা শহরকে ঘিরে পারিবারিক সুখের সন্ধান করে। চিড়িয়াখানায় যায় ছুটির দিনে, যায় বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ঢাকার অদূরে থাকা ফ্যান্টাসি পার্কগুলোয় যেয়ে মজা করতে চায়।
এদিকে সকল ঘরানার আনন্দ উৎসব পালন ও প্রাত্যহিক কর্মজীবনকে সঙ্গীকরত এই শহরের মানুষগুলোর আস্থা গণপরিবহনে। আজকাল উবার কিংবা পাঠাও এর মত যোগাযোগব্যবস্থার প্রতিও। ব্যক্তিগত পরিবহনে যাতায়াত করেও উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি যানযটমুক্ত নগরীকে প্রত্যাশা করে।
মেট্রোরেল, ঢাকার মানুষের যাতায়াতের একটি উপলক্ষ হয়ে নতুন উপস্থাপনা। যেখানে একটি নির্দিষ্ট যান ট্র্যাফিক পাবে না, দ্রুত সময়ে মানুষের গন্তব্য ধরা দেবে। যদিও সামগ্রিক উন্নতির জন্য ঢাকা শহরের এক কোটি জনসংখ্যার( আদম শুমারি মতে) মধ্যে অন্তত ত্রিশ লক্ষ মানুষের কর্মস্থল ও আবাস সরাতেই হবে। মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং পূর্বাচলমুখী হয়ে অফিস ও গার্মেন্টসগুলোর জন্য নগরায়ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ঢাকার যান্ত্রিকতাকেও ছোট্ট করে রুখতে হবে। প্রকৃতির ছাপ থাকতে হবে। রাস্তাঘাটে গাছ লাগিয়ে বলতে হবে, এসো ঈশ্বর ফুল হয়ে ! পাড়া মহল্লায় কিংবা অভিজাত এলাকায় প্রজন্মকে ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলায় মনযোগি হতে হবে। পাঠ্য পুস্তকের লেখাপড়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাদের ওপর তাদের একাডেমিক ডিসকাসশন বাড়ুক। ওরা একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ঘিরে নতুন করে জানার আগ্রহে যাক। নিজেরা মূল্যায়ন করুক। দেশে বিপ্লব হয়েছিল কিনা? ৭১’র মূল্যবোধে ওরা শাণিত হোক। কোন শাসক কেমন করে দেশ পরিচালনা করেছিল, কে হিরো, কে খল—ওরাই ঠিক করুক। চাপিয়ে দেয়ার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হয়ে ওরা বারবার করে লাল-সবুজের বেশভূষে যেয়ে বলুক, আমরা সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি !
কান্ট্রি ইজ নাও প্যাসেঞ্জার মেট্রো ট্রেন উইথ এ কোয়ালিটি ড্রাইভার। সেই চালকটির নাম শেখ হাসিনা। দেশ, দল সব কিছুই তার কাছে নিরাপদ। দেশের মানুষ চোখ বন্ধ করে এক মিনিট চিন্তা করুক। নেতা হিসাবে তার চেহারাই সামনে ভাসবে। ঢাকার মানুষ তা খুব বেশী করে বোঝে। দুষ্টু শক্তির আহবানে ওরা সাড়া দেয় না। তাঁরা জানে একটা লোক আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য দিবানিশি লড়ে যাচ্ছে। সে কারণে কথিত জাতীয়তবাদী শক্তির সকল আয়োজনকে বলা যায়, যত গর্জে তত বর্ষে না।
হ্যাঁ, ঢাকার মানুষের মধ্যেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব রয়েছে। ঘরে ঘরে পরকিয়া প্রেম বাড়ছে, রাজনীতিকদের সবাই তুলসী পাতাও নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি—উদাহরণ তো রয়েছে তেমন। প্রজন্ম মাদকেও ঝুঁকছে, সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য অবসর কাটনোর জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাঠাগার নেই, তারা বাসাবাড়িতে অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিতও। অথচ, অনুসন্ধান করলে দেখা যাচ্ছে যে, তাদের কর্মময় স্বর্ণালী অতীত ছিল। সামাজিক শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। সাংসদদের আরো জনমুখী হতে হবে। বড় বড় মঞ্চে বক্তব্য না রেখে ওয়ার্ডভিত্তিক পথসভা ও কার্যকর উঠোন বৈঠকে যেয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলাপচারিতায় থেকে মানুষগুলোর জন্য পথ দেখাতে হবে। তখন তারা সাধারণ মানুষ হয়েও বিবেকশ্রেণি হয়ে সু নাগরিক হতে পারবে। সত্যি বলতে তখন তাদের ভোট প্রদানটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। এখনকার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের পছন্দকে গুরুত্ব দেয়াও যায় না, কারণ তাঁরা রাজনৈতিকভাবেও শিক্ষিত নয়।
ঢাকার মানুষের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী অর্থনৈতিকভাবে খুব স্বস্তিতে নেই। বরং নিম্নবিত্ত মানুষ এখানে আয় উপার্জন ভাল করে। আমরা যারা রাজনীতি করি, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঢাকার মানুষগুলোর জন্য এখন এমন এক অর্থনৈতিক সড়কে মেট্রোরেলের মত করে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে, যেন ওই মানুষগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। তেমন পরিকল্পনায় সঁপে যেয়ে তাদেরকে আশু মুক্তি দিতে হবে। নতুবা, ওই মানুষগুলো সোস্যাল ক্রাইম করতে থাকবে।
ঢাকা ও জীবন- ওই সেই লাইফ ইন মেট্রোর আওতায় আজ দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা গর্ব করে বলতে পারছি, চল জীবনের সব আবেগকে ধারণ করে মেট্রো জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে বলি, প্রিয় শহর তোমায় ভালোবাসি। শহরের নিয়ন আলোয় মেধাবী প্রজন্ম চায়ের চুমুকে যেয়ে রঙ্গীন হয়ে এখন থেকে বলতেও পারুক, “এই শহরে জীবন কাটছে, চলে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে-তাই, জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো!”
লেখক: সভাপতিমন্ডলির সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সারাবাংলা/এজেড/এএসজি