Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

মো. আসাদ উল্লাহ তুষার
১০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪৯

কিছু কিছু সময় বা দিন কেমন ছিল তা হয়তো সেদিন পার হলে সত্যিকার অর্থে পরে আর যথাযথভাবে অনুধাবন বা অনুভব করা হয় না। বিশেষ করে ঘটনার সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা যেভাবে বিষয়টি দেখে ইতিহাসে পরবর্তীতে তা হয়তো সেভাবে অনুভব করা হয় না বা সবাই করে না। তেমনই একটা দিন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার নামেই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত বাঙালির প্রতিটি মানুষের হৃদয় মননে ছিল তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব। সাথে ছিল কবে ফিরবেন জনক তার প্রিয় স্বদেশে।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লন্ডনে সময় তখন ভোর ৮টা ৩০ মিনিট, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। তার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে দিল্লিতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান। সেদিন বঙ্গবন্ধু লন্ডন এবং দিল্লিতে পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট’। বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী ওইদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তার কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন।

কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই দিন। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের চিত্র ছিল এ রকম সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধ মানুষ। বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দুপাশে অপেক্ষমাণ বীর বিজয়ী জনতা। অন্যরকম উত্তেজনা সবার চোখেমুখে। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। লাখো মানুষের ভিড় রাজপথ জুড়ে। সবার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান।’ অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু এলেন। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই পবিত্র মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন। বিমানবন্দরে তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী, জাতীয় নেতারা, পরিবারের সদস্য, ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা সবাই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই মহানায়ককে। পরিপূর্ণ বিজয়ের আনন্দে ভেসে যায় তার প্রিয় স্বদেশ।

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব নিয়ে সাড়ে তিন বছরে একটি স্বাধীন দেশের জন্য যা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তা ছিল এক বিস্ময়কর ব্যাপার। দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন, কমনওয়েলথের সদস্যপদ অর্জন বিদেশের বুকে বাংলাদেশকে তুলে ধরা ছিল ওই অল্প সময়ের সেরা অর্জন। সেটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কারণে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তিনি যে নিরলস শ্রম দিয়েছিলেন সেটাই ছিল বাংলাদেশের ভিত্তি মূল। যুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানিরা সব ধ্বংস করে দিয়েছিল। রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, কল-কারখানা ওই অল্প সময়ে চালু করা ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরাট সাফল্য। একদিকে দেশি বিদেশি পরাজিত শত্রুর অব্যাহত চক্রান্ত অন্যদিকে দেশীয় অতি লোভী কিছু দুষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের চক্রান্ত শুরুতেই মানুষকে নানা বিভ্রান্তিতে ফেলেছিল। সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে যখন দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই আঘাত হানা হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণের বাতিঘর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যা পারেনি বর্বর পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠী তাই করল তাদেরই এদেশীয় এজেন্ট খুনি মোশতাক-জিয়া-ফারুক-রশীদ গংরা। চিরতরে নিভিয়ে দিল বাঙালির বাতিঘর। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরেই বাঙালির হাজার বছরের কাঙ্খিত বিজয় ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আবার এতিম হয়ে গেল বাংলাদেশের মানুষ, স্বাধীনতা ও বিজয়ের আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো।

পাকিস্তান আমলে চব্বিশ বছরের লড়াই সংগ্রাম শেষে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল তার পরিপূর্ণতা পেয়েছিল ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে। বিজয়ের সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই হয়তো আমরা সেই বিজয়ের মহানায়ককে হারিয়েছি। কিন্তু তার স্বপ্নের সেই স্বাধীন বাংলাদেশ আজ তার আদরের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। সব ষড়যন্ত্র চক্রান্তকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ আজ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। মাথাপিছু আয় আজ উপমহাদেশের সবচেয়ে বেশি, রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে বাংলাদেশ আজ অনেক দেশকেই অতিক্রম করে চলেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, টানা এক যুগ ধরে বছরের প্রথম দিন সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া, সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় বিধবা ভাতা, বয়স্ক ও স্বামী পরিত্যক্তভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বহু পরিমাণ বৃদ্ধি করা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াসহ নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষামূলক কাজ করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, ফোর লেনে জাতীয় মহাসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আজ অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন তার সুযোগ্য কন্যা চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা তার পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেমন তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে ফিরে আসায় বাংলাদেশের মানুষ আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলেন। স্বার্থকতা পেয়েছিল দেশের স্বাধীনতা তার নেতাকে ফিরে পেয়ে। ঠিক তেমনই ১৯৭৫ এর পনেরই আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর অবৈধ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ১৯৮১ সালের সতেরই মে প্রিয়জন হারানোর এক বুক ব্যাথা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ সামরিক শাসনমুক্ত। বিচার হয়েছে একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের। দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। দেশ আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের দেশকে নিয়ে এবং দেশের মানুষকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নেরই সফল বাস্তবায়ন চলছে তারই প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ ও তার কন্যার সঠিক নেতৃত্বে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস শুধু, জনকের স্বদেশ ফেরার দিনই না, আনন্দের দিনই না, অনুপ্রেরণার দিন, আবেগের দিন, আর অবশ্যই ইতিহাসের একটি শ্রেষ্ঠ দিন, সেরা দিন। সে দিন এসেছিল বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব আজ দেখছে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বুকটান করে মাথা উঁচু করে বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মত-দ্বিমত মো. আসাদ উল্লাহ তুষার


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর