সঙ্গীহীন সত্যসন্ধানী
২ মে ২০১৮ ২২:০৪
কয়েকদিন আগে সব কাগজে, অনলাইন সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। রাজপথে একজন টেলিভিশন ক্যামরাম্যানের কলার চেপে ধরে আছে পুলিশের ডেপুটি কমিশনার পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা। পুলিশ যেমন তার দায়িত্ব পালন করছিলেন, সাংবাদিকরাও তেমন তাদের পেশাগত দায়িত্বেই ছিলেন। একই অবস্থা হয়েছিল সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীরা রিপোর্টারদের আক্রমণ করেছে, তুই-তোকারি করে গালাগালিও দিয়েছে, ক্যামেরাম্যানদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভাংচুর করেছে।
খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বারবার আক্রান্ত ও প্রহৃত হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এর কোনওটাই বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। ঘটনাগুলির পিছনে মূলত একটি কারণই কাজ করে। শাসক বা ক্ষমতাধর কেউই তাদের পক্ষে অস্বস্তিকর কোনও খবরই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। যেকোন উছিলায় সাংবাদিকের উপর নেমে আসে আক্রমণ। তা শারীরিক নিগ্রহই হোক বা হুমকি শাসানি অথবা হেনস্তা বা খুন খারাপি। অথচ, পেশাগত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজটি সাংবাদিকদের করে যেতেই হয়। কারও পছন্দ নাহলেই ‘মিথ্যা খবর’ বা ‘দূরভিসন্ধিমূলক রিপোর্ট’-এর তকমা জোটে সাংবাদিকদের কপালে। স্বাধীন বাংলাদেশে হয়তো এরই নাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে তাই ভাবতে বাধ্য হতে হয় যে, গালভরা এই স্বাধীনতা ভোগ করেই এগুচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা।
দেশে একের পর এক সাংবাদিকের উপর আক্রমণ বা খুনের ঘটনা গণতন্ত্রকে হত্যা করারই শামিল। হুমকি দিয়ে বা আক্রমণ শানিয়ে অথবা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের কণ্ঠরোধ করা বা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা দেশে উত্তরোত্তর বাড়ছে। সাংবাদিকের তথ্য যাদের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে তারাই্ সামাজিক মাধ্যমে গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক প্রচারের ঝড় তুলছে। এসব ক্ষেত্রে কট্টরপন্থীরাই সবচেয়ে বেশি আক্রমণ শানাচ্ছে। শাসক বা রাজনৈতিক দলগুলির প্রশংসাসূচক লেখা বা বলা না হলেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে হেনস্তার প্রবণতা মূলত ভিন্ন কৌশলে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধেরই চেষ্টা।
আইনগতভাবে মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম। কখনো রাজনৈতিকভাবে, কখনো ব্যবসায়িক, আবার কখনো ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার অজুহাতে গণমাধ্যমের স্বাধীন মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এমন এক বাস্তবতায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নিজের দিকটিও আলোচনায় আসা প্রয়োজন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য এক নিরন্তর লড়াইয়ে আছে এর কর্মীরা। সেই লড়াই শাসকদলের সাথে যেমন, তেমরি বিরোধীদলের সাথেও, সেই লড়াই মালিকানার ধরণের সাথে এমনকি নিজের সাথেও।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখনও সংগঠন পর্যায়ে আছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যেতে পারেনি। বেশিরভাগ হাউজেরই কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। কোন একজন লোক একটি লাইসেন্স পেল। তিনি একটি হাউজ ওপেন করে দিলেন। কিছু লোক নিয়োগ করা হলো। কিন্তু তাদের ব্যাপারে যে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা ভাবনা করা বা শৃঙ্খলার সাথে কিছু ভাবা সেটা নেই। ফলে এখানে বেতন ভাতায় অনিয়ম আছে। এখানে চাকরির নিশ্চয়তা অনেক কম। এখানে ঝুঁকি অনেক বেশি। কোন সংবাদকর্মী যদি কোনভাবে বড় ধরণের কোন ঝুঁকির মোকাবেলা করে সেখানে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে কোন সহযোগিতা করা হয় না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভয়ঙ্করভাবে অসহিষ্ণু। তারা কেবল চিন্তা করে তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে। বিপক্ষে গেলেই তারা সাংবাদিকদের প্রতি মারমুখী আচরণ করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সাংবাদিকদের বিভক্তি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে পারছেনা সাংবাদিকরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ বিভক্তির ফলে সাংবাদিকদের কোন অধিকার যেমন রক্ষা হচ্ছে না, তেমনি পেশাদারিত্বের জায়গায়ও দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর সংকট।
অনেকেই গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গটি তোলেন। প্রথম ভাবনা, সমাজে গণমাধ্যমের ভূমিকা কি? গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে ভূমিকা রাখে তথ্য জগতে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। মানুষ জানতে চায়, মানুষ সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। আর সেখানেই গণমাধ্যমের ভূমিকা। নীতিনির্ধারক, আইনসভাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের সাথে মানুষের যোগাযোগ ঘটাতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ঐতিহাসিক ঘটনায়, মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দুর্নীতি, সহিংসতার ইস্যুকে অনেক সময় গণমাধ্যমই সবার আগে মানুষের কাছে নিয়ে এসেছে।
অনেক সময়ই বলা হয় বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতারা তা বেশি করে বলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নানা ধরনের বাধা উপেক্ষা করেই কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের। মামলা আছে, হুমকি আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা আছে, তা হলো তথ্যের মালিকানা যে জনগণের, সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। ব্যবসায়িক আর রাজনৈতিক কারণে অনেক দুর্নীতি, অনেক বড় বড় ব্যবসায়িক অনিয়ম, দুর্বৃত্তায়নের খবর প্রচার করতে পারে না গণমাধ্যম। আর সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে এই সুযোগটা রাজনৈতিক শক্তি আর দুর্বৃত্তরা বেশি করে পাচ্ছে। ফলে আজ যখন কোনো সাংবাদিক হয়রানি, হুমকি বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তখন তার জন্য কোন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয় না।
এই স্বাধীনতা কি কখনো কখনো অতি স্বাধীনতায় বা দায়িত্বহীনতায় পরিণত হয় কিনা সে প্রশ্নও উচ্চারিত হচ্ছে। হতে পারে, যদি সেই সংবাদ প্রতিষ্ঠানে একটি লিখিত আচরণবিধি না থাকে, যদি সাংবাদিকরা সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না হয়। তবে, এই ভয়ে সাংবাদিকতা বন্ধ করে দেয়া যায় না। কোনোভাবেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। সেন্সরশিপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরপন্থি, এমনকি তা আমাদের সংবিধানের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণমাধ্যম নিয়ে প্রশ্ন থাকলে তার সমাধান করবেন গণমাধ্যম কর্মীরাই, নিজেরাই নিজেদের আচরণবিধি করবেন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রথম সমস্যা তার রাজনীতিকিকরণ। যেভাবে রাজনীতি ঢুকেছে এই পেশায়, এতে বস্তুনিষ্ঠতা ও ন্যায্যতা নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক সংবাদ প্রতিষ্ঠানেরই এখন পাঠক, দর্শক-শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। নানা ধরণের স্বার্থের দ্বন্দ্বে কমে গেছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বেড়েছে চাঞ্চল্য করার প্রবণতা। রাজনীতি এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, অনেক বড় ঘটনাও কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনে আসে না। ২০০১-এর নির্বাচনের পর সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়াবহ আক্রমণ হয়, তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়, নারী নির্যাতন হয়, তা পত্রিকায় বা টেলিভিশনে বড়ভাবে প্রকাশ বা প্রচারিত হয়নি। আসলে তখনকার সরকার, তখনকার রাজনৈতিক গোষ্ঠীর চাপে তা প্রকাশ বা প্রচার হয়নি। এবং এমন একটি সেন্সরশিপের জন্য সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে কোনো প্রতিবাদও করা হয়নি।
গণমাধ্যম কর্মীদের এই রাজনৈতিক বিভাজন একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বিভক্তির ফলে সরকারি বা বেসরকারি, কিংবা গোষ্ঠীগত চাপ, কিংবা হমকি, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না সাংবাদিকরা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর উচিত একটা নিজস্ব আচরণবিধি তৈরি করে সে পথে চলা।
কিন্তু আজ বাংলাদেশের কয়টি সংবাদপত্র বা টেলিভিশন, সংবাদ সংস্থা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল কিংবা বেতার দাবি করতে পারে যে, পুরোমাত্রায় স্বচ্ছতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে তারা? কয়টি হয়ে উঠেছে সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান? কয়টি প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো বেতন-ভাতা দেয় সাংবাদিকদের? কয়টি প্রতিষ্ঠান পেরেছে নিজেদের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে? কয়টি প্রতিষ্ঠানের আছে তথ্য ও গবেষণা বিভাগ? এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের রয়েছে সীমাহীন ব্যর্থতা।
বর্তমান বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমের জন্য তিনটি বিষয়কে প্রধানতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো হলো গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সরকার ও সরকারি দল, বিরোধী দল এবং উগ্রবাদ, বর্ণবাদ ও ধর্মান্ধতা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে সাম্প্রদায়িক নানা ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার জন্য গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সত্যের অনুসন্ধান, তথ্যের প্রকাশ অতি কঠিন হয়ে উঠছে। এ ক্ষতি শুধু সাংবাদিকদের নয়। গত ৫/৬ বছরে দেশে অন্তত দশ জন ব্লগ-লেখক মর্মান্তিক ভাবে খুন হয়েছেন। ধর্মীয় মৌলবাদের পাশাপাশি রাজনীতিতে আদর্শহীন আনুগত্য যত প্রবল হচ্ছে, চিন্তার স্বাতন্ত্র্য এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ততই বিপন্ন হচ্ছে। আমরা আশঙ্কার আঁধারে আছি, আমাদের আনন্দসংগীত স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদেশের সাংবাদিকরা সত্যসন্ধানের পথে আজীবনই সঙ্গীহীন।
সারাবাংলা/এমএম