Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

শিবলী সাদিক
১০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৩৪

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন একজন অধিনায়ক বা পরিত্রাণকর্তায়, আস্থাশীল ছিলেন মহামানবেও। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে। অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।’ কবিগুরুর এই আকাঙ্খা ও ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। মানুষকে সভ্যতার সেই আশ্বাসবাণী শোনাতে গত শতকের দ্বিতীয় দশকে পরিত্রাণকর্তা হিসেবে পূর্বদিগন্তে মহামানবের ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন বাঙালিকুলের শিরোমণি, রাজনীতির কবি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আত্মমুক্তির মাধ্যমে সততা, ন্যায়, সমতাভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সভ্যতার আশ্বাসবাণী নিয়ে পরিত্রাণকর্তা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এই পূর্ব দিগন্তে।

বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘স্বাধীনতা’। আর বাংলাদেশ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের রাজনীতির নির্যাস। ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে ’৭১এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তের বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে তবেই এসেছে স্বাধীনতা। সেই যুদ্ধের নায়ক অবশ্যই জনগণ, তবে তাদের মহান এবং শ্রেষ্ঠতম প্রতিভূ ও প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও রাজনীতির সঙ্গে অভিন্ন ও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাস। স্রোতকে যেমন আলাদা করা যায় না নদীর থেকে, বঙ্গবন্ধুকেও তেমনি পৃথক করা যাবে না বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই এক, অভিন্ন ও সমার্থক।

বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম নয়; একটি অনুপম আদর্শ, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আন্দোলন, একটি বিপ্লব, একটি অভ্যুত্থান, একটি দেশ, একটি মানচিত্র, গৌরবময় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, একটি জাতিরাষ্ট্রের মহান স্রষ্টা এবং মহাকালের অমরগাঁথা একটি সমগ্র ইতিহাস। মহিমান্বিত আর্যপুত্র, দেশমাতৃকার এই বিশালাত্মা সন্তান জনগণের অধিকার আদায় ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতো স্থিতধী, নজরুলের মত তেজস্বী, সুকান্তের মতো বিপ্লবী ও পাবলো নেরুদার মতো সচেতন, দূরদর্শী, কঠোর এবং আত্মপ্রত্যয়ী।

জীবনের উত্তাপে তিনি প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছিলেন একটি গোলাপ। বাঁচবার সাধনায় যে গোলাপ রক্তিম; যে গোলাপ শত কাঁটার আঘাত সহ্য করেও জন্মগত অধিকার আদায়ের বাসনায় উজ্জ্বল। সেই বাসনা নিয়ে গণমুক্তির বাণী বুকে ধারণ করে স্বাধীন সার্বভৌম সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধু চষে বেড়িয়েছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। জনগণকে মহামুক্তির মন্ত্র শুনিয়ে তিনি তাদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক ইস্পাত কঠিন ঐক্য; রচনা করেন নিজস্ব স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট। একটি সদাসর্বোজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় উদ্ভাসিত বঙ্গবন্ধু দেশ-কাল ব্যক্তিমানস ও জাতিমানসকে এক বিশেষ শৈল্পিক বন্ধনে আবদ্ধ ও ঋদ্ধ করে জীবনবাজী রেখে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের অনির্বাণ অগ্নিশিখায় সমগ্র জাতিকে ধাবিত করেন বাংলাদেশের ইতিহাসের পূর্ণতার অভিমুখে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের দিকে।

গত শতকে দু’বার স্বাধীন হলাম আমরা; একবার ’৪৭ এ, আরেকবার ’৭১ এ। ‘৪৭ এ যে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বর্বর পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল সেই বর্বর পাকিস্তান আমরা চাইনি। এ ছিল তৎকালীন কংগ্রেস-মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দের চরম অদূরদর্শী, অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের বিষময় ফল। এমন অসভ্য বর্বর পাকিস্তানের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেননি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ‘অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ তিনটি রাষ্ট্রের উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তান দুইটা হবে। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে ‘হিন্দুস্থান’। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ ও জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের ষড়যন্ত্র ও স্বার্থদ্বন্দ্বের কারণে ’৪৭ এর মধ্যআগস্টে গণমানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে সাম্প্রদায়িকতার এক ছুরিতে নিমেষে কেটে দু’টুকরো করা হলো- জন্ম নিলো ভারত ও পাকিস্তান। আর পাকিস্তান পর্বের গোড়াতেই পাক শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বহু জেল, জুলুম, হুলিয়া সহ্য করে সহযোগী নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

ইংরেজরা এ দেশে সভ্যতা বিস্তারের জন্য আসেনি, এসেছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে; পাকিস্তানিরাও তাই। এ দেশ থেকে ব্রিটিশ বর্গিরা গেছে ’৪৭ এ আর বর্বর পাকিস্তানিরা ’৭১ এ। মাঝখানে সময়ের স্রোতে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কল্লোলিত জল গড়িয়েছে বহুদূর। সময়ের তীব্র স্রোতে ইতিহাসের হয়েছে বহু বাঁকবদল; ঘটেছে উপমহাদেশের মানচিত্রবদলকারী নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা। ’৫২র ভাষা আন্দোলন ’৫৪র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮র আইয়ুব খানের ‘মার্শাল ল’ জারি ও স্বৈরশাসন, ’৬২র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬র ছয় দফা ’৬৯র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০র নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এবং ’৭১র মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক বিজয় সর্বত্রই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

ইতিহাসস্রষ্টা বঙ্গবন্ধু বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহম্মেদসহ সহযোগী নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে অনেক বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রক্ত-বেদনার ‘বিষাদসিন্ধু’ পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভূখণ্ডের ইতিহাস বদলে দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন বাংলাদেশ নামক একটি নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ইতিহাসের সেই খাণ্ডবদাহনকালে মহাকাব্যিক উদাত্ত আহ্বানে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির যুদ্ধযাত্রা ও বিস্ময়কর বিজয় নিঃসন্দেহে বিশ্ব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি কারাগারে ৯ মাসের দুর্বিষহ কারাভোগ শেষে ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও ভারত হয়ে ১০ই জানুয়ারি প্রত্যাবর্তন করেন তার আজন্মলালিত স্বাধীন স্বদেশে। ফিরে এসেই তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও বিনির্মাণের মাধ্যমে তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরের কর্মযজ্ঞে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মাত্র ৯ মাসের মধ্যে বিস্ময়করভাবে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, ১৬ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকার পদ্ধতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিল্প, স্বাস্থ্য, যোগাযোগব্যবস্থা, প্রচারব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াবার এই যে প্রাণান্তকর প্রয়াস, তা মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।

স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে জাতির জনকের সপরিবারে নৃশংসভাবে শহিদ হবার অবিশ্বাস্য ঘটনায় অনেকেরই হয়তো মনে হয়েছিল তার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস ভিন্ন সাক্ষ্য বহন করছে। ‘বাংলাদেশের বিস্ময় যত, যত অনিন্দ্য প্রেরণা/অনুবন্ধে বঙ্গবন্ধু , শিখরে শেখ হাসিনা’ এই বিস্ময় আর অনুপ্রেরণা যেমন বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বে সর্বজনীন এক সোনালী কবিতা হয়ে উঠেছে; লাল-সবুজ বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে তেমনই সেই কবিতায় অবিনাশী সুরের ঝংকার তুলে দ্বিগ্বিজয়ী উন্নয়নের এক অনবদ্য সংগীত সৃষ্টি করেছেন তারই সুযোগ্য আত্মজা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তিনি দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার হাতেই রচিত হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বর্ণালী ইতিহাস; এদেশ পরিনত হোক বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত সোনার বাংলায়। পারস্পরিক সহযোগিতায় আমরা কী পারি না এই মহতী ও সাহসী উদ্যোগকে ত্বরান্বিত ও বেগবান করতে?

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে কীর্তিমান বাঙালি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, ৩০ লাখ শহিদ, সম্ভ্রম হারানো ২ লাখ মা-বোনসহ দেশের জন্য আত্মবলিদানকারী সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার শপদ নিয়ে কবির ভাষায় বলি ‘যতদিন এই দেশ-মাটি আছে/আছে নদী মধুমতি/ততদিন জাতি শ্রদ্ধা জানাবে/মুজিব তোমার প্রতি/কাল থেকে মহাকাল চলে যাবে/বাড়বে কালের গতি/তখনো এ-জাতি শ্রদ্ধা জানাবে/জনক তোমার প্রতি।’

লেখক: অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মত-দ্বিমত শিবলী সাদিক


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর