Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দু’টি সমস্যা যা এখনও নজরে আনেনি রাষ্ট্র

সুমন জাহিদ
১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫৮

আমি ঠিক গ্রামের ছেলে নই, মফস্বলের ছেলে। কিন্তু আশৈশব গ্রামের সঙ্গে বেশ নিবিড় সম্পর্ক ছিল, এখন হয়তো অনেকটাই কম। আমাদের শৈশবে সবচেয়ে আনন্দময় বিষয় ছিল বার্ষিক পরীক্ষার পর ও অন্যান্য বড় ছুটিতে প্রতি বছর নিয়ম করে একাধিকবার দাদা বাড়ি নানা বাড়ি যাওয়া। আশির দশকেও দক্ষিণাঞ্চলে নৌকা ছিল একমাত্র বাহন। শহর থেকে মাত্র ২০  কিলোমিটার দূরত্বের গ্রামের বাড়ি যেতে ১০/১২ ঘণ্টা নৌযাত্রা করতে হতো। এখন সেখানে ১ ঘণ্টাও লাগে না, তবু দীর্ঘবিরতি দিয়ে যখন গ্রামে যাই খুব নস্টালজিক হয়ে উঠি, বুকটা হাহাকার করে ওঠে। অথচ অতীতের অভাবী  গ্রামীণ জনজীবনে এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া স্পষ্ট। আমাদের খুশি হওয়ার কথা, তবু আমরা আশঙ্কিত হই, মনে মনে সেই পশ্চাৎপদ অজপাড়াগাঁও ফিরে পেতে চাই।

বিজ্ঞাপন

নস্টালজিয়ার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মধুরতা। এই স্মৃতিকাতরতায় গ্রামের প্রতি একটা প্রাকৃতিক রোমান্টিসিজমও কাজ করে। গ্রামের ভাঙা স্কুল এখন বিল্ডিং, ছন বা টিনশেড কাঠের ঘর-বাড়ি এখন পাকাবাড়ি বা টিনশেড বিল্ডিং। বসত ভিটার অদূরে থাকা কাঁচা শৌচাগার, রান্নাঘর-পাঁচদোয়ার, বৈঠকখানা সবই এখন এটাস্ট হোম। এখন অবশ্য চাইলেও নৌকায় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই, কেননা কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে বড় নদী ছাড়া হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ এখন বদ্ধ বাঁধ বা স্লুইচগেট দ্বারা। কিন্তু আগের চেয়ে ৯০ ভাগ কম সময়ে, কম খরচে যে কোনো স্থানে যে কেউ যেতে পারে। কেননা বর্ষায় হাঁটুগাড়া কর্দমাক্ত মেঠো পথও এখন পিচঢালা রাস্তা। হেরিকেন আলোর গ্রামে এখন ঘরে ঘরে বিজলী বাতি। আগের মতো অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী এখন আর গৃহস্থবাড়ির গরম ভাতের মাড়ের জন্য অপেক্ষা করে না, নিজের হাড়িতেই এখন তিন বেলা গরম ভাতের ব্যবস্থা থাকে। গরীব কৃষকের এক ফসলি ক্ষেতে এখন ফসল হয় কয়েকগুণ। শুধু সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতেই নয়, টিভি-ফ্রিজ-মোবাইল-ইন্টারনেট এখন গ্রামের প্রায় সকল ঘরে ঘরে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে এবং সেই অঙ্গীকারে আমি বিশ্বাস রাখতে চাই, যেমন বিশ্বাস রেখেছি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে।

বিজ্ঞাপন

এত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরও গ্রামের দিকে তাকালে এই যে বুকটা হাহাকার করে ওঠে, এই স্মৃতিকাতরতা কি শুধুই নস্টালজিয়া, না বাস্তবতাও আছে?

জ্বী, শুধুই নস্টালজিক আবেগ নয়, বাস্তবতাও আছে। উন্নয়নের কিছু সাইডএফেক্ট থাকে। তাই শুধু উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন বা এসডিজি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ।

নারায়ণের কারণে পৃথিবীর গ্রামাঞ্চল ক্রমশই খালি হয়ে যাচ্ছে। অতি জনবহুল বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ শহরে বাস করতে, ২০২২ সালে এসে তা এখন ৩১.৫১ শতাংশ।

নগরায়ণের প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের একটি সূচক বটে, কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র নদীমাতৃক কৃষি প্রধান দেশ হওয়ায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ত্বরিত উন্নয়ন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে। এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাষ্ট্রের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখছি না। এমনকি এমডিজির ভূমিধ্বস সাফল্যের মতো, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনেও যদি অনরূপ সাফল্য অর্জিত হয়, তবু কিছু ক্ষত থেকেই যাবে, যদি না এখনই প্রস্তুত হই।

গত শতাব্দীর মধ্যভাগে বাঙালি মধ্যবিত্তের উম্মেষ ঘটেছে, তখন সমাজের প্রাগ্রসর অংশ শিক্ষা ও জীবিকার জন্য গ্রাম ছেড়েছে। আমাদের পিতৃপুরুষের এই প্রজন্মটি আবহমান বাঙালি জাতির সকল প্রজন্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর প্রজন্ম। তারা যেমন ভূমিপুত্র হিসেবে হাজার বছরের লোকজ সংস্কৃতির যোগ্যতর উত্তরাধিকার হিসেবে পূর্ণ স্বাবলম্বী মানুষ, তেমনি তাদের হাত ধরেই ঘটেছে বাঙালির শ্রেনি উত্তরণ। তৈরি হয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ। এই প্রজন্মই আমাদের দেশপ্রেম শিখিয়েছে, ভেঙেছে পরাধীনতার শিকল, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তারাই এনেছেন আমাদের স্বাধীনতা। নগরায়ণের বিস্তৃতিও ঘটেছে তাদের হাত ধরে। এরপর স্বাধীন দেশের দুটি প্রজন্ম গ্রাম থেকে মফস্বল, মফস্বল থেকে বড় শহর বা রাজধানী তারপর একটা বড় অংশের প্রবাস জীবন।

বিকাশমান নগরায়ন ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মধ্যবিত্তের একটা অংশ আজ দেশে-বিদেশে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে, নানা কারণে অনেকেরই আদি বসতবাড়ি শূণ্যভিটায় রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শহরে এখন অনেক বাড়িতে সন্ধ্যাবাতিও জ্বলে না বছরের পর বছর। ফলে গ্রাম ও জনপদে একটা অসামাজিক ও দুর্বৃত্তায়িত সংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

এরই মাঝে হারিয়ে গেছে আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের নানা অমূল্য অনুষঙ্গ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও বর্ধিষ্ণু পরিবারের ধারাবাহিকতায় হারিয়ে গেছে আমাদের কাচারী ঘর। আবহমানকাল থেকে একটি উঠোন ঘিরে অনেকগুলো একান্নবর্তী ঘর নিয়ে গড়ে ওঠা একটি বড় বাড়ির বিপরীতে কৃষিজমিতে গড়ে উঠছে অসংখ্য একক বাড়ি (এক ঘর নিয়ে এক বাড়ি)। প্রজন্মের ব্যবধানে হারিয়ে যাওয়া প্রবাহমান খালের মতো সেই এককবাড়িও শূন্য হচ্ছে দিন দিন। শহরও এর বাইরে নয়।

নিজ পরিবারের কথাই বলি। তৎকালীন সমাজে সকলের মত আমার বাবাও ছিলেন কৃষকের ছেলে। গ্রামের মধ্যে তিনিই প্রথম শহরে এসে লেখা পড়া শিখে চাকরি নিয়ে পটুয়াখালী শহরে থিতু হলেন। আমাদের টানাপড়েনের সংসারে বাবা আমাদের সকল চাচা, মামা, খালাসহ অনেক নিকটাত্মীয়কে গ্রাম থেকে এনে শহরের বাসায় রেখে পড়াশুনা করিয়েছেন নিজ দায়িত্ব। এখন সবাই দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। আমরা চার ভাই-বোন চাচা, মামা, খালার কোলেপিঠেই মানুষ। আমাদের চাকরিজীবী বাবা সারাজীবন বেশ অসচ্ছল জীবনযাপন করে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন আর আমাদের সব ভাই-বোনকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাইয়ের উদ্যোগে আমরা তিন ভাই খুব কষ্ট করে আমাদের সেই ভাঙ্গাচোরা সুখের নীড়টিতে বেশ দৃষ্টিনন্দন একটা দোতলা বাড়ি করেছি। যে বাড়িটি জন্ম থেকেই ছিল কোলাহলপূর্ণ, জীবন্ত, টগবগে। আজ সেই বাড়িতেই আমার বৃদ্ধ মা একা থাকেন। এই প্রাণের ভিটা ছেড়ে তাকে ঢাকায় আনা খুব কষ্টসাধ্য বিষয়। মা চোখ বুজলে কী হবে জানি না। আমাদের প্রজন্মের প্রায় সকলেরই যাপিত জীবনের গল্পটা এমনই।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় বোধ হয় এজন্যই লিখেছিলেন,

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ ভৈরবী।
আজ সেই গোঠে আসে না রাখাল ছেলে
কাঁদে না মোহনবাঁশিতে বটের মূল
এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে
বিদ্যুৎ-রেখা মেলে…

এই নস্টালজিয়া বা আবেগের আলাপ বাদ দেই। একটু বাস্তবতার চোখ দিয়ে হিসেব করি, এই যে আমাদের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের পটুয়াখালীর এই বাড়ি, দুই প্রজন্মের সারা জীবনের বিনিয়োগ, এর ভবিষ্যৎ কী? এত বিশাল বিনিয়োগের বাড়ি তৈরির পর যদি দুই চার বছরের ব্যবধানে অব্যবহৃত হয়ে যায়, অর্থনীতির হিসাবে এটা কতবড় অপচয়? এটা কি শুধু আমার পরিবারের অপচয়, নাকি রাষ্ট্রেরও?

এর একটি সমাধান হতে পারতো বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্তের পৈতৃক ভিটা মাটির প্রতি যে আবেগ- তা কোনো যুক্তি বোঝে না। কঠিন আর্থিক সংকটে না পড়লে বাঙালি পৈতৃক জমি বেঁচে না, ভিটা মাটি বিক্রি তো দূরের গল্প। আমি অনেক পরিবার দেখেছি খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করে জীবনমান উন্নত করতে পারে, কিন্তু করে না।

ইংল্যান্ডে এখন সিলেটবাসীদের তৃতীয় প্রজন্ম কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। বৃহত্তর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক প্রবাসী নিজ গ্রামে প্রাসাদোপম বাড়ি করেছেন যা গোটা বছর প্রায় জনমানবশূন্য থাকে। অনেক কষ্ট করে সব সন্তান-নাতি-নাতনী সহযোগে জীবনে একবারই হয়তো নতুন বাড়িতে এসেছেন! এছাড়া নিজে হয়তো দুই-এক বছর পর পর ক’দিন ছুটি কাটানোর জন্য আসেন, তারপর আবার শূন্য। তিনি চোখ বুজলে এই বাড়ির ভবিষ্যৎ কী? গোটা দেশে কত বাড়ি এভাবে ওব্যবহৃত আছে এবং থাকবে সে হিসাব কী কেউ করেছে কখনো? অব্যবহৃত বাড়ি পুনঃব্যবহার করার জন্য রাষ্ট্র কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে?

সমস্যাটা কি শুধু বাংলাদেশের? না, উন্নত দেশে অব্যবহৃত আমাদের তুলনায় আরও বেশি। অব্যবহৃত বাড়ি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই একটি সাধারণ সমস্যা। পৃথিবীর সম্পদ সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধ সম্পদের মধ্যেও অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি একটি বড় রাষ্ট্রীয় অপচয়, তা সে যত উন্নত দেশই হোক না কেন। উন্নত দেশসমূহ এই অব্যবহৃত সম্পদ পুনঃব্যবহার করার জন্য নানা প্রকারের পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে, জাপানে ৬ কোটি ২৪ লাখ বাড়ির মধ্যে ১৩.৬ শতাংশ অর্থাৎ,  ৮৪ লাখ ৯০ হাজার বাড়ি পরিত্যক্ত। এমনকি টোকিও শহরে এর পরিমাণ ১০ শতাংশ। নাম্যুরা রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, জাপানে ২০৩০ সালের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ বাড়ি পরিত্যক্ত হবে। ৯০০ ছোট শহর ২০৪০ সালের মধ্যে হারিয়ে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেক প্রদেশের স্থানীয় প্রশাসন প্রতিটি বাড়ি মাত্র ৪৫৫ ডলার তথা ৫০ হাজার ইয়েনে বিক্রি করছে এবং সেখানে ফার্মল্যান্ড গড়ার জন্য অনুদানও দিচ্ছে সরকার।

ইতালির উত্তরাঞ্চলে সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে শিল্প বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষেরা জীবিকার সন্ধানে অন্যান্য জায়গায় চলে যায়। শুধু পড়ে থাকে তাদের পরিত্যক্ত বাড়ি। তাই মাত্র ১ ইউরোতে ওখানকার স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে বাড়িগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয় যে সুযোগ বিদেশিরাও গ্রহণ করে।

গোটা ইউরোপে পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গার্ডিয়ানের মতে, ইউরোপে এক কোটি ১০ লাখ ভূতুড়ে বাড়ি (গোস্ট হোম) আছে যা ইউরোপের সকল গৃহহীন মানুষদের প্রত্যেককে দুটি করে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব। এক ইংল্যান্ডেই এরূপ বাড়ির সংখ্যা ৬ লাখ যা সেখানকার প্রতি গৃহহীনকে ১০টা করে বাড়ি দেওয়ার সমান। ইংল্যান্ডে এক শতাংশ বাড়ি পরিত্যক্ত আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে এই হার ১২ শতাংশ। ২০২১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, এক কোটি অস্ট্রেলিয়ান বাড়ি পরিত্যক্ত, যা মোট বাড়ির ১০ শতাংশ। ২০১৯ সালের হোয়াইট হাউজ রিপোর্ট অনুযায়ী, পাঁচ লাখ আমেরিকান গৃহহীন আর পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বহু গবেষণা হচ্ছে। একেক দেশ একেকরকম পদ্ধতিতে এগোচ্ছে।

কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যায় ভবিষ্যতে সবচেয়ে বেশি ভুগবে। যেহেতু আমাদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে জনসংখ্যার আধিক্যই সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং সকল জাতীয় সমস্যার মূলেও এটি। অথচ অব্যবহৃত বাড়ি বিষয়ে আমাদের কোনো জরিপ নেই, গবেষণা নেই। শুধু ভেস্টেড প্রোপার্টির হিসাব হয়তো আছে, কিন্তু সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার পরিত্যক্ত বাড়ি/কোয়ার্টার ও সম্পত্তির হিসাব কোথাও খুঁজে পাইনি।

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গৃহহীন মানুষের চেয়ে পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। নানা যৌক্তিক কারণে ভর্তুকি দিয়েও পরিত্যক্ত বাড়িগুলো গৃহহীনদের কাছে হস্তান্তর সম্ভব হচ্ছে না। এর একটি প্রধান কারণ পরিত্যক্ত বাড়ি ও তৎসংলগ্ন ভূমি অনুর্বর, কৃষি অনুপযোগী ও অনাবাসযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশ তথা এই বঙ্গভূমি জন্ম থেকেই এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছে, কেননা আসমুদ্রহিমাচলে সৃষ্ট পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ এই বঙ্গদেশ বিশ্বের সবচেয়ে উর্বরা পাললিক সমভূমির একটি অধিক জনঘনত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্র।

ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমির এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে অব্যবহৃত বাড়ি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি যে কত বড় রাষ্ট্রীয় অপচয় এবং ভবিষ্যতে এটা যে কত বড় সমস্যায় পরিণত হবে, সে বিষয়ে রাষ্ট্র, সমাজ বা বিশেষজ্ঞ কাউকেই এখন পর্যন্ত তেমনিভাবে ভাবতে দেখিনি। সবার আগে জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধিতে আনতে হবে। এরপর অব্যবহৃত বাড়ি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও পুনঃব্যবহারের পরিকল্পনা নিতে হবে।

তবে একজন ঠিকই ভাবেন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমস্যা হচ্ছে তাকেই সব ভাবতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব ভাবনায় ১০টি অগ্রাধিকারভিত্তিক উদ্যোগ রয়েছে তার মধ্যে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ (পূর্বের একটি বাড়ি একটি খামার) বাংলাদেশে এ যাবৎকালে নেওয়া সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি। যে প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে।

প্রকল্পটি ৬৪ জেলার ৪৯০টি উপজেলার ৪,৫০৩টি ইউনিয়নের ৪০,৯৫০টি গ্রামে ৮০,০০০ সমিতির মাধ্যমে ৮,০০০ কোটি টাকার মূলধন নিয়ে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে চলমান। এই প্রকল্পের মধ্যেই ‘পল্লী অঞ্চলে অনাবাসী ভূমি মালিকগণের ভূমি একটি বাড়ি একটি খামার সমিতির মাধ্যমে ব্যবহার ও সংরক্ষণ নীতিমালা’ ছিল। যতদূর খোঁজ নিয়ে জেনেছি একটি অনাবাসী ভূমি মালিকগণের ভূমিও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যায়নি। তবুও সরকারের অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে এটি অনেক সফল একটি প্রকল্প বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।

এই বিশাল রাষ্ট্রীয় অপচয় নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাম অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা তৈরিতে অব্যবহৃত বাড়ি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও পুনঃব্যবহারের জন্য যুগোপযোগী প্রকল্প গ্রহণে যথা দ্রুত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং সদস্য, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর