সাংবাদিক মানিক সাহা চিরঞ্জীব
১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৮
খুলনার বিশিষ্ট সাংবাদিক মানিক সাহা আমাদের মাঝে স্বশরীরে নেই গত ১৯ বছর। তাকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যার বিচারের নামে যা হয়েছে তা হবার কথা ছিল না। হত্যার পুনঃতদন্ত ও বিচারের দাবিতে এখনও রাজপথে সোচ্চার থাকতে হচ্ছে। অর্থাৎ বিচার হয়নি। এখনও বিচারের দাবি উচ্চারণ করতে হচ্ছে।
মানিক সাহা কি কেবল সাংবাদিক ছিলেন? ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মানিক সাহার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ঐ সময় তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন খুলনা জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে জেনেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিচার দাবি সংম্বলিত ছবিসহ লিফলেট প্রচারের সময় খুলনা বিএল কলেজ থেকে তিনি গ্রেপ্তার হন। ঐ সময় তিনি ২২ মাস জেলে ছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খুলনায় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আশির দশকে খুলনায় গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক জামাত-শিবির বিরোধী সংগ্রাম ও এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে তার সাহসী ভূমিকা এখনও অনেকের মুখে মুখে ফেরে। ছাত্র আন্দোলন শেষে তিনি ওকালতি পেশায় না গিয়ে খুলনায় শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় হন। সাংবাদিকতায় যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি শ্রমিকদের আপনজন হয়ে ওঠেন। কেবল ঘরে বসে সাংবাদিকতা নয়, মাঠে ঘাটে তথ্য সংগ্রহে গিয়ে নির্যাতিত-নীপিড়িত মানুষের আপনজন হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে তার ওপর ক্ষুব্ধ হতে থাকে স্বার্থান্বেষী, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র।
সাংবাদিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করা ও সৎ সাংবাদিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। দক্ষিণাঞ্চলের সামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ, সুন্দরবন রক্ষায় তিনি শুধু লিখে ক্ষান্ত হননি, তার কন্ঠ ছিল সমসময় সোচ্চার। খুলনাসহ ঐ অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ নিপীড়িত মানুষের দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। অনেকের আশ্রয়স্থলও ছিলেন। ঐ সময় জমি, পরিবেশ ধ্বংসকারী, ভূমি দখলকারী, বেআইনী চিংড়ী চাষের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা মালিকদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল।
খবরের নেপথ্যের উৎস খুঁজে বের করতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনেকেরই কাঁপুনি ধরিয়েছিল। ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল অপরাধের নেপথ্যের হোতাদের। প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্থ অংশ সবসময় ভীত থাকতো মানিক সাহার ক্ষুরধার লেখনীতে। ঐ সময় তিনি পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিবিসি ও একুশে টেলিভিশনেও দায়িত্ব পালন করতেন। প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা, জনস্বার্থে তার কন্ঠ ছিল দেশবাসীর কাছে পরিচিত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঐ অঞ্চলের তথা দেশের নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধি। শুধু এসব কাজই নয়, দেশ বিদেশের যারাই সামাজিক কাজে বা তথ্য সংগ্রহে ঐ অঞ্চলে গেছেন তাদের আপনজন ছিলেন মানিক সাহা। তার কাছে চেয়ে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি, এমন কথা কেউই বলতে পারবেন না।
সমাজের নষ্ট, আধিপত্যবাদী, দখলদার, নীতিহীন অপশক্তির কাছে তিনি ছিলেন আতঙ্ক। তার কর্মস্থল খুলনা প্রেস ক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। গড়ে তুলেছেন একদল তরুণকে, যারা অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতা ও সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান নেয়, এর পক্ষে মানুষকে সংগঠিত করে। প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে নানাভাবে সংগ্রাম করে।
এসব ঘটনা ও কাজে স্বার্থান্বেষী, প্রতিক্রিয়াশীল মহল শংকিত হয়ে পড়ে। কোনোভাবেই অকুতোভয় মানিক সহাকে দমাতে না পেরে তারা তাকে হত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের একাংশের সহায়তা ছাড়া প্রকাশ্য দিবালোকে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতে পারে না।
আমৃত্যু একজন কমরেড, সমাজের প্রতি একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কমরেড মানিক সাহা তার সাংবাদিকতা ও জনকল্যানমূলক কাজের পাশাপাশি সংগঠিত করেছেন কমরেড রতন সেন পাবলিক লাইব্রেরি। সংগঠিত করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচি ও শিশু কিশোরদের খেলাঘরে। বিভিন্ন বিষয় যেমন- আন্দোলন, সংগঠন, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে তার লেখা প্রবন্ধ ও পুস্তিকায় তার গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর মেলে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র জীবদ্দশায় তার মাথা নত করতে পারেনি। বোমা মেরে তার মাথা দেহ থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কমরেড মানিক সাহার মাথা নত হয়নি।
আজ সংকটের নানা মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। নীতিহীনতা সমাজের নানা মাত্রায় নানাভাবে প্রসারিত হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থ অনেকের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে। যার ফলে কেউ কিছু বলার আগে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করা এবং নিজেকে বিক্রির জন্য তুলে ধরা হচ্ছে। আর কমরেড মানিক সাহার মতো সাংবাদিকরা নানা হুমকি ধামকির মধ্যেও নিজেদের নীতিগত অবস্থান বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কাজ তিনি করতে পেরেছেন তার রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে।
২০০১ সালে কমরেড মানিক সাহা নানা হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে সকলের নৈতিক সমর্থন চেয়ে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন- “একজন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে দেশের প্রতি আমি যে দায়িত্ব পালন করেছি তাতে একটি স্বার্থান্বষী মহল ক্ষুব্ধ হচ্ছে।” ২০০১ সালের ৭ ডিসেম্বর লেখা এই চিঠির পর মানিক সাহা থেমে থাকেননি। দেশ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে বুঝেও তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে যার যার অবস্থান থেকে নীতিনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করে মানিক সাহার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। একই সাথে স্বার্থান্বেষী, প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তিকে রুখে দিয়ে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, লুটপাট, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত হয়ে কাজ করতে হবে। কমরেড মানিক সাহা চিরঞ্জীব হোক।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও সমন্বয়ক, বাম গণতান্ত্রিক জোট
সারাবাংলা/এসবিডিই