গণতন্ত্রের দিন কি শেষ?
৪ মে ২০১৮ ১৩:০৪
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে মূলত মসৃণ সংসদীয় ব্যবস্থা, সুশাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের যেসব সংস্থা ও পদ্ধতির মাধ্যমে এই বিষয়গুলোর দেখভাল করা হয়, তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সমাজের সব অংশের চেতনা ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে পারে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে অভিধানে যেসব সংজ্ঞা দেখা যায়, বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব কমই।
ইউরোপের দু’চারটি রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ কিছু ক্ষেত্রে এরকম আভিধানিক গণতন্ত্রের চিহ্ন রয়েছে বটে, কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায়, সেসব রাষ্ট্রও অস্ত্র উৎপাদন করে, বাইরে বিক্রি করে, ব্যবসার জন্য বিভিন্ন দেশে নানা পন্থা অনুসরণ করে এবং বহির্দেশে গণতান্ত্রিক বিধির বিপরীতে অবস্থান নেয়। গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে এরকম অনেক বিতর্ক, অভিযোগ রয়েছে। সেসব পাশে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, কথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেভাবে চলে আসছিল, সেভাবে যেন আর চলতে পারছে না।
এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন বিশ্বের গণতন্ত্রবাদীরা। তাদের অভিযোগ, দিন দিন গণতন্ত্রের মানের অবনতি ঘটছে। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের গণতন্ত্রের মান ও অবস্থা ধরে প্রতি বছর সূচক প্রকাশ করছে। তাদের পর্যবেক্ষণ ও তথ্যাদি বলছে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের স্বরূপ
মসৃণ সংসদীয় ব্যবস্থা, সুশাসন ও মতপ্রকাশের অধিকারকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিচার করলে কী মিলছে? দেশে গত নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট হয়নি। বিচার বিভাগে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রবল। সরকার যদিও পত্রিকা ও টিভির সংখ্যা উপস্থাপন করে তারা প্রায়শই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার হিসাব দেয়। কিন্তু দেশের প্রতিটি মানুষ জানেন, জাতীয় প্রেসক্লাব ও শাহবাগে যাদুঘরের সামনের রাস্তাটি ছাড়া আসলে আর কোথাও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা বা সমাবেশ করা অসম্ভব প্রায়। গণমাধ্যমকর্মীরাও দফায় দফায় আইসিটি আইনে জেলে যাচ্ছেন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই ভাবনার চেয়ে এটি আদৌ জীবিত কিনা সেটাই বরং ভাবনার বিষয়।
বাংলাদেশের সরকার পরিচালকরা অবশ্য এ নিয়ে খুব বেশি চাপে নেই। কারণ গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্র ও সুশাসনের মান বিগত এক যুগের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন। এমন অবনতির সিংহভাগ হচ্ছে উন্মুক্ত সমাজগুলোতেই, যেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী বলে বিবেচনা করা হয়। এসব দেশের সরকারগুলো ক্রমশই স্বেচ্ছাচারী শাসন চালাচ্ছে।
বেরটুলসম্যান ফাউন্ডেশন বলছে, ‘স্বৈরতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পাওয়াটা অত বেশি উদ্বেগজনক নয়। বড় সমস্যাটা হলো নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও আইনের শাসন খর্ব হচ্ছে। একসময়ের গণতন্ত্রের বাতিঘরগুলোও সবচেয়ে অবনতি হওয়া দেশের তালিকায় যেমন- ব্রাজিল, পোল্যান্ড ও তুরস্ক।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব এখন ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্বীকরণের ক্ষেত্রে দ্রুত অবনতি প্রত্যক্ষ করছে। ক্রমেই আরো বেশি সংখ্যক দেশে, সরকারি নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য খর্ব করছে। এর মাধ্যমে ওই নেতারা কেবল নিজেদের ক্ষমতাই ধরে রাখছে না; বরং বিভিন্ন পক্ষের অবৈধ পৃষ্ঠপোষকতা নিচ্ছে এবং ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক কিউ জিন সম্প্রতি এক লেখায় মন্তব্য করেছেন, ‘আগের দিনের মতো আদর্শিক রীতিনীতি আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতার বদলে নেতাদের কাছ থেকে বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্বশীল ও যুগোপযোগী পরিবর্তন আশা করা যেতেই পারে।’ এরকম ধারণা এখন বিশ্বজুড়ে আধিপত্য করছে। চীনের একদলীয় গণতন্ত্র তার অর্থনীতি, শক্তি বা ঐতিহ্য, যেকোনো ভিত্তিতেই হোক সারা বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাধর দেশগুলোতে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার। ফলে আজকের বিশ্বে গণতন্ত্র নতুন রূপ ধারণ করেছে।
ভোটের সংকট
গণতন্ত্রের মূল উপাদান ভোটের কার্যকারিতা অবশ্য আগাগোড়াই কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ। ইদানীং যেন এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে, বেশি বেশি চোখে পড়ছে। জার্মানি ও রাশিয়ার নির্বাচনের কিছু তথ্য বিবেচনা করা যাক। জার্মানিতে এবার অ্যাঞ্জেলা মর্কেল পেয়েছেন মাত্র ৩২.৯ শতাংশ ভোট। এর আগেরবার তার ভোট ছিল ৪১.৫ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, জনসমর্থন হ্রাস পেতে শুরু করেছে, তবু জোট করে রক্ষা পেলেন মর্কেল। অর্থাৎ জনগণের ভোটের জোরে নয়, ক্ষমতায় তিনি আছেন মূলত কৌশলের জোরে।
রাশিয়ায় ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন মোট ভোটের ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এবার তার ভোট সংখ্যা আরও বেড়েছে, ১২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। সেখানে ভোট দিয়েছেন ৬৭.৫ শতাংশ ভোটার। এটা বিগত নির্বাচনের চেয়ে ২.২ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ রুশীরা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ভোট দিতে যাচ্ছেন। এটা খুব পরিস্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পুতিনের পক্ষে ম্যান্ডেট মর্কেলের চেয়ে শক্তিশালী এবং বেশি সক্রিয়। যদিও পশ্চিমা গণতন্ত্রবাদীরা জার্মানিকে উন্নত গণতন্ত্র আখ্যা দিচ্ছে।
ম্যান্ডেট তথা জনগণের রায় গণতন্ত্রের খুবই মৌলিক একটি বিষয়। বিরোধীরা জনগণের ম্যান্ডেটকে শ্রদ্ধা করার কথা বলেন। ফ্রান্সে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, নতুন দল গঠন করে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে বিরোধী দলের সহযোগিতা চেয়েছেন এবং পেয়েছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তার সরকার দেশটির সংসদের আসন সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। বিরোধী দল এতে সমর্থন দিয়েছে। সরকারি ব্যয় হ্রাসে তার গৃহীত আরও অনেক পদক্ষেপই বাস্তবায়নের পথে। সে দেশে ও ইউরোপের আরও কিছু দেশে যখন এসব সংস্কারের বিপক্ষে কথা হচ্ছে, তখন ম্যান্ডেটকে শ্রদ্ধা জানানোর দাবি তুলেছেন ম্যাক্রোঁপন্থিরা। তাদের যুক্তি, এসব প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতেই তিনি ভোট পেয়েছেন, সুতরাং এগুলো বাস্তবায়নে তাকে বাধা দেওয়াটা গণতন্ত্রকেই নস্যাৎ করে দেওয়া, ম্যান্ডেটকে অকার্যকর করে ভোটাধিকারকে সারশূণ্য বিষয়ে পরিণত করা।
কিন্তু এই একই যুক্তি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে, এড়িয়ে যাচ্ছেন ইউরোপের এই গণতন্ত্রবাদীরাই। ট্রাম্প বাণিজ্যচুক্তি, জলবায়ু চুক্তি ও ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিলসহ মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং আরও অনেক বিতর্কিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভোটের আগে। এসব চিন্তা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক, তিনি এসব প্রতিশ্রুতির বরাতেই ম্যান্ডেট পেয়েছেন। কিন্তু তার ম্যান্ডেট কার্যকর করতে দিচ্ছে না মার্কিন ব্যবস্থা এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত গলা ফাটাচ্ছেন ইউরোপীয় নেতারা। যা কিনা ম্যান্ডেট সম্পর্কে তাদের সুবিধাবাদী অবস্থানকেই প্রকাশ করছে।
স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে বার্সেলোনার জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছে কার্লোস পুজেমনের দল। কিন্তু স্পেন সরকার শক্তিপ্রয়োগ করে কাতালানদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমন করছে, সেখানেও সরকারের সঙ্গী হয়েছে আদালত। জার্মানি যদিও সারা বিশ্বের মানুষকে গণতন্ত্রের জন্য ইদানীং অনেক নসিহতই দিচ্ছে, কিন্তু দেখা গেল ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্পেনের অবদান আরও বেশি করে নিশ্চিত করতে, এক কথায় স্পেন সরকারকে হাতে রাখতে ও তুষ্ট করতে তারা গ্রেপ্তার করল পুজেমনকে।
ম্যান্ডেট শধু ট্রাম্পের ক্ষেত্রেই উদারনৈতিকদের ঝামেলায় ফেলেনি। ম্যান্ডেট পেয়েছেন পাশের দেশের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদিও। ম্যান্ডেটের জোরেই দেশকে বিরোধীশূণ্য করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। একইভাবে ম্যান্ডেটের বলে রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হলেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। আবার ইসরায়েলের শাসকরা ফিলিস্তিনে বছরের পর বছর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ম্যান্ডেটের জোর দেখিয়েই।
তাছাড়া ভোট দিয়ে যে চূড়ান্ত সমাধান আসে না, এটা জাতিসংঘের সর্বোচ্চ কেন্দ্র ‘স্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদে’র দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়, সেখানে ভোট নেই। যারা নিজেদের সর্বোচ্চ কেন্দ্রে ভোট করতে পারেন না, তারা কিভাবে প্রত্যাশা করেন ভোটের মাধ্যমে জগতের বা কোনো দেশের সমস্যা সমাধান হবে? তাহলে কী করবে মানুষ ভোট ম্যান্ডেটের প্রশ্নে! এটা কি গলার মালা না কাঁটা? গণতন্ত্রবাদীরা এর উত্তর দিতে পারছেন না।
সমস্যাটা কোথায়?
দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের এই ধারাবাহিক পতন কেন? তিনটি বিষয় এখানে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। মূল হলো অর্থনীতি। বিশ্বজুড়ে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রভাবে বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। দেশে দেশে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা বেড়ে গেছে। হানাহানি, খুনোখুনি, হামলা ও যুদ্ধের আশঙ্কা এখন সর্বত্র। এটা এতদিন ধরে চলে আসা উদারনৈতিকদের ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বিশ্বায়নমুখী অর্থনীতিতে কতিপয় মালিকের ক্রমবর্ধমান মুনাফা, আর সাধারণের শ্রমঘণ্টা ও করের বোঝা বেড়ে চলাটা মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছে। এই ক্ষোভই প্রতিফলিত হচ্ছে ওয়ালস্ট্রিট বিরোধী উই আর নাইনটি নাইন পার্সেন্ট আন্দোলনে। এভাবে অর্থনীতিই দরজা খুলে দিচ্ছে পরিবর্তনের। আর্থিক পরিস্থিতি মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি সৃষ্টি করছে যে, গণতান্ত্রিক কাঠামো তাদের রক্ষা করছে না, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। এই কাঠামোতে ক্ষমতাধররা, ধনীরাই বেশি সুবিধা ভোগ করছে। আইন-আদালত অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদেরই সেবা করছে। এগুলো বিদ্যমান বিভাজনকে আরো প্রকট করে তুলছে।
দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটি হলো বিশ্বের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতি। গণতন্ত্র তথা আদালত ও সংসদের ক্ষমতাবলেই দেখা যাচ্ছে একেকটি দেশ ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে চলেছে। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোই বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস তথা আইএস, আল কায়েদা বা জঙ্গি সংগঠনগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে তারা যুদ্ধ রপ্তানি করে কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। সৃষ্টি করছে আরও বড় হুমকি। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানের বিকাশের নামে তারা ক্রমাগত বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে এমন সব প্রযুক্তির, যা পরিবেশকে করছে বিপন্ন, মানুষকে করে দিচ্ছে কর্মহীন। মানুষের দেহ, চিন্তা, মনন, ভাষা আর সংস্কৃতি- সবই হয়ে গেছে পণ্য কিংবা শিকার হচ্ছে আগ্রাসনের।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে শুরুতে মতপ্রকাশের হাতিয়ার হিসেবে প্রচার করা হলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, এগুলো মানুষের বিকাশকে রুদ্ধ করছে। ব্যক্তির গোপন তথ্য তুলে দিচ্ছে ব্যবসায়ী বা মতলবাবাজদের হাতে। বড় ক্ষমতাধররা এগুলো ব্যবহার করে মানুষকে সহজেই বিভ্রান্ত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এসব মাধ্যম ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা এবং ভোগবাদী, কর্মবিমুখ মনোভাব।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো, গণতান্ত্রিক বিধি মেনেই এসব অপকর্ম করছে, করতে দিচ্ছে। দুর্বল গণতন্ত্র বা অগণতন্ত্র এসবের সঙ্গী হচ্ছে, কিংবা তাদের মোসাহেবি করছে। এগুলো গণতন্ত্রের দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে আসছে এবং এসব প্রবণতা জনগণকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর দিকে চালিত করছে।
কিন্তু গণ আন্দোলনের যখন টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে, যখন এস্টাবলিশমেন্টসহ এমনকি অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরাও চাইছেন জনগণের যেকোনো উত্থান ঠেকাতে, তখন সক্রিয় হচ্ছে তৃতীয় ফ্যাক্টরটি। এটি হলো ভোটবাক্স। জনগণ যখন সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, তখন তারা ভোটের সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে- ছুঁড়ে ফেলছে প্রচলিত রাজনীতিবিদ ও প্রতিষ্ঠিত নেতাদের।
মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেখা গেল ভোটে না দাঁড়ানো লোককে ভোট দিচ্ছে ভোটাররা। ফুটবলার মো সালাহকে ভোট দিয়ে ব্যালট নষ্ট করেছেন ২০ লাখেরও বেশি ভোটার। এভাবে মানুষ ভোট ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলছে। কোথাও কোথাও ভোটের মাধ্যমেই তারা নির্বাচিত করছেন রাজনীতির বাইরের প্রতিনিধি।
কিন্তু ভোট এমনই এক ব্যবস্থা যে, সেখানে এস্টাবলিশমেন্টের বাইরে থেকে কেউ আসতে পারে না। ফলে ভোটের প্রক্রিয়ায় তারা বিকল্প হিসেবে পাচ্ছেন কেবল কট্টরপন্থীদের। কারণ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রাজনীতি হলো উদারনৈতিক ও কট্টরপন্থিদের মিলনমেলা। সারমর্মে তাদের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই, উভয় পক্ষই একচেটিয়া পুঁজিপতিশ্রেণীর প্রতিনিধি। কিন্তু কট্টরদের গলা চড়া, তারা মানুষ শুনে খুশি হয় এমন সব কথা বলে থাকেন- জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব, ধর্মীয় আধিপত্যের কথা বলেন। এতে মানুষ সাময়িকভাবে তাদের দিকে হেলে পড়ে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে এখনই এটাই দেখা যাচ্ছে।
সমাধান কোন পথে?
গণতন্ত্র কোনো স্থির ধারণা নয়, হতে পারে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেহারা যেমন ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেটা তেমন থাকেনি। সেই চেহারাটাও আবার আরও পাল্টে গেল আশির দশক ঘুরতে না ঘুরতেই। নব্বইয়ের দশকে দেখা গেল, গণতন্ত্র শুধু বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর দুনিয়াজোড়া অবাধ প্রসারেই সাহায্য করল না, তাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তার নামে বিশ্বজুড়ে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হস্তক্ষেপকেও তীব্র গতিতে এগিয়ে নিল।
এভাবে গণতান্ত্রিক নিয়মবিধি অনুসরণ করেই গণতান্ত্রিকরা পৃথিবীটাকে অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে ফেলার পথে এগিয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতির সমাধান চলমান বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিভূ রাষ্ট্রগুলো নিশ্চয়ই একটি পুনর্গঠনের দিকে যেতে চাইবে। কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলো এত বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে যে, সেই সম্ভাবনা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক পর্ব কি শেষের পথে?
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা বব অ্যাভাকিয়ান এ নিয়ে নতুন একটি প্রশ্ন হাজির করেছেন। তিনি বলছেন, ‘আমরা কি গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত কিছুর কথা চিন্তা করতে পারি না?’ দেখা যাক, মানবজাতির এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর ভবিষ্যত কোন দিকে গড়ায়!
আনিস রায়হান : সাংবাদিক
[email protected]
সারাবাংলা/এমও