মিয়ানমারের অনিশ্চিত যাত্রার গন্তব্য কোথায়
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৪৭
গত পহেলা ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় বার্ষিকী। দুই বছর আগে এই দিনে মিয়ানমারের আধা-গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। ভোট কারচুপির বাহানা তুলে দেশ দখল করে নেয় সামরিক জান্তারা। আটক করা হয় নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিসহ দেশটির প্রেসিডেন্ট ও জনগণ নির্বাচিত সব নেতাকে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় জেঁকে বসা জান্তাকে হটাতে শুরুতে রাজপথে নামে মিয়ানমারের তারুণ্য। এরপর শত শত স্থানীয় মিলিশিয়া যারা নিজেদের জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা পিডিএফ হিসেবে পরিচয় দেয়, তারা সেনাশাসনকে প্রতিহত করার জন্য দেশজুড়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তবুও দুই বছরে নতুন করে সেই পুরনো জান্তাই চেপে বসে আছে মিয়ানমারের মসনদে। এই আলোচনায় গত দুই বছরে মিয়ানমারের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি এর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনা করে হয়েছে।
রাজনীতি
এটা বলা ভুল হবে না যে, শুরু থেকেই সংবিধানের প্রতি কোনো আস্থা ছিল না মিয়ানমারের জনগণের। কারণ সামরিক বাহিনী তার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আরও সংহত করার জন্য এটি তৈরি করেছিল। ২০১১ সালে আধা-বেসামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সে দেশের জনগণ আশা করেছিল যে সংবিধান দেশের গৃহযুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান দিবে। তারা এটিও আশা করেছিল যে, দেশের রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীর ধীরে ধীরে পশ্চাদপসরণ করার জন্য একটি পথ তৈরী করবে সংবিধান। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর যখন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়, তখন জনগন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সংবিধান পূর্ণ গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করবে। কিন্তু দেশটির জনগণ বুঝতে বাধ্য হয় যে তারা ভুল ছিল। সামরিক বাহিনী ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, যা দেশটির সংবিধানের ৪০২ ধারার স্পষ্ট লংঘন। এরপর যখন সামরিক বাহিনী শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভকারীদের উপর রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়ন শুরু করে, তখন মানুষ সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক উপায়ের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। দেশজুড়ে দ্রুত সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। জাতীয় সমঝোতার প্রক্রিয়ারও অবসান ঘটে।
২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, দেশে এবং বিদেশে এমন ধারণা ছিল যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দেশের রাজনীতি থেকে বাদ যাবে না। অভ্যুত্থানের পর থেকে গত দুই বছরে সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। জনগণ এখন বুঝতে পারছে যে, সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা অবস্থায় শান্তি, স্থিতিশীলতা বা উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ ও যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। শতাধিক গণতন্ত্রকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, আরও ৩০০ বা তার বেশি সেনা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে মারা গেছে। বাড়ি, ধর্মীয় উপাসনালয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং স্কুলসহ ৪০ হাজারেরও বেশি ভবনে অগ্নিসংযোগ করেছে জান্তা। তবুও বিরোধীদের মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। উপরন্তু, সেনা-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, জান্তা-নিযুক্ত প্রশাসক, মিলিশিয়া এবং কথিত তথ্যদাতাদের ৫০০ জনেরও বেশি সদস্য বা সমর্থক বিদ্রোহী গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে। গত দুই বছরের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ দিন দিন রুদ্ধ হয়ে হচ্ছে।
অর্থনীতি
কোভিড-১৯ আক্রান্ত মিয়ানমারের অর্থনীতিতে অভ্যুত্থানটি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে এসেছিল। অর্থনৈতিক সংকট মিয়ানমারের জনগণের পাশাপাশি সরকারের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। মায়ানমারের অর্থনীতি মূলত টিকে আছে তেল, গ্যাস এবং কৃষি রপ্তানি থেকে পাওয়া রাজস্বের উপর। গত দুই বছর অর্থনৈতিক মন্দা, কর রাজস্ব হ্রাস, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, ও সামরিক ব্যয়ের কারণে বাজেট ঘাটতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট দেখা দিয়েছে। এই প্রবণতা এই বছরেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থার লক্ষনীয় দিকগুলো হলো- ১. বিদেশী সংস্থাগুলোর মিয়ানমার ত্যাগ, বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ স্থবির হওয়া। ২. আন্তর্জাতিক ঋণ স্থগিত হওয়া। ৩. মূল্যস্ফীতি ১০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি এবং খাদ্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয় দ্বিগুণ হওয়া। ৪. ভাসমান হারের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার চালু করার পর কালো বাজারের উদ্ভব। মার্কিন ডলার সরবরাহের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে জ্বালানী এবং ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস সহ আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়েছে। যদিও বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বেশি, মায়ানমারে মূল্যস্ফীতি এবং জান্তার অব্যবস্থাপনার কারণে দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ৫. অস্থিতিশীলতা ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে সম্পদ, পুঁজি ও সঞ্চয় দ্রুত দেশের বাইরে চলে যাওয়া। ৬. বিদ্যুৎ বিভ্রাটে উৎপাদন ব্যাহত। ৭. লোকসানের জন্য বন্ধ হওয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কারখানাগুলি পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা। ৮. ভালো অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় দক্ষ মানব সম্পদ কমে যাওয়া। ৯. আন্তর্জাতিক দর্শনার্থী না আসার কারণে হোটেল এবং পর্যটন শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। ১০. স্বর্ণ, ডলার এবং খাবারের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বিশ্ব মঞ্চে দ্রুত বন্ধু হারাচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, কিন্তু নিঃসন্দেহে মিয়ানমারের জনগণই শেষ পর্যন্ত তাদের দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। জাতিসংঘ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির সংস্থা (আসিয়ান) দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে কূটনৈতিক ফ্রন্টে পিছিয়ে আছে জান্তা সরকার। শান্তির জন্য আসিয়ানের পাঁচ-দফা ঐকমত্য মেনে চলার জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনী। ৭০ বছরেরও বেশি সময় পর গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রথম জাতিসংঘের একটি রেজুলেশন পাশ হয়, যেখানে মিয়ানমারের মিত্র হিসেবে পরিচিত চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয় নি, যা জান্তার জন্য নতুন মাথাব্যথা।
ডিসেম্বরে পাশ হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা আইন হলো জান্তার জন্য আরেকটি আঘাত। আইনটি মিয়ানমারে বেসামরিক শাসন পুনরুদ্ধার করতে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে। উল্লেখ্য যে, এটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন (ইএওএস) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসসহ (পিডিএফ) জান্তা বিরোধী শক্তিগুলির জন্য অসামরিক সহায়তাকে সমর্থন দেয়। ইএওএস, পিডিএফ এবং নাগের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার মার্কিন সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে মিয়ানমার সংকট সমাধানে ওয়াশিংটন জান্তার সাথে আলোচনাকে এখন আর বাস্তব উপায় বলে বিশ্বাস করে না। বার্মা আইনের পর এখন আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সাম্প্রতিক আরেকটি গুরুতর কূটনৈতিক ধাক্কা হলো, সামরিক শাসনের সাথে চীন তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসছে। বেইজিং গত দুই বছরে জান্তার সাথে উচ্চ-পর্যায়ের সম্পর্ক হ্রাস করার পাশাপাশি পরিকল্পিত বৃহত্তর বিনিয়োগ স্থগিত করেছে। দ্বিতীয় লানচ্যাং-মেকং সহযোগিতা বৈঠকে জান্তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে চীন। এছাড়াও জাতিসংঘের রেজুলেশনে ভেটো না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেইজিং। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে, মিয়ানমারে সশস্ত্র বিদ্রোহে নৃশংসতা চালাতে সহায়তা করে চীন তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি নষ্ট করতে চায় না। রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে বেসামরিক নেতা দাও অং সান সু চির সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছে চীন। কিন্তু জান্তা তা করতে অস্বীকার করেছে। সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্রের এমন অবস্থান পরিবর্তন সামরিক শাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে যে কয়েকটি দেশ সামরিক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, বেলারুশ, ভারত এবং জাপান। রাশিয়া এবং বেলারুশ মূলত অস্ত্র বিক্রির জন্য মিয়ানমারের সাথে জড়িত। তাদের মিয়ানমারে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার সম্ভাবনা নেই। এবং রাজনৈতিকভাবে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যখন মিয়ানমারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তখন রাশিয়া সম্ভবত বেইজিংয়ের মতামতকে গুরুত্ব দেবে।
ভারত ও জাপান জান্তা সরকারকে অনেকভাবে সহযোগিতা করছে। দিল্লি মিয়ানমারে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় সীমান্তের কাছে বিপ্লবী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দফতরে আক্রমণ করার জন্য জান্তাবাহিনী ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করেছিল। এসময় ভারতীয় মাটিতে বোমাও পড়েছে, কিন্তু দিল্লী তেমন কড়া প্রতিবাদ করেনি। জাপান নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইয়োহেই সাসাকওয়া এবং জাপানের প্রাক্তন এমপি হিদেও ওয়াতানাবের মাধ্যমে সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করছে।
তবে মিয়ানমারে ভারত ও জাপান উভয়েরই মূল উদ্দেশ্য চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কমানো। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দুই দেশের কোনো ভেটো নেই বা আসিয়ানের ওপর কোনো প্রভাব নেই। এবং সামরিক শাসিত মিয়ানমারে তাদের তুলনামূলকভাবে সামান্য বিনিয়োগ রয়েছে। সুতরাং, এ দু্ই দেশ থেকে খুব বেশি লাভের আশা নেই জান্তার।
তবে এটাও ঠিক জান্তাবিরোধী বিপ্লবী শক্তির এখনও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তারা এখনও পুরোপুরি সশস্ত্র নয়, তাদের কাছে বিমান হামলা মোকাবেলার জন্য অল্প কিছু অস্ত্র রয়েছে, তাদের অস্ত্রের অভাব রয়েছে এবং তারা এখনও একক চেইন অফ কমান্ডের অধীনে নয় যা সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিলো। তা সত্ত্বেও, মায়ানমারের বসন্ত বিপ্লবের যোদ্ধা এবং তাদের মিত্রদের দমন করার কোনো অবস্থানে নেই সামরিক বাহিনী। অন্যদিকে, গত দুই বছরে গেরিলা বাহিনী একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হলেও এ বছর সামরিক শাসনকে উৎখাত করতে পারে এমন সম্ভাবনাও কম। তাই নিশ্চিত করে বলা যায়, মিয়ানমার সংকট এখনো এক অনিশ্চিত গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে সহসাই সমাধানের লক্ষণ নেই।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
কামাল উদ্দিন মজুমদার মত-দ্বিমত মিয়ানমারের অনিশ্চিত যাত্রার গন্তব্য কোথায়