Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল: ছাপাখানার ভূত নাকি অন্য কিছু?

জহিরুল ইসলাম
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:১৭

২০২৩ সালের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত পাঠ্যবইয়ে তথ্যগত ভুল ও নানান অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। এরই মধ্যে সরকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সম্ভবত তথ্যগত ভুল বা বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনার কারণেই এ দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু এসবের বাইরেও বইগুলোতে বানান ভুলের ছড়াছড়ি লক্ষ করা গেছে। এসব বানান ভুল ও বানানের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ বাংলা শেখায় অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।

বিজ্ঞাপন

এবারের প্রণীত বইয়ে বানানের ক্ষেত্রে কতটা শুদ্ধতা রক্ষা করা হয়েছে তা যাচাইয়ের জন্য ষষ্ঠ শ্রেণির একটা বই বেছে নেওয়া হয়েছিল। বইটির নাম ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই’। এই বইটি প্রত্যাহারকৃত বইয়ের তালিকায় নেই। তবে বলা হয়েছে, এ বইটিরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে। সেই সংশোধনীর আওতায় বানান ভুলের বিষয়টি আসবে বলে মনে হয় না। তাই এই বইটির বানান ভুল এবং বানানে অসঙ্গতির বিষয়টি আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি না।

বিজ্ঞাপন

বইটির ভূমিকাংশ পড়তে গিয়ে যেকোনো অভিভাবক বা সচেতন মানুষের মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। ভূমিকার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মানে শিক্ষায় প্রাথমিক পর্ব শেষ করে মাধ্যমিকে প্রবেশ। তোমাদের জন্যে পড়ালেখার নতুন এক পদ্ধতি নিয়ে আমরা অপেক্ষায় আছি। এ পদ্ধতিতে তোমাদের আর পরীক্ষা এবং ভালো নম্বরের পিছনে ছুটতে হবে না। কেবল পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য প্রশ্ন জানা আর সে সবের উত্তরের খোঁজে থাকতে হবে না। এখন থেকে উত্তর মুখস্থ করাও তোমাদের মূল কাজ নয়। বাবা-মায়েরও ভালো টিউটর, কোচিং সেন্টার, গাইড বই আর তোমাদের পরীক্ষা ও প্রশ্ন নিয়ে উদ্বেগে কাটাতে হবে না। অযথা অনেক টাকাও খরচ করতে হবে না।’ কিন্তু এর পরই শুরু হবে ধাক্কা খাওয়ার পালা। এক পৃষ্ঠার ভূমিকায় যে শব্দগুলো ভুল বানানে লেখা হয়েছে তার তালিকাটি এমন (ব্র্যাকেটে সঠিক বানানে শব্দটি দেখানো হলো) : দর্শনেন্দ্রীয় (দর্শনেন্দ্রিয়), শ্রবণেন্দ্রীয় (শ্রবণেন্দ্রিয়), ঘ্রাণেন্দ্রীয় (ঘ্রাণেন্দ্রিয়), স্পর্শেন্দ্রীয় (স্পর্শেন্দ্রিয়), ব্যহত (ব্যাহত) এবং মোকবিলা (মোকাবিলা)। এখানেই শেষ নয়, বইজুড়েই বানানের এমন নৈরাজ্য চলেছে।

বইটির মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠায় হালকাভাবে চোখ বুলাতে গিয়ে যেসব বানানভুল চোখে পড়েছে তার কিছু নিচে উল্লেখ করা হলো (ব্র্যাকেটে সঠিক বানানে শব্দটি দেখানো হলো) : গুনাবলি (গুণাবলি), আত্মপরিাচিতি (আত্মপরিচিতি), গলগতভাবে (দলগতভাবে), মনীদের (মনীষীদের), গরু-বাছুর চড়ত (গরু-বাছুর চরত), খেলাধূলা (খেলাধুলা), এমএসসি পাশ (পাস), বাধ না সাধলে (বাদ না সাধলে), স্যাঁতস্যাঁতে (স্যাঁতসেঁতে), মহাকর্ষ তত্তোর (মহাকর্ষতত্ত্ব), প্রবীন (প্রবীণ), কিভাবে (কীভাবে), খাদ্যাভাস (খ্যাদ্যাভ্যাস), কেনো সমস্যা (কোনো সমস্যা), অন্তত: (অন্তত), মুখোমুখী (মুখোমুখি), মন্ত্রী পরিষদ (মন্ত্রপরিষদ), ভীড়ের (ভিড়ের), অ্যাণ্ড (অ্যান্ড), লাইব্রেরি (লাইব্রেরি), বাঁধাহীন (বাধাহীন), উদ্গীরণ (উদ্গিরণ), পরিমানে (পরিমাণে), বন্টন (বণ্টন), আকর্ষনীয় (আকর্ষণীয়), বাঁধা-বিপত্তি (বাধা-বিপত্তি), লক্ষণসেন (লক্ষ্মণ সেন), প্রচারনা (প্রচারণা), উৎযাপন (উদযাপন), ত্রান (ত্রাণ), জ্বালানী (জ্বালানি), ধরণ (ধরন), মস্তিস্ক (মস্তিষ্ক), বয়োজ্যোষ্ঠ (বয়োজ্যেষ্ঠ), সমূদ্র (সমুদ্র), নগরায়ন (নগরায়ণ), লাইব্রেরী (লাইব্রেরি), যাত্রীবাহি বাস (যাত্রীবাহী বাস), অণ্বেষা/অন্নেষা/অন্বেষো (অন্বেষা), ধরণের (ধরনের), ঝাপিয়ে (ঝাঁপিয়ে), পরিস্কার (পরিষ্কার), অন্তর্ভূক্ত (অন্তর্ভুক্ত), অন্যান্যরা (অন্যরা), নৃতাত্বিক (নৃতাত্ত্বিক), গোষ্ঠি (গোষ্ঠী), উচিৎ (উচিত) ইত্যাদি। এসব শব্দ যে বইয়ের মধ্যে শুধু এক জায়গায়ই ভুলভাবে ছাপা হয়েছে তা নয়, একই শব্দ বিভিন্ন জায়গায় ভুলভাবে লেখা হয়েছে। তা ছাড়া আগেই বলা হয়েছে, পুরো বই তন্ন তন্ন করে খুঁজে সব ভুল এখানে উল্লেখ করা হয়নি। কয়েক পৃষ্ঠা পর পর হালকা চোখ বুলাতে গিয়ে যে ভুলগুলো চোখে পড়েছে সেগুলোর একটা তালিকা এখানে দেওয়া হয়েছে।

শুধু কি বানানভুল? ও-কারান্ত ক্রিয়াপদের কোনো শব্দের বানানেই সমতা রক্ষা করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। প্রথম লাইনে ‘করব’ লিখল তো পরের লাইনেই লিখেছে ‘করবো’। এভাবে বারবার দিক পরিবর্তন করেছে তারা। তাইতো কোথাও ছাপা হয়েছে বলল, কোথাও বললো, কোথাও হলো, কোথাও হল। এমনিভাবে পারো-পার, বললো-বলল, উঠলো-উঠল, চলো-চল, করেছো-করেছ, জানো-জান, এমনকি আরও-আরো, ভালো-ভাল, হওয়ার-হবার, কোনো-কোন, মতো-মত—এমনি আরও অনেক শব্দের বানানে সমতা রক্ষা করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। না-এর অতীত রূপ নি কোথাও একসঙ্গে লিখেছে, কোথাও আলাদা। শ্রেণি শব্দটিতে কোথাও হ্রস্ব ইকার ব্যবহার করা হয়েছে, কোথাও দীর্ঘ ইকার। কী এবং কি-এর ব্যবহার ঠিক রাখতে পারেনি। সমাপিকা ক্রিয়াপদ ‘ওঠে’ ও অসমাপিকা ক্রিয়াপদ ‘উঠে’র ব্যবহারে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। ড্যাশ কোথাও হাইফেন হয়ে রয়েছে, কোথাও হাইফেনের সঙ্গে স্পেস দিয়ে ড্যাশ বোঝানো হয়েছে, আবার কোথাও ড্যাশের আকারেই ড্যাশ বানানো হয়েছে। সমাসবদ্ধ পদগুলো একসঙ্গে করতে পারেনি। যে কারণে কৃষিজমি হয়ে আছে কৃষি জমি। এমনিভাবে ছাপা হয়েছে উচ্চ পদস্থ, ত্রাণ সামগ্রী, পূর্ব নির্ধারিত, মানব শরীর, অমিল গুলো ইত্যাদি। মোট কথা, এই বইয়ের ভুলগুলোর যদি কোনো সংশোধনীপত্র তৈরি করতে হয় তাহলে প্রায় মূল বইয়ের সমান আরেকটি বই ছাপাতে হবে।

আমরা জানি যে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত অনেক মানুষও ব্যাকরণ পড়ে বাংলা বানান শেখে না। কোনো শব্দ লেখার সময় ছোটবেলায় পড়া বইয়ের সেই শব্দটা তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তো, আজকালকার শিশুরা বড় হয়ে যখন শুদ্ধ বাংলা লিখতে চাইবে তখন তাদের চোখের সামনে কী ভেসে উঠবে? এর উত্তর দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে অবশ্যই আদায় করা উচিত।

অবশ্য বইয়ের প্রথমদিকে ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’ লিখে সম্ভবত দায়িত্বশীলরা তাদের সব ধরনের দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে যেটা ‘পরীক্ষামূলক’ সেটা একটা শিশুর জন্য চূড়ান্ত, এ ব্যাপারটা মাথায় রাখা উচিত ছিল। এ ছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা আর কতকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাব? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের পরীক্ষার শেষ হবে কবে?

একটি পৃষ্ঠার পর্যালোচনা

পর্যালোচনার জন্য আমি বেছে নিয়েছিলাম বইয়ের পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠাটি। এই পৃষ্ঠার প্রথম লাইনের শুরুটা এভাবে : ‘খুশি আপা বললেন দ্যাখো, …।’ এখানে বললেন শব্দটির পর একটি কমা দেওয়া উচিত ছিল। তৃতীয় লাইনে লেখা হয়েছে ‘আরও’, চতুর্থ লাইনে ‘আরো’। দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফের তৃতীয় লাইনে ‘ডাক নাম’ লেখা হয়েছে। ঠিক পরের পৃষ্ঠায়ই লেখা হয়েছে ‘ডাকনাম’। ডাকনামই শুদ্ধ।

আমার আত্মপরিচয় উপশিরোনামের পরের বাক্যটি ছাপা হয়েছে এভাবে : ‘পরের দিন খুশি আপা, সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, যে তোমরা এখন মানুষের আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদানগুলো চিহ্নিত করার যোগ্যতা অর্জন করেছো।’ এই বাক্যে খুশি আপার পরে অহেতুক একটা কমা ব্যবহার করা হয়েছে। বললেন-এর পরে যে কমাটা ব্যবহার করা হয়েছে এরপর আর ‘যে’ শব্দটার দরকার হয় না। ‘যে’ ব্যবহার করতে চাইলে বললেন-এর পরে কমার দরকার ছিল না। একই বাক্যে ‘করেছো’ শব্দটি লেখা হয়েছে ও-কার ব্যবহার করে। পরের পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনেই লেখা হয়েছে ‘করেছ’। ‘আমার আত্মপরিচয়-এর তৃতীয় লাইনে ‘আত্মপরিচিতি’র জায়গায় ছাপা হয়েছে ‘আত্মপরিাচিতি’। র-এর পরে একটা বাড়তি আকার ব্যবহার করা হয়েছে। ‘পরিচিতিপত্র’ এক শব্দ হওয়া উচিত থাকলেও একাধিক জায়গায় আছে ‘পরিচিতি পত্র’। হাইলাইট করা অংশে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে একবার ‘তার’ লেখা হয়েছে, অন্যবার ‘তাঁর’। তৃতীয় লাইনে ‘নেই’ আর ‘নিই’-এর ব্যবহার ঠিক নেই। একবার লেখা হয়েছে ‘করে নেই’। পরে লেখা হয়েছে ‘পড়ে নিই’। আসলে দুই জায়গায়ই ‘নিই’ লেখা উচিত ছিল। এই প্যারাগ্রাফের পঞ্চম লাইনে ‘দলগতভাবে’ শব্দটি ছাপা হয়েছে ‘গলগতভাবে’। একই লাইনে ‘মনীষীদের’ স্থানে ছাপা হয়েছে ‘মনীদের’।

এসব ভুলকে নিশ্চয় ‘ছাপাখানার ভূত’ আখ্যা দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করা হবে। আসলে ছাপাখানায় কোনো ভূত থাকে না। ভূত থাকে সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞতা আর অমনোযোগিতায়।

লেখক: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

সারাবাংলা/এজেডএস/এসবিডিই

জহিরুল ইসলাম পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর