ফাগুনের লাল-হলুদে বিচারালয়ে কালো দাগ
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:১৩
ফুল ফুটুক আর না ফুটুক ১৪ ফেব্রুয়ারি ঋতুরাজ বসন্ত শুরু ছিল পূর্বনির্ধারিত। সেদিনই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, তাও পূর্বনির্ধারিত। দিনটির শেষ বেলায় বিদায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে নয়া রাষ্ট্রপতির সাক্ষাত-বৈঠকও তাই। নানা ইভেন্টে ভরপুর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি নির্ধারিত বিষয়ও ছিল। যার জন্য আইন, বিচার, বিচারালয় সম্পৃক্তদের ছিল অধীর অপেক্ষা। আদালত কক্ষে বিচারকের সঙ্গে নজিরবিহীন অসদাচরণ করা ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের তিন আইনজীবীর বিষয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান এবং রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে কী রায় বা নির্দেশনা আসে সেই প্রতীক্ষা। কেবল আইন, বিচার, বা বিচারালয় সম্পৃক্ত নয়, সচেতন মহলও চোখ-কান খাড়া রাখছিলেন এ খবরের জন্য। কিন্তু, তাদের অপেক্ষা-প্রতীক্ষা আরো দীর্ঘায়িত হলো অন্তত ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত আরো ১২ দিন।
সেদিনও কী হবে হলফ করে বলার অবস্থা নেই। বরং কী হতে পারে সেই ধারনা বিশ্ব ভালোবাসা ও বসন্ত শুরুর দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি দিয়েছেন চাতুরিতে পাকা স্মার্ট আইনজীবীরা। শুনানির জন্য তারা কাগজপত্র ঠিক করতে পারেননি যুক্তি দিয়ে আরো এক মাস সময় আবদার করেন। হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের এ চালাকি বুঝেছে, চটেছে। আবার ১২ দিন সময়ও মঞ্জুর করেছে। সেইসঙ্গে বকাঝকা করেছে।
ক্ষোভ জানাতে গিয়ে বলতে বলতে বিচারপতি জে বি এম হাসান এবং রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ বলেই ফেলেছে, ‘…আমরা বুঝি। দিন যাচ্ছে আর টাইম নষ্ট করছেন। এটার (কনসিকোয়েন্স ফেস) পরিণতি ভোগ করতে হবে। আপনারা (রুলের) জবাব দিলে দেন, না দিলে না দেন। আমরা আমাদের মতো আগাবো। একটা কোর্টকে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অচল করে রেখেছেন। সব কিছু আমরা দেখছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বার বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে কালো দাগ দিয়েছে, সব আইনজীবীকে কলঙ্কিত করেছে।’ ‘…আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট হোক আর সদস্য হোক, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না। বার কাউন্সিল আছে। তবে বার কাউন্সিল কিছু না করলে আমরা এখান থেকেই করবো। প্রতিদিন আমরা খবরের কাগজে চোখ রাখি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের দিকে। আপনারা কোর্ট বর্জন করছেন করেন, কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা কোর্টে গেলে তাদের ডিস্টার্ব করা হচ্ছে, থ্রেট দেয়া হচ্ছে। আপনারা একতরফা (এক্সপার্টি) গেলে আমরাও (এক্সট্রিম) যাব। কে বারের সভাপতি, কে বিজ্ঞ আইনজীবী তা আমরা দেখব না। এরা বাংলাদেশে প্র্যাকটিস (আইন পেশা পরিচালনা) করার যোগ্য কি না সেটাও আমরা দেখব।’
অবস্থার পরিবর্তন না হলে আইনজীবীদের লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারও করা হয়। ঋতুরাজ বসন্ত, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বিদায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে নয়া রাষ্ট্রপতির বৈঠক, বসন্তের বাসন্তী আর ভালোবাসার লাল সাজের খবরে উচ্চ আদালতের এ খবরটি নিচে পড়ে গেছে। সাংবাদিকতার পরিভাষায় তা ‘টোন ডাউন’। তবে ব্ল্যাক আউট বা হারিয়ে যায়নি। আইন, বিচার, বিচারালয় সম্পৃক্তদের পাশাপাশি সচেতন মহল নিজ গরজেই লাল-হলুদের সমারোহের মাঝে খুঁজে বের করেছে খবরটি। যার যার মতো যা বোঝার বুঝেছেও। তবে, এ বিষয়ে সবার বুঝের চেয়ে দামী বুঝ নির্ভর করছে প্রধান বিচারপতির ওপর। তিনি এ বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তা অনেকটা স্বেচ্ছা প্রনোদনে, আদালতের ভাষায় স্যুয়োমোটুর মতো। এর আগে, ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে প্রথম হাজিরার দিনের ঘটনাও তিনি জানেন। তার সহকর্মীদের বেঞ্চ থেকে সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বাংলাদেশের বিচারালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। তারা বলেছেন, ওই বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীরা যে আচরণ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না। সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালত কক্ষের ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে তারা সেদিন প্রশ্ন ছুঁড়ে বলেছিলেন, কমলাপুরের কুলিরাও এ ভাষায় কথা বলে?
সেদিন এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হৈ-চৈ করেছেন আইনজীবীরা। টিপ্পনি কেটেছেন। বিচারকদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগও এনেছেন। নোংরা মন্তব্য করেছেন বিচারকদের আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে। প্রশ্ন তুলেছে- হাইকোর্ট কেন কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের তলব করলো, বিচারকদের প্রতি কেন আদালত অবমাননার রুল জারি করলো না? বসন্ত শুরু বা বিশ্ব ভালোবাসার দিনে তেমনটি না করে সময়ক্ষেপনের কৌশল নিয়েছে। ১২ দিন পরের শুনানির তারিখে কী করেন, আদালত থেকে কী সিদ্ধান্ত আসে সেই অপেক্ষা ছাড়া আপাতত গতি নেই। সেইসঙ্গে নিজস্ব আঙিনার দুর্নীতির দিকে আঙুল তুলে প্রধান বিচারপতি অতিরিক্ত যে দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়েছেন তার ফলোআপও অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। আইনজীবীদের ভৎসনার পাশাপাশি তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারক-বিচারপতিদেরও ধুয়েছেন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। বলেছেন, এরা ক্যান্সার এবং ক্যান্সার কেটে ফেলতে হয়।
অবশ্যই এ শ্রেণির বিচারক বা বিচারপতির সংখ্যা অনেক নয়। আবার অল্পের জন্য বদনাম হয় অনেকের। এ ক্যান্সারের দায় সব বিচারক কেন নেবেন? কেন লাল বা কালো তিলক পড়বে সবার কপালে? অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের কারণেই বা কেন বাদবাকি সকল আইনজীবী ভৎসনার ভাগীদার হবেন? সাধারণ খেটে খাওয়া বিচারপ্রার্থী মানুষের বদদোয়ায় পড়বেন? ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজ আদালতে আইনজীবীরা কী না করেছেন, কী সব ভাষা ও আচরণ করেছেন- তা দেশের মানুষ দেখেছে। হাইকোর্টের নির্দেশে এর মিনিট কয়েকের ভিডিও ফুটেজ বিটিআরসি সরিয়ে নিলেও মানুষের মনে গেঁথে আছে, চোখে ভাসছে। এছাড়া, নিজ দায়িত্বে ডাউন লোড করে রাখা এক্সপার্টদের তো নিষিদ্ধ জিনিস বেশি বেশি দেখার প্রবণতা থেকেই যায়।
যেই লাখ-কোটি মানুষ ওই ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন, গালমন্দগুলো শুনেছেন তাদের মনের হার্ডডিস্কে এমনিতেই তা গেঁথে আছে। এর মাঝে সেখানে তৈরি হয়েছে আরেক দৃষ্টান্ত। আন্দোলন ছেড়ে আইনজীবীরা আদালতে ফেরার একদিন আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে এক শুনানিতে কফিল উদ্দিন ও নসু মিয়া নামে দুই ভাইয়ের জামিন হয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ঠিক আগের দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে। শুনানি শেষে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল হাসান রাফি আসামিদের জামিন দেন। এর আগে দুপুরে এক সভায় আদালত বর্জন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে ফেরার ঘোষণা দেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতি। কিন্তু, তাদের ঘোষিত সময়ের একদিন আগেই জামিন শুনানি করেছেন বিচারক। বিষয়টিও ছিল মানবিক ও নিদারুণ। একটি মামলায় দুই ভাই ১৬ দিন কারাগারে। তাদের বাবা মারা যাওয়ায় জানাজায় অংশ নিতে তাদের জামিন মঞ্জুর হয়। বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ও আইনজীবীদের কর্মবিরতির কারণে সেখানকার আদালত পাড়ায় টানা কয়েক দিন যে অচলাবস্থা গেছে তা বিচারপ্রার্থীদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলবার নয়। প্রিজন ভ্যানে থেকেই স্লোগানে-স্লোগানে উকিলদের বদদোয়া করেন বিচারপ্রার্থীরা। আদালতে বিচারকাজ বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থীদের আত্মহত্যার হুমকির ঘটনার কালো দৃষ্টান্ত পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। এ দৃষ্টান্তসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিনড্রোমের অবশ্যই ফুলস্টপ দরকার।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই