বাংলা ভাষার মর্যাদা: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:৪৫
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী খুব সচেতনভাবে বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে, সংখ্যালঘু জনগনের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ শুরু থেকেই এই অপচেষ্টা মেনে নেয়নি। সেদিনের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ফিরে এসে এই অশুভ চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হন। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান গনতান্ত্রিক যুবলীগ সন্মেলনে বাংলা ভাষা বিষয়ক বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ’সেখানে প্রস্তাবগুলোর মধ্যো অন্যতম ছিল ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।’ ডিসেম্বরে ১৪ জন ভাষাবীর ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। এখানে দ্বিতীয় দফাটিই ছিল রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন। এদিন রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয় এবং হরতালে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবরণ। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরের দিন হরতাল কর্মসূচিতে যুবক শেখ মুজিব এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল তার জীবনের গতিধারা নতুন ভাবে প্রবাহিত করে। ১৬ মার্চ কারামুক্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার ছাত্র সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়াও ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে দুবার গ্রেফতার হন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হকদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলনে পরিনত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রেফতার হয়ে ১৯৫২ সালে ২৭ ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। সঙ্গত কারণেই মাঠের কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। কিন্তু তিনি যখন জেলে ছিলেন, তখন চিরকুট লিখে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন এবং হাসপাতালে অবস্থান কালে নেতাদের ডেকে পরামর্শ দিতেন। অমর একুশে গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘একুশ নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর জেলে বন্দী ছিলেন। জেলে বসেই নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি ও হতাহতের খবর পেয়েছেন। ফরিদপুরেও হরতাল হয়েছে। ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসে বিভিন্ন স্লোগান দেয়-‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চাই। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২০৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতা কাজ করলো। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। —আমি ভাবলাম, দেখব কিনা জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা না করে উপায় নাই।’
১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারপর বঙ্গবন্ধুর জোরালো পদক্ষেপে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলীতে বাংলা ভাষা চালু করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন ও শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু হয়।
১৯৭১ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, যেদিন থেকে তার দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, সেদিন থেকেই অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হবে। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি অফিসের কাজে বাংলা প্রচলনের সরকারি নির্দেশ জারি করেন। সেখানে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবু্ও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পর অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্রে লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর স্বীকৃতি আসে। ১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম ব্রিটিশ কলম্বিয়া ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটির পক্ষে’ জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব তুলে ধরলে মহাসচিবের দপ্তর থেকে ইউনেস্কোর সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়। ইউনেস্কো জানায় প্রস্তাবটি কোনো ব্যক্তি নয়, সদস্য রাষ্ট্রকে তুলতে হবে। রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারকে জানালে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দ্রুততার সাথে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর ৩০ তম সাধারণ সন্মেলনে উত্থাপিত হলে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরের বছর ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
২০০১ সালে বিকাশমান এবং বিলুপ্ত প্রায় ভাষাগুলো রক্ষার্থে ঢাকায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনাসটিটিউট’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তখন উক্ত অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ায় কার্যক্রম শুরু করতে পারেন নি। এবং বিএনপি ক্ষমতায় এসে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসলে কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃভাষা উন্নতকরণ করার লক্ষ্যে জাতিগত সংখ্যা লঘুদের ভাষায়ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের সিন্ধান্ত নেন। ২০১৩ সাল থেকে শেখ হাসিনা সরকার বাংলার পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদ্রি এবং গারো ভাষার পাঠ্যপুস্তক গুলো বিনামূল্যে বিতরণ শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বমঞ্চেও তুলে ধরেছেন। দেশরত্ন শেখ হাসিনাও পিতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বাংলা ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিবছর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাকে নতুন ভাবে তুলে ধরছেন।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
ই-মেইল: [email protected]
সারাবাংলা/এজেডএস