হারিয়েছে আদর্শলিপি, হারাচ্ছে আদর্শ মানুষ
৫ মে ২০১৮ ১৮:৫২
সাইফুল হাসান ।।
সপ্তাহ দুয়েক আগে, রাতে, পাড়ার মোড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। বাচ্চাদের ভর্তি, স্কুল, শিক্ষা, শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে তুমুল আলাপ চলছিলো। ওই আড্ডায় সজীব নামে স্থানীয় এক ছোটভাই আমাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন আদর্শ মানুষ তৈরির কোন প্রক্রিয়া আছে কি? আদর্শলিপি পড়ে যে বাচ্চা বড় হয় না, সে আদর্শবান হবে কিভাবে?’ যদিও আমি মনে করি না, শুধু আদর্শলিপি পড়লেই আদর্শ মানুষ হবে। কিন্তু ‘আদর্শ’ হবার ‘লিপি’ না চিনে কেউ ‘আদর্শ মানুষ’ হয়ে যাবে এমন আশা করাও বোকামি।
ছোটবেলায় সুর করে পড়তাম, ‘অ’তে-অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ, ‘আ’-তে আলস্য দোষের আকর। অ, আ দিয়ে এক একটি বাংলা বর্ণের সাথে পরিচয় হতো। বন্ধুত্ব হতো ভাষার সাথে। মা পাশে বসে বর্ণমালা ও বাক্য মুখস্থ করাতেন। অলস-আলস্য না বুঝে জানতে চাইতাম, এটা আবার কি? মহল্লার ঘুষখোর কিংবা অলস কাউকে দেখিয়ে বুঝাতেন কে অসৎ আর কে অলস। অক্ষর চেনানোর মধ্য দিয়ে এভাবেই মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো মানবিক গুনাবলী অর্জনের আকাংখা, বিনয়ী ও ক্ষমাশীল হবার মন্ত্র। যা পরবর্তীতে আমাদের জীবন চলার পথে শক্তি ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এরপরও আমরা বা আমাদের কতজন আদর্শ মানুষ হতে পেরেছি, সে এক ভিন্ন আলোচনা।
‘আজকের শিশুই, আগামী ভবিষ্যত’- এই বাক্যটি পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান সত্য। পৃথিবীর সব দেশেই শিশুদের বই রচিত হয়, তার নিজস্ব ভাষা, লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস, জাতিয়তাবোধ এবং জাতীয় অর্জনের ওপর ভিত্তি করে। এসব বই ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি, শিশুদের মধ্যে মর্যাদা, সততা, দেশপ্রেম, মানবিক গুনাবলি ও ন্যায়নীতি বোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। রাষ্ট্র ও সমাজ তার ফল ভোগ করে, যখন শিশুরা এক-একজন আদর্শ নাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠে; দেশ ও সমাজ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
বাঙ্গালী পরিবারগুলোতে যুগ যুগ ধরে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষার প্রথম ভাগ’, রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’-শিশুদের প্রথমপাঠ বই দুটির ছিলো একচেটিয়া প্রভাব। পরে সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শলিপি ও সরলবর্ণ পরিচয়‘ প্রকাশিত হলে, বইটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। আদর্শলিপির দাপটে দ্রুতই অন্যসব বই উপযোগিতা হারায়। বইটি হয়ে ওঠে, দুই বাংলার সোনামনিদের ভাষা শিক্ষার সবচেয়ে কাংখিত বই।
বাল্যশিক্ষায়, সীতানাথের আদর্শলিপির মতো আধুনিক, সৃজনশীল, সরল এবং সুপাঠ্য আর কোন বই আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি। আমার মতে, আদর্শলিপি বইটি বাংলাভাষায় লেখা সবচেয়ে সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি। হাতে আঁকা শাপলা ফুলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করা বইটির ছবি আজো চোখে ভাসে। ভাবা যায়, শিশুর মনোজগত উপযোগী এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বই প্রায় হারিয়ে গেছে!
বাজারে সীতানাথের আদর্শলিপি পাওয়া না গেলেও, ডোরেমন আদর্শলিপি, মোটুপাতলু আদর্শলিপি, মিনার আদর্শলিপিসহ আরো হরেক রকমের শিশুশিক্ষার বই পাওয়া যায়। এসব বইয়ে লেখকের কোন নাম নেই। এসবের মধ্যে আদর্শের উপাদান কতটা আছে তা অবশ্য বিবেচনার দাবী রাখে। কালেভদ্রে কোথাও কখনো মূল আদর্শলিপি বইটি পাওয়া গেলেও তার মধ্যে অনেক সংযোজন বিয়োজন দেখা যায়।
শুধু আদর্শলিপিই নয়, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ বা ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’র মতো কবিতাও এখনকার বাল্যশিক্ষার বইগুলোতে অনুপস্থিত। অন্তত, আমি আমার বাচ্চার বইয়ে দেখিনি। চরিত্র গঠন, নৈতিকতা, সততা, সাহস, সৃজনশীলতা তৈরিতে আদর্শলিপি তো বটেই, এসব ছড়া-কবিতার আবেদন আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ থাকবে।
আজকের বাচ্চা শিখছে, অ তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমরা খাবো পেড়ে, অথবা অ তে অজু করো নামাজের আগে। সাপ ভয় পায় না, এমন মানুষ বিরল। আর অজগরের মত বিশাল ও বিভৎস সাপ হলে তো কথাই নেই। অথচ এই অজগরই ভাষা বা বর্ণ শেখার প্রথম শব্দে প্রকাণ্ড এক হা নিয়ে আমাদের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অভিভাবক বা শিক্ষক হিসেবে আমার কি ভেবে দেখেছি, অজগর আপনার সোনামনিদের ওপর কি প্রভাব ফেলছে? যে শিশু ভয়ের রাজ্যে বড় হয়, তার জন্য আ তে ‘আমটি পেড়ে খাওয়া’ কঠিন, এটা কি আমরা বুঝতে পারছি?
বাজারে প্রচলিত বাল্যশিক্ষাগুলোতে সৃজনশীলতা নয় বাণিজ্যই মুখ্য। আর তাই বর্তমান বইগুলোতে, অলংকরণ, রংয়ের ব্যবহার, বাক্যগঠন, প্রচ্ছদ বা ছবির ব্যবহারে কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। যেনতেন ভাবে বিদেশী কার্টুনের বিভিন্ন চরিত্র ও ছবি জুড়ে দেয়া হয় বিভিন্ন বাক্যের সাথে। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হচ্ছে উৎকট রং এবং ক্যামেরায় তোলা ছবির ব্যবহার। চোখ ধাধানো রং বা ছবি শিশুর মনোজগতকে বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করলেও, এর অন্তর্গত সৌন্দর্য দেখতে বা উপলদ্ধি করতে শেখায় না।
মূল আদর্শলিপিতে অক্ষর চেনানোর ক্ষেত্রে নীতি ও আদর্শিক বাক্যের পাশাপাশি, বিষয়গুলো বুঝতে হাতে আঁকা ছবির ব্যবহার ছিলো। বিষয়টা এতো শৈল্পিক এবং সুন্দর যে ছবিগুলো মনের কোনে দাগ কেটে যেতো। ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি ‘ইউনিক’ বলে মনে হয়। এই পদ্ধতিতে শিশু সহজেই অক্ষর এবং অক্ষর সম্পর্কিত বাক্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারতো। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই মনে করেন, শিশু শিক্ষায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে বর্ণক্রমিক থেকে বাক্যক্রমিক ভাষাশিক্ষা পদ্ধতি চালু হলে। এর মধ্য দিয়ে অপ্রয়োজনীয়, অযাচিত বহু জিনিস শিশু শিক্ষায় ঢুকে গেছে।
শিশুর জন্য পরিবার হচ্ছে সবচেয়ে বড় স্কুল। আর মা হচ্ছেন সবচেয়ে বড় শিক্ষক। কেননা, বাচ্চার প্রথম পাঠ শুরু হয় পরিবারে এবং মায়ের হাতেই। সবাই চায় তাদের সন্তান, সজ্জন ও ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক। যদিও তা পরিবার, পিতামাতার আচার-আচরণ, বাল্যশিক্ষা এবং স্কুলের ওপর নির্ভর করে। আদর্শলিপি শুধুমাত্র সোনামনিদের বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। আর তাই প্রয়োজন বইটির নতুন প্রকাশনা। কাজটি প্রকাশকদের করতে হবে। তবে, রাষ্ট্র-সরকারও এখানে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা অন্তত বাল্যশিক্ষার জন্য কিছু বই নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। এর মধ্যে সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি ও সরল বর্ণ পরিচয় বইটি অবশ্যই থাকতে হবে।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আদর্শ নাগরিক তৈরি হলেও, বর্তমান বাস্তবতায়, পড়াশোনার লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় পাশ করা। সার্টিফিকেট হাসিল করা। ফলে বছর বছর প্রচুর ছেলেমেয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বেরুলেও, দেশ প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ কতজন পাচ্ছে-সে এক বড় প্রশ্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রে আজ অস্থিরতা। নীতি, আদর্শ, মানবিকতা শব্দগুলো এখন সমাজে উপহাসের মত শোনায়। এমনকি কোন কোন পরিবারেও। দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ, ঠকদের জয়জয়কার চারিদিকে। আদর্শ শিক্ষার মাধ্যমেই কেবল এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, অন্য কিছুতে নয়।
আমাদের মনে রাখা উচিত, আদর্শ, ন্যায়-নীতি, মর্যাদা, মানবিকতা, দয়ার বিষয়গুলো দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। এগুলো অর্জন করতে হয়, শিক্ষার মাধ্যমে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি চাই? কেতাদুরস্ত শিক্ষিত কেরানি চাই নাকি আদর্শ মানুষ?
আদর্শ মানুষ চাইলে বাচ্চাকে আদর্শলিপিই পড়াতে হবে। সেটা সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি বা তার চেয়ে ভালো কিছু। এরচেয়ে কম কিছু নয়।
সাইফুল হাসান : সাংবাদিক
[মত-দ্বিমতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব]