৭ই মার্চ, আমাদের স্বাধীনতা
৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:৩০
উত্তাল মার্চ। রক্তাক্ত মার্চ। ৭ই মার্চ। বাঙালি জাতির ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় মাস। অগ্নিঝরা এই মাসের ৭ই মার্চ দিনটি বাঙালি জাতির কাছে গর্বের ও গৌরবের। আজ থেকে ৫২ বছর আগের এই দিনটি প্রতিবছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে। দিনটি এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকলকে আন্দোলিত করে। নতুনভাবে উদ্দিপ্ত করে। জাগ্রত করে তোলে আমাদের নতুর চেতনায়।
কেমন ছিলো মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলি! ১ম মার্চ থেকে ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি স্থানে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মূলত ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্থানের অফিস-আদালত, কলকারখানা বঙ্গবন্ধুর একক নির্দেশে চলতে থাকে। একটি দিন অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি দেশব্যাপী পালন হতে থাকে। ঢাকা- রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল-মিটিংয়ে বর্বর পাকিস্তানি জান্তাদের গুলিতে অনেক নিরীহ বাঙালি শাহাদত বরণ করেন। বলা যায়, অঘোষিত স্বাধীনতায় বাঙালিরা স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষ। ২৩ বছর মুক্তি সংগ্রামে চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা ঘটে এই দিনটিতেই। এই জনসভা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ঘিরে তখন সারা দেশে চলছিল ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল- বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণে আসলে কী বলবেন? স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? না অন্য কিছু। সকল জল্পনা-কল্পনা অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু জনসভাস্থলে আসলেন। অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আহূত এই জনসভা থেকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করতে পারেন। এরকম একটা সম্ভবনা ছড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ভীত হয়ে পড়ে। এই ভীতির কারণেই ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তিনি যেন ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভার স্বাধীনতার ঘোষণা করেন- সে জন্য অনুরোধ করেন। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা করা হলে রেসকোর্স ময়দানে কামান এবং বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হবে। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না। যদি গোলা বর্ষণ করেন তবে আপনাদের পরিণতি শুভ হবে না।
৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সাক্ষাৎ করেন । অত্যন্ত স্বল্প সময়ের এই বৈঠকটি গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিস্কার ভাষায় বঙ্গবন্ধুও ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই মেনে নেবে না। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করলেন প্রস্তাবিত বক্তৃতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন, জনসভায় কী কী বলবেন। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রবল চাপ, অপরদিকে স্বাধীনতার ঘোষণার বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি এই সকল বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কঠিন এক চাপের মধ্যে ছিলেন। কয়েক ঘন্টা পেরোনোর পর জনসভা শুরুর ঘন্টাখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আ.স.ম আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খান ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্র নেতারা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিলেন-স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোন পথ খোলা নাই। যে কোনো মূল্যে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা চাই। বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির চাপে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তন হয় যে, পূর্ব বাংলার বামপন্থিমহল কিছুর বিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মাত্র ১৮ মিনিটের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই বলছেন। আজকে এই ভাষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক গবেষক, ঐতিহাসিক নানা ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে।
আজকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির জোয়ারে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা নিয়ে কতো কি হচ্ছে! ভাবতে বড় কষ্ট হয়। কিন্তু পরক্ষনেই আবার স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে আসি। কারণ বাঙালিতো আত্মবিস্মৃত জাতি। ৭ মার্চের সে ঐতিহাসিক ভাষণ একটু ব্যাখ্যা করলেই অনেক কিছু বের হয়ে আসে। এর সপক্ষে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই যে সংগ্রামের কথা বলেছেন তার উদ্দেশ্য কী তা বিশ্লেষণ করার দরকার আছে। আমরা সাধারণত জেনে এসেছি সংগ্রাম বলতে অধিকার আদায়ের লড়াইকেই বোঝানো হয়। আবার সংগ্রামের আভিধানিক অর্থ মুুক্ত। সংগ্রাম বলতে এক সময় সন্ত্রাস, বিপ্লব ও বিদ্রোহের কথাও বোঝাতো। বঙ্গবন্ধু যে সংগ্রামের কথা বলেছেন তা কী আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিপ্লব, নাকি স্বাধীনতার ঘোষনা? সম্প্রতি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারীদের মন্তব্যের জবাবে আমার বলা, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
রেসকোর্স ময়দানের ৫ লাখ লোকের মহাসমাবেশ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান। স্বধীনতার এ ডাক দেবার মাঝে তার ভাষণের দুটি লাইন তাৎপর্যপূর্ণ- ‘ঘরে ঘরে দূর্র্গ গড়ে তোলো, যায় যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর।’ তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন করা যায় ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার প্রয়োজন কেন? দ্বিতীয়ত কেন শত্রুর মোকাবেলা বলা হয়েছে। আজও যারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন দীর্ঘ ৩৪ বছর পরও কি যেন এক অজেয় শক্তি আমাদের মনকে দোলা দেয়, আন্দোলিত করে।
ঐতিহাসিক এই ভাষণের দিকে আরও একটু নজর দিলেও বোঝা যায় প্রথমে তিনি অত্যন্ত ধীর গতির বক্তব্য শুরু করেন। এক পর্যায়ে চরমে পৌঁছেন ‘তবুও দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমে তিনি ২৪ বছরের ইতিহাসের কথা বলেছেন। তারপর যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলেছেন। তারপর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলেছেন। ১৮ মিনিটের এই ভাষণে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচিও এঁকে দিয়েছিলেন- ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…’। তখন কি করতে হবে তারও স্পষ্ট সমাধান দিয়ে গেছেন। প্রকৃত অর্থে ১ মার্চ থেকেই পূর্র্ব পাকিস্তানের কলকারখানা অফিস- আদালত চলতে থাকে শেখ মুজিবের নির্দেশে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে উড়তে থাকে পতাকা। ৬ দিন এভাবে চলার পর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই জনসভা থেকেই দেওয়া হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়ে ছিলেন মূলত, ১ মার্চ থেকে প্রতিটি বাঙালি যেভাবে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে আসছে, ঘরে ঘরে লাল সবুজের পতাকা উড়াচ্ছে তা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। তাইতো বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো’ । এ রক্ত স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই। ২৫ মার্চের রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তিনি ইপিআরের ওয়ারলেসে সেই একই ঘোষণা দিয়ে যান।
৭ মার্চের রেসকোর্সে উপস্থিত লাখো জনতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে সন্তুষ্ট হলেন। প্রত্যেকে যার যার ঘরে ফিরে গেলেন। তাদের স্বাধীনতার ওপর হামলা মোকাবিলার জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মূল্যায়নে ব্যর্থ হলো, স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায়? মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অর্থ কী? ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু যে মুকুটবিহীন সম্রাটে পরিণত হন তার আরও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ মেলে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের একটি কবিতা আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে-
“মুজিবুর রহমান ঐ নামে যেন ভিসুভিয়াসের অগ্নি,
বঙ্গদেশের এ প্রাপ্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,
জ্বালায় জ্বালিয়ে মহাকালের ঝঞ্ছা অশনি বেয়ে।”
একজন মানুষ একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন। আবার ইতিহাসও তার নিজের প্রয়োজন একজন মানুষের আবির্ভব ঘটাতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তেমনি একজন মানুষ। ইতিহাসের প্রয়োজনেই তার অবির্ভাব। আবার তিনি ইতিহাসে একটি সোনালী অধ্যায় যোগ করে গেছেন। ৭ মার্চ ৭১ এ রমনা রেসকোর্স থেকে উচ্চারিত হয়েছিল বাঙালির নবজন্মের মন্ত্র। বহুকাল দিশেহারা, দেশহারা বাঙালি জনগণ সেদিন খুঁজে পেয়েছিল আপন জন্মভূমির ঠিকানা। এই বাংলাদেশ নামটিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের দেওয়া।
১৯৬৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শেরে বাংলার মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে আমাদের মাতৃভূমির নাম হবে বাংলাদেশ’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অত্যুজ্জ্বল দিকনির্দেশনা। এই ভাষণের প্রতিটি আহ্বান অদিকারবঞ্চিত দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তাই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ও বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বধীনতার ঘোষণা বাণীর বার্ষিকিতে আমরা আবারও নতুন করে শপথ নিই , ‘এবারের সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম।’
লেখক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, রাজশাহী কৃষি ব্যাংক এবং সাবেক সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)
সারাবাংলা/এসবিডিই
৭ই মার্চ- আমাদের স্বাধীনতা প্রফেসর ড. শাহ নওয়াজ আলি মত-দ্বিমত