সরকারের লক্ষ্য প্রফেসর ইউনূস নাকি দুর্নীতি-অনিয়ম
১২ মার্চ ২০২৩ ১৪:৪২
অতিসম্প্রতি ৪০ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা, ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান-কি মুন, গায়ক বোনো, প্রাক্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন এবং আরও অনেকে ঐ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। ইউনূস এবং গ্রামীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্বের উল্লেখ করে, স্বাক্ষরকারীরা বাংলাদেশকে নোবেল বিজয়ীর প্রতি ‘হয়রানি’ বন্ধ করতে তার প্রতিষ্ঠানগুলির উপর চলমান সরকারী তদন্ত বন্ধ করতে আহবান জানিয়েছে।
এই চিঠির প্রেক্ষাপটে, জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সরকার কি প্রফেসর ইউনূসকে হয়রানি করছে? নাকি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কেবল তাদের এখতিয়ারভুক্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত করছে?
বিজ্ঞাপন আকারে ওয়াশিংটন পোস্টের খোলা চিঠিটিতে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করা হয়েছে। মজার বিষয় হল, চিঠিটি সচরাচর পদ্ধতির বাইরে গিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। সাধারণত, এ ধরণের চিঠি বিবৃতি অথবা সম্পাদকীয় আকারে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এই সুনির্দিষ্ট চিঠিটি ওয়াশিংটন পোস্টে টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। আনুমানিক পাঁচ কলামের প্রায় পুরো পাতাজুড়ে দেওয়া বিজ্ঞাপনটির খরচ হতে পারে ৭৩ হাজার ডলার বা প্রায় ৭৮ লক্ষ টাকা। বিজ্ঞাপন হিসেবে চিঠিটি প্রকাশ পাওয়ায় এটির প্রকাশক ওয়াশিংটন পোস্টও চিঠিটি সমর্থন করতে পারছে না। নিছকই বিজ্ঞাপন হিসেবেই পত্রিকাটি ছাপিয়েছে।
প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ফোন বা গ্রামীণ টেলিকম থেকে কোনো মুনাফা পান না বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। তাই, তাকে তদন্ত করার পুরো ব্যাপারটি স্বাক্ষরকারীরা ‘বেদনাদায়ক’ বলে অভিহিত করেছেন। চিঠিতে গ্রামীণের সামাজিক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে চলমান তদন্তকে সরাসরি হয়রানিমূলক আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
বাস্তবে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং জাতীয় রাজস্ব ব্যুরো (এনবিআর)-সহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কেবল দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্ত করে তাদের প্রাত্যহিক কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত এই মূহুর্তে চালু নেই। চলমান তদন্তগুলির মধ্যে রয়েছে তার প্রতিষ্ঠা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে মুনাফা ভাগাভাগির দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের করা মামলাটির কথা বলা যেতে পারে।
তবে, ব্যবসায়িক মামলা বাংলাদেশ কেন দুনিয়ার সব দেশেই প্রাত্যহিক ব্যাপার। জটিল আইন এবং অনভিজ্ঞতার ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলি প্রায়ই এই ধরনের মামলা এবং তদন্তের সম্মুখীন হয়। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের একান্ত নিবেদিত আইনি দলও রেখে থাকে। কর্মী ছাঁটাইয়ে অনিয়ম, কর পরিশোধে ভ্রান্তি, মুনাফা ভাগাভাগিতে অনিয়ম কিংবা শ্রম আইন লঙ্ঘনের কারণে প্রায়শই এ ধরণের মামলা-মোকাদ্দমা চলে থাকে। গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলির সবগুলোই এমনই। গ্রামীনের মামলাগুলি সম্ভবত প্রফেসর ইউনুসের বিশ্বজোড়া খ্যাতির জন্যই খবরের অংশ হয়ে থাকে, যা আর দশটি প্রতিষ্ঠানের থেকে ব্যতিক্রম।
আবার, প্রফেসর ইউনূসের মধ্যে একটি অলীক নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। যে কারণে হয়তো তিনি মনে করেন যে এই মামলা এবং তদন্তের উদ্দেশ্য কেবল তাকে হয়রানি করা। তার এমন মনস্তত্ত্বের পেছনে রয়েছে অদূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং তার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্রভাবশালী বন্ধুমহলের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা। ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশের সামরিক-সমর্থিত শাসনামলে নোবেল বিজয়ী ইউনূস প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই সময়ের আধা-বেসামরিক সরকার বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উভয়কেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বাদ দিতে চেয়েছিল। অনেকে অভিযোগ করেন যে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের স্থানীয় অফিসগুলি এই ষড়যন্ত্রের পিছনে ছিল। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশে তাদের আজ্ঞাবহ একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে। সেই জলঘোলা রাজনীতির মধ্যেই প্রফেসর ইউনূস তৎকালীন সরকারের আশীর্বাদে ‘নাগরিক শক্তি পার্টি’ নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। আ.লীগ-বিএনপি উভয় দলের নেতারা তখন তার উদ্যোগকে সন্দিহান দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। এইভাবে, অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তৎকালীন অবৈধ সরকারের সাথে মিলে একটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেন।
তবে, অর্থনীতিতে ঝানু হলেও তিনি রাজনীতিতে অদূরদর্শীতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি জনগণের স্বার্থ বুঝতে ব্যার্থ হয়েছিলেন কারণ জনগণ গণতন্ত্রের লড়াই অব্যাহত রেখেছিল। অবশেষে, একটি নির্বাচনের মাধ্যমে, সেই দুঃশাসনের অবসান ঘটে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হয়। সেইসাথে, ইউনূসের নাগরিক শক্তি পার্টিও বন্ধ হয়ে যায় জনসম্পৃক্ততার অভাবে। এবং গণতন্ত্রের বিপক্ষে ইউনূসের ভূমিকা জনপরিসরে তার ভাবমূর্তিকে অনেকটাই কলঙ্কিত করে।
এছাড়াও, তার বিশ্বব্যাপী প্রভাবের কারণে, ইউনূস প্রায়ই সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করতে অধ্যাপক ইউনূস তার প্রভাবশালী বন্ধুদের ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, প্রফেসর ইউনূস হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তদবির করেছিলেন যাতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে অর্থায়ন বন্ধ করা যায়। ড. ইউনূস এমনটি করেছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাকে বয়স বিবেচনায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।
তারপর থেকে, নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব এবং এক অলীক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। তাই সর্বশেষ চিঠিটি সরকারকে চাপ দেওয়ার জন্য একটি খোলা চিঠি লিখতে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রতি তার একটি অনুরোধ হতেই পারে।
যাই হোক, বাস্তবতা বলছে, অধ্যাপক ইউনূসকে নিয়ে সরকারের কোনো সমস্যা নেই। দুদক এবং এনবিআরসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কেবলমাত্র গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলির অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তাদের নিয়মিত কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য কোন ব্যক্তিবিশেষে- তথা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নয়।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, প্রফেসর ইউনূস বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবশালী বন্ধুমহলের কাছে তার নিছক নিরাপত্তাহীনতাকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছেন, যা তাদের চিঠিটি লিখতে এবং মানবিক কারণে এত মোটা টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে অনুপ্রাণিত করছে। কিন্তু বাস্তবে, তাকে মোটেও হয়রানি করা হচ্ছে না বরং, ‘রুটিন ওয়ার্ক’ই করা হচ্ছে। সম্ভবত, পুরো ব্যাপারটিতে একমাত্র হয়রানিমূলক অংশ, প্রফেসর ইউনূসের বৈশ্বিক খ্যাতির কারণে দুদক এবং এনবিআরের নিয়মিত তদন্তে গণমাধ্যমের অতিরিক্ত মনোযোগ এবং মনোযোগ সহকারে প্রতিটি ঘটনার খবর করা। পরিশেষে, চিঠিটি কেবলই একটি অপ্রয়োজনীয় উদ্বেগ প্রকাশমাত্র।
লেখক: রাজনীতি গবেষক ও বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
মত-দ্বিমত মতিউর রহমান সরকারের লক্ষ্য প্রফেসর ইউনূস নাকি দুর্নীতি-অনিয়ম?