আগুন মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার জরুরি
৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:১৩
ঢাকা: আবারও সর্বনাশা আগুনে সর্বস্বান্ত হলেন কয়েক হাজার মানুষ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যবসায়ের মালামাল পুঁজি নিঃস্ব হয়ে গেলেন তারা। ভোর ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লেগেছিল ঢাকার বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সে। ৬টা ১২ মিনিটেই ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিল ফায়ার ব্রিগেডের প্রথম ইউনিট। তারপর ঢাকার সব স্টেশন থেকে এবং আশপাশের জেলা থেকে একে একে এসেছে ৫০টি ইউনিট। তাদের সঙ্গে আগুন নেভাতে যোগ দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড, র্যাবের সবগুলো ইউনিট, আনসার, পুলিশ, রেড ক্রিসেন্টসহ অন্যরা।
আগুন নেভাতে ব্যবহার করা হয়েছে হেলিকপ্টার। ৬ ঘণ্টা পর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ভালো ব্যাপার হলো- নিহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীসহ কয়েকজন আহতকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
খুব সহজেই বলা হয়ে গেল ঘটনাটি। কিন্তু লেলিহান আগুন নেভাতে জীবন বাজী রেখে কী যুদ্ধ করতে হয়েছে দমকল কর্মীদের—তার বর্ণনা দেওয়া সহজ নয়। আর আগুনে সব পুড়ে গেছে যেসব ব্যবসায়ীর তাদের আহাজারি এবং সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কথা কী সহজে বলা যায়?
আগুন লেগেছিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে। এখানে চারটি মার্কেট-বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট। এখানেই ছিল তিন হাজারের উপর দোকান। আগুন এই কমপ্লেক্সের সবকিছু গ্রাস করে পাশের ৭ তলা আ্যানেক্স টাওয়ার, মহানগর কমপ্লেক্স মার্কেট, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ভবনের একটি বিল্ডিংয়ের ৫ তলা এবং পুলিশ মার্কেটের নীচ তলায় ছোবল দিয়েছে।
দোকান মালিক সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন প্রায় সাত হাজার দোকান পুড়েছে এই দানবীয় আগুনে। সামনে ঈদ। যার যা সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ জায়গা বেঁচে, কেউ ধার করে বাড়তি পুঁজি খাটিয়েছেন, বাকীতে মাল এনেছেন ঈদের বাজারে ব্যবসার জন্য। আগুন সব শেষ করে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সাত হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এই আগুনে।
এই যে ভয়াবহ আগুন, অসীম ক্ষতি– এর দায় কার? দায় অনেকের। অনেক আগে বঙ্গবাজারে গেছি। সংকীর্ণ জায়গায় গায়ে গায়ে লাগানো ছোট ছোট দোকান। দোকানী আর মানুষে গিজ গিজ অবস্থা। শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর। সচেতন যে কারোর জন্যই ভীতিকর অবস্থা। আগুন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থাই নেই। অন্য ধরণের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও বেরিয়ে যাওয়ার সহজ পথ নেই। এই পরিবেশে বছরের পর বছর ব্যবসা করছেন হাজার হাজার মানুষ। কোনো ধরণের সচেতনতা নেই। নিরাপত্তার উদ্যোগ নেই। মার্কেট কমিটির দায়বদ্ধতা নেই। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান,সংস্থার তদারকির দায়িত্ব তাদের কোনো তৎপরতা নেই। এ অবস্থা দেশের প্রায় সব মার্কেটেই। খুব বেশি দিন হয়নি নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটেও আগুন লেগে বিপুল ক্ষতি হয়েছে। সেটিও এমনি এক ঘিঞ্জি মার্কেট। কোনো ঘটনা থেকেই শিক্ষা নেওয়া হয় না কারোরই যারা এই মৃত্যুকুপে ব্যবসা করেন তাদের কিংবা যাদের তদারকি করার কথা তাদের। পরিণাম- একই ধরণের আগুন ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি। ক্ষয়ক্ষতি-আহাজারি। অনেকের নিঃস্ব হওয়ার করুণ কাহিনী।
এটি আগুন দুর্ঘটনার এক দিক। আরেক দিকেও একই চিত্র। এবার আগুন লাগার খবর পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যেই হাজির হয় দমকল বাহিনী কিন্তু আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ছিলেন অসহায়। এসব দৃশ্য আগুনের ঘটনার সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। শত শত মানুষ ভিড় করেন তাদের জন্য কাজ করতে পারেন না দমকল কর্মীরা। এবারও তারা বলেছেন মানুষের ভিড়ের কারণে তাদের কাজ করতে অসুবিধা হয়েছে। তা নাহলে আরও আগে আগুন নেভানো যেত। এই মানুষকে সামলাতে আনসার, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি কাজ করেছে তবুও সামলানো যায়নি। এসব মানুষকে সামলানোর উপায় বের করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
আরেকটি ব্যাপার দমকল বাহিনী প্রয়োজনীয় পানি পায় না। এবারও তাই হয়েছে। অনেক দূর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পাইপে পানি আনতে হয়েছে। আর হাতিরঝিল থেকে পানি এনেছে হেলিকপ্টার।
আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার ঘাটতিতে অনেক ক্ষেত্রেই অসহায় ছিলেন দমকলকর্মী ও সংশ্লিষ্টরা। দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সময় এখন যে কোনো দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস এবং উদ্ধারকারী অন্যান্য সংস্থাগুলোকে আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করা। বর্তমান যুগে শুধু পানি ছিটিয়েই আগুন নেভানো হয় না। আছে আধুনিক প্রযুক্তি। আমাদের সেগুলো নেই।
আগুন নেভানোর একটি আধুনিক প্রযুক্তি ফায়ারবল। যে কোনো ধরণের আগুনের ঘটনায় এটি খুবই কার্যকরী। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এই ফায়ার বল ব্যবহার করে। এটি পানি নিরোধক প্লাস্টিক খোসা দিয়ে তৈরি এক ধরণের বল যার ভেতরে থাকে নন টক্সিক মনো- অ্যামোনিয়াম ফসফেট নামের এক ধরণের রাসায়নিকের গুঁড়ো। খুব সহজেই এটি বহন করা যায়। এই বল আগুনে ছুড়ে দিলে খোসা গলে ক্যামিকেল বেরিয়ে বিক্রিয়া শুরু করে এবং দ্রুত আগুনের দাবানল নিয়ন্ত্রণে আসে। এগুলো খুব সহজে বহনযোগ্য, নিক্ষেপযোগ্য, নিরাপদ এবং খুব দামী নয়। এসব বল কাছে থাকলে ফারায়সার্ভিস আসার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করা যায়। আর ফায়ার সার্ভিসের কাছে থাকলে আগুণ নির্বাপণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবেন দমকল কর্মীরা। এসব বল আমদানি ও ব্যবহারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া দরকার।
বিশ্বের আধুনিক ফায়ারসার্ভিস বাহিনীগুলো এখন রোবট ব্যবহার করে। আমাদের দেশের মতো জায়গা যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সহজে যেতে পারে না সেখানে এবং বিপদজনক পরিস্থিতিতে ও দুর্গম স্থানে রোবট ব্যবহার করে পাইপের দ্বারা পানি ছিটানো যায়। বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসে এ ধরণের রোবট সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
আগেও দেখা গেছে এবং এবারও হেলিকপ্টারে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ চেষ্টা কতটুকু কার্যকরী ? কিন্তু এখন পানির জায়গায় বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়। হেলিকপ্টার থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ফোম কিংবা নাইট্রোগ্লিসারিনের মতো বিস্ফোরক ছিটিয়ে কমপ্রেসড এয়ার বা ঘনীভূত বাতাস তৈরি করে আগুন জ্বলার পথ বন্ধ করে দাবানল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমাদেরও এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে।
আর প্রায় দু’শো বছরের পুরনো কিন্তু কার্যকরী যে প্রযুক্তি ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ সেটিও আমাদের নেই। পানির মূল উৎসের সঙ্গে এটি একটি সংযোগ যা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ব্যবহার করা হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে পানির অভাবে দমকল কর্মীদের কাজ করতে যে অসুবিধায় পড়তে হয় এই ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে সে অসুবিধা হবে না। প্রতিটি বিল্ডিংয়ে, মার্কেটে, রাস্তায় পাশে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা করা উচিত।
বিশাল জনগোষ্ঠীর এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও স্থাপনার এই দেশে আগুন দুর্ঘটনা মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার জরুরি। সেই সঙ্গে সরকারের তদারকি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলতা ও জনগণের সচেতনতাও জরুরি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই