Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মঙ্গল শোভাযাত্রা: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই

তাপস হালদার
১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:১৯

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ,এসো এসো’ গানের মধ্য দিয়েই প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। নববর্ষ বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসব। বাঙালি হিসেবে এই একটি মাত্র উৎসব যা বাংলা ভাষাভাষি পৃথিবীর সকল বাঙালিরা পালন করে থাকেন।

সুদীর্ঘ কাল থেকে গ্রামীণ বাংলায় নববর্ষের প্রচলন থাকলেও ঢাকায় প্রথম নববর্ষ শুরু করে ছায়ানট। সেটাও আন্দোলনের প্রতিবাদ হিসেবে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালন ও রবীন্দ্র সংগীত প্রচারে বাধা প্রদান করে আইয়ুব খানের সরকার। প্রতিবাদে বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তৈরি হয় ছায়ানট নামে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৭ সালে ছায়ানটই রমনার খোলা মঞ্চে প্রথম বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু করে, স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে ব্যাপকতা বাড়তে থাকে।

বিজ্ঞাপন

১৯৮৯ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। তারপর পর থেকে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের প্রধান আকর্ষণে পরিনত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ বরাবরের মতই মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করে থাকে। পহেলা বৈশাখের ভোরে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার চারুকলায় ফিরে আসে। শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশ আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি দিয়ে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি যেমনি তুলে ধরা হয়, ঠিক তেমনি প্রতি বছর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে একটি ‘থিম’ বেছে নেয়া হয়, যা শান্তির পক্ষে, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রা পেয়েছে সার্বজনীনতা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কো কমিটি এ প্রসঙ্গে বলেছে, ‘এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক’।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের আয়োজনে এনে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। হাজার হাজার মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে প্রাণের টানে শোভাযাত্রায় শামিল হন। শোভাযাত্রা থেকে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরে অশুভ শক্তির বিনাশ ও সত্য সুন্দরের প্রার্থণা করা হয়। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির পর মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন আর রাজধানী ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই,জেলা উপজেলা পর্যায়ও ছড়িয়ে পড়েছে।

মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্টী গুলো ধর্মের দোহাই দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বানচাল করতে চায়। অথচ এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জন্মাষ্টমীতেও যেমন শোভাযাত্রা করে থাকে, ঠিক মুসলিমদেরও একটি অংশ মহরমে শোভাযাত্রা করে, যা সম্পূর্ণরূপে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বজনীন। যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ একসাথে মিলিত হন। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন।

বাংলা ১৪০৮ সনের (২০০১ সাল) পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে হামলা করে মৌলবাদীরা। তারা আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে ধংশ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু অজেয় বাঙালি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দিতে আরো ব্যাপক ভাবে পহেলা বৈশাখের চেতনা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। এখন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শুধুমাত্র রমনার বটমূল কিংবা শহর কেন্দ্রীকই সীমাবন্ধ নেই, এটি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এখন জাতীয় ভাবে অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ ভাবে বর্ষবরণের জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সরকারও ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনো নববর্ষকে গ্রহণ করেনি। এরা পাকিস্তান আমল থেকেই বিরোধিতা করে আসছে। শুধু তো নববর্ষ নয়, এরা ভাস্কর্য মানেনা, হিন্দুদের পূজা মানেনা, নারীদের স্বাধীনতা মানেনা, মুক্ত মনের মানুষদের নাস্তিক আখ্যা দেয়, এরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা কিছুই মানেনা। এরা জাতির চিহ্নিত শত্রু। এরা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা হাসিল করতে চায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও বাঙ্গালিয়ানাকে ধারণ করে, তাই মৌলবাদীরা কখনো সামগ্রিক ভাবে সুবিধা করতে পারেনি। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এদের বিস্তার বেড়েই চলছে।

পহেলা বৈশাখ শুধুমাত্র আনন্দ উৎসবই নয়, এটি প্রতিবাদের ভাষা থেকে জন্ম নিয়েছে। সেদিন প্রতিবাদ করেছিল পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে, আজও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে তাদের প্রেতাত্মা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সকল সাম্প্রদায়িকতা দূর করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হবে, মঙ্গল শোভাযাত্রার অঙ্গীকার।

নতুন বছরে সবার জীবনে সুখ শান্তি সমৃদ্ধির বয়ে আনুক, সেই শুভ কামনা করি। শুভ নববর্ষ-১৪৩০।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

তাপস হালদার মঙ্গল শোভাযাত্রা: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর