Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মে দিবসের কথা

অরুণ কুমার গোস্বামী
১ মে ২০২৩ ১৬:৪১

শ্রমিকরা কাজ না করলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে না। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর সময়েও তাদের কাজ করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ১ মে উপলক্ষে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ তথা শ্রমিকদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয় সে ঘটনা কিন্তু কোন কৃষি খামারের নয়। ঘটনাটা শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবীকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

আবার এটিও স্মরণ করা সঙ্গত যে শ্রমিকদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। এভারেট কার্টার (১৯৫০) যেমনটি বলছেন,“শিল্প প্রায়শই শুধু শিল্পের স্বার্থে তত বেশি নয় যতটা এটি মানবতার স্বার্থে।” যে কোন সাহিত্য-ভাল সাহিত্য কিংবা সস্তা এবং অনুভূতিপ্রবণ সাহিত্য অনিবার্যভাবে একটি জাতীয় অন্যায়ের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করে। এই সত্য ১৯৭১ এর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যা, সাম্প্রতিককালে বিএনপি-জামাত আমলে কৃষক হত্যার ঘটনা বা কুখ্যাত খুনী এরশাদ শিকদার কর্তৃক ১৯৮৬-২০০৩ এর মধ্যে ৭০টির বেশী হত্যাকান্ড ঘটনার দ্বারা প্রদর্শিত হয়।

বিজ্ঞাপন

ঊনবিংশ শতাব্দীর জন্য এটি ছিল ৪ মে, ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে বোমা বিস্ফোরণের পর চার নৈরাজ্যবাদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া সাহিত্যিক প্রতিক্রিয়ার পাঠ। শ্রমিকদের ওপর পরিচালিত শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের ভিত্তিতে লেখা অন্যতম সাহিত্যকর্ম হচ্ছে রুশ সাহিত্যক ম্যাক্সিম গোর্কির (১৮৬৮-১৯৩৬) কালজয়ী উপন্যাস ‘মাদার’। যদিও এটি লেখা হয়েছিল রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে। ‘মাদার’ উপন্যাস প্রকাশকাল ১৯০৬। এই বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল হে মার্কেট স্কোয়ারের ঘটনার ভিত্তিতে লেখা উপটন স্নিক্লেইর(১৮৭৮-১৯৬৮)-এর ‘দ্য জাঙ্গল’ এবং ১৯০৭ সালে প্রকাশিত জ্যাক লন্ডন(১৮৭৬-১৯১৬)-এর ‘দ্য আয়রন হিল’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো সবই শ্রমিকদের দুর্দশাগ্রস্থ সংগ্রামী জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে।

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমি যেবার নাট্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম তখন ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে ‘মা’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম। ‘মা’ বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির একটি জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদার’ এর নাট্যরূপ। এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের এই নাটক মঞ্চায়ন সে সময় খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৬/০৭ সালে। এই উপন্যাসে গোর্কি একটি রুশ কারখানায় কর্মরত একজন নারীর জীবনী শৈল্পিক নৈপুন্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এই নারী অন্যান্য অনেক কঠিন কাজের পাশাপাশি কায়িক শ্রম, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বিখ্যাত এই উপন্যাসটির নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করার ফলে ‘মা’ এর অনেক চরিত্র আমার আজও কিছুটা মনে পড়ে যেমন, পেরাগুইয়ে নিলোভনা ভ্লাসভা(মা), মদ্যপ স্বামী, পুত্র পাভেল ভ্লাসভ, সোফিয়া, নাতাশা, শাশা এবং লুদমিলা প্রভৃতি। উপটন সিনক্লেইর-এর ‘দ্য জাঙ্গল’ এবং জ্যাক লন্ডন-এর ‘দ্য আয়রন লেডি’ প্রভৃতি সাহিত্য কর্মের সর্বাধিক রসদবাহী ঘটনা হচ্ছে ১৮৮৬ সালের শিকাগো নগরীর হে মার্কেট স্কোয়ারের ঘটনা। যে ঘটনা ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মর্যাদা দান করেছে, সেই ঘটনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার দাবী আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা সংগ্রাম করছিল। কাজের পরিবেশ ছিল খুবই খারাপ এবং ১০ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করার ব্যাপারটি ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। কর্মস্থলে সচরাচর মৃত্যুবরণ করা এবং আঘাত পেয়ে আহত হওয়া ছিল নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। এসব ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই অনেক লেখা হয়েছে। ১৮৬০ সালের দিকে শ্রমিকেরা বেতন কর্তন না করে কর্মদিবস কমানোর দাবী জানিয়ে আসছিল। তবে ১৮৮০ সালের আগে সংগঠিত শ্রমিকেরা দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার ঘোষণা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। অনেক শ্রমিকদের দাবী অনুযায়ী এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যার প্রতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি ছিল না।
এই সময়, শ্রমিকদের কাছে সমাজতন্ত্র ছিল একটি নতুন অথচ খুবই আকর্ষণীয় ধারণা, অনেকেই এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যে উৎপাদন ও পণ্যের বন্টন ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রনে থাকবে। শ্রমিকেরা এই প্রথম দিকে লক্ষ্য করল যে পুঁজিবাদ শ্রমিকদের জীবন নিয়ে বানিজ্য করে মালিকেরা লাভবান হয়। কর্মস্থলে প্রতিবছর হাজার হাজার পুরুষ, নারী এবং শিশু অপ্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করছে। ফলে কোন কোন শিল্পে শ্রমিকদের গড় আয়ু খুবই কম ছিল, মৃত্যু ছাড়া এই চরম দুর্গতি থেকে বের হওয়ার জন্য খুব কমই আশা ছিল। এক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র অন্য একটি উপায় বেছে নেয়ার সুযোগ করে দিল।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের উদ্ভব ঘটতে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সঙ্গীতগোষ্ঠী সবই ছিল। বস্তুত, সেময় নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে অনেক সমাজতন্ত্রী নির্বাচিত হচ্ছিলেন। কিন্তু এখানেও সমাজতন্ত্রীদের অনেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী এবং দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কারণে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। হাজার হাজার সমাজতন্ত্রী তাদের দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছিলেন এবং সমস্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করছিলেন। এইসব দল এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সম্পদশালীদের রক্ষার হাতিয়ারের বেশী বিবেচনা করা হতো না। আর এভাবেই সমগ্র দেশব্যাপী নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো সৃষ্টি হচ্ছিল। আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার শ্রমিক নৈরাজ্যবাদী আদর্শ অনুসরণ করা শুরু করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল সরকারসহ সকল পাদসোপানভিত্তিক কাঠামোর পরিসমাপ্তি ঘটানো, শিল্প-কারখানা পরিচালিত হবে শ্রমিকদের দ্বারা, এবং আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপরে প্রত্যক্ষ কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি বলা যথার্থ হবে না যে নৈরাজ্যবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিক ইউনিয়নগুলো দখল করেছিল, বরঞ্চ এটি বলা সঙ্গত যে নৈরাজ্যবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরি করছিল।

১৮৮৪ সালে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়নস (যা পরে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল)-এর জাতীয় কনভেনশনে ‘১৮৮৬ সালের ১ মে এবং এরপর থেকে আট ঘন্টা বৈধ শ্রম দিবস’ হওয়ার কথা ঘোষণা দেওয়া হয়। পরের বছর, শ্রমিক সংগঠনসমূহের এই ফেডারেশন স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে তাদের পূর্বের ঘোষণা পুনরায় জানিয়ে দেন। এই সাথে তারা এটিও বলেন যে এই দাবীর সমর্থনে ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ মিছিল হবে। প্রথম দিকে, বেশীরভাগ চরমপন্থী এবং নৈরাজ্যবাদীরা এই দাবীকে ‘সব অপকর্মের মূলে’ আঘাত করতে ব্যর্থ হয়ে অতি সংস্কারপন্থী দাবী হিসেবে গণ্য করত। হে মার্কেট হত্যাকান্ডের এক বছর আগে স্যামুয়েল ফিল্ডেন নৈরাজ্যবাদীদের সংবাদপত্র দ্য অ্যলার্ম-এ বলেন যে ‘একজন মানুষ দৈনিক আট ঘন্টা বা দশ ঘন্টা কাজ করুক না কেন, তিনি কিন্তু তখনও দাসই থাকছেন’।

ন্যায়সঙ্গত দাবীর এই সংগ্রামকে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনেক নৈরাজ্যবাদীদের সন্দেহ সত্ত্বেও শিকাগো এলাকার প্রায় আড়াই লক্ষ শ্রমিক আট ঘন্টা কর্মদিবস বাস্তবায়নের দাবীর সংগ্রামে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ট্রেডস অ্যান্ড লেবার অ্যাসেম্বলি, সোসালিস্ট লেবার পার্টি এবং স্থানীয় শ্রম নাইটস প্রভৃতি। বেশী সংখ্যক শ্রমিক তাদের নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল। ‘মতামতের স্রোত এবং বেশীরভাগ মজুরী-শ্রমিক দাবীর প্রতি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ’ হওয়ার প্রেক্ষিতে চরমপন্থীগণ ৮ ঘন্টা দাবী স্বীকার করে নিচ্ছিল। কিন্তু নৈরাজ্যবাদীদের সম্পৃক্ত হবার সাথে সাথে ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের চেয়েও বৃহত্তর ইস্যু এই আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছিল। তাৎক্ষণিক সংক্ষিপ্ত কর্মদিবসের ঘোষণার বাইরেও বৃহত্তর সামাজিক বিপ্লবের অনুভূতি এমনকি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর জোরালো পরিবর্তনের চেতনা জন্ম দিচ্ছিল।

১৮৮৬ সালের ১ মে’র কিছু আগে একজন প্রকাশক শ্রমিকদের প্রতি যে আবেদন জানিয়েছিলেন সেগুলো ছিল, (১) শ্রমিকেরা সশস্ত্র হবেন (২) প্রাসাদে হবে যুদ্ধ, কুঁড়েঘরে শাণিত এবং বিলাসবহুল কর্মহীনতার মৃত্যু (৩) বিশ্বের দুর্গতির একমাত্র কারণ হচ্ছে মজুরী ব্যবস্থা (৪) ধনীক শ্রেণী এই ব্যবস্থাকে সমর্থন দিচ্ছে। এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হয় একে উপযোগী করতে হবে অথবা মৃত্যুবরণ করতে হবে (৫) ব্যালটের স্তুপের চেয়ে এক পাউন্ড ডিনামাইট ভালো (৬) পুঁজিবাদী কুকুর, পুলিশ, এবং মিলিশিয়াদের যথোপযুক্তভাবে মোকাবিলা করার জন্য অস্ত্র হাতে আপনার আট ঘন্টা কর্মদিবসের দাবী উত্থাপন করুন।

এটি কোন বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, প্রায় এখন থেকে কয়েক দশক আগে (১৮৭৭ সালে) রেলপথ ধর্মঘটে পুলিশ এবং সৈন্যদের গুলিতে শত শত ধর্মঘটকারী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করে সমস্ত নগরী ১৮৮৬ সালে ব্যাপক রক্তপাতের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ১৮৮৬ সালের ১ মে, সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী ১৩,০০০ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ৩,০০,০০০-এরও বেশী শ্রমিক ইতিহাসের প্রথম মে দিবস উদযাপনের জন্য কর্মবিরতিতে গিয়েছিল। ৮ ঘন্টা কর্মদিবসকেন্দ্রীক বিক্ষোভকারীদের ভরকেন্দ্র শিকাগো নগরীতে ৪০,০০০ শ্রমিক জনসমক্ষে নৈরাজ্যবাদীদের সামনে নিয়ে ধর্মঘটে গিয়েছিল। অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা এবং বিপ্লবী মতাদর্শের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের কারণে ‘নৈরাজ্যবাদী এবং নৈরাজ্যবাদ’ শ্রমিকদের কাছে শ্রদ্ধা এবং পুঁজিবাদীদের দ্বারা ঘৃণিত হয়ে ওঠে।

অনেকের নাম আলবার্ট পিয়াসন্স, জোহান স্পাইস এবং লুই লিং শিকাগো এবং সমগ্র দেশব্যাপী পরিচিত শব্দে পরিণত হয়। প্যারেড, ব্যান্ড এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারীদের পদভারে রাজপথ প্রকম্পিত হতে থাকে, যার দ্বারা শ্রমিকদের শক্তি ও ঐক্য ব্যক্ত হয়েছিল। তথাপি, সংবাদপত্র এবং কর্তৃপক্ষ যেমনটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কিন্তু সহিংস হয় নাই। ক্রমান্বয়ে বেশী সংখ্যক শ্রমিক কর্মবিরতিতে যাচ্ছিল এবং এভাবে কর্মবিরতিতে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা ১,০০,০০০ উপনীত হয়, তথাপি শান্তি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু দুই দিন পর ১৮৮৬ সালের ৩ মে ম্যাকক্রোমিক রিপার ওয়ার্কস-এ পুলিশ এবং ধর্মঘটীদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে।

স্কটল্যান্ড বংশোদ্ভূত প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্ট অ্যালান পিনকার্টনের অস্ত্রধারী গোয়েন্দা এবং পুলিশ পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণরত ইস্পাত কারখানার শ্রমিকদের নিপীড়ন, নির্যাতন ও প্রহার করতে থাকে। এইসব শ্রমিকদের অধিকাংশ ‘নৈরাজ্যবাদীদের প্রভাবাধীন’ মেটাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নভূক্ত ছিলেন। ম্যাকক্রোমিক প্লান্টের নিকট একটি বক্তৃতা চলাকালে প্রায় দুইশত বিক্ষোভকারী ইস্পাত শ্রমিকদের সাথে পিকেটিংয়ে যোগ দেয়। এভাবে শ্রমিক পুলিশ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ে। কমপক্ষে দুইজন শ্রমিক নিহত হয় এবং অজানা সংখ্যক শ্রমিক আহত হয়।

পুলিশের নিষ্ঠুরতা নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ক্রোধোন্মত্ত শ্রমিকেরা পরের দিন হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি জনসভা আহ্বান করে। স্বল্প সময়ের নোটিশ এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে আগের দিনের তুলনায় কমসংখ্যক শ্রমিক, প্রায় ৩০০০ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানে শিশুসহ কয়েকটি পরিবার এবং শিকাগোর মেয়র স্বয়ং উপস্থিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মেয়র এই মর্মে স্বাক্ষী দিয়েছিলেন যে জনতা শান্ত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল এবং স্পিকার আগস্ট স্পাইস তার বক্তৃতায় কোনরূপ সহিংসতার কথা বলেন নাই।

এ বক্তৃতা যখন শেষ হয়ে আসছিল, তখন দুইজন গোয়েন্দা নিকবর্তীস্থানে দন্ডায়মান পুলিশের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট করে যে একজন বক্তা জ্বালাময়ী ও উস্কানীমূলক বক্তৃতা দিচ্ছে। এর ফলে পুলিশ বক্তৃতা মঞ্চের দিকে এগোতে থাকে। জনতাও তখন চলে যাচ্ছিল আর পুলিশও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার কাজ শুরু করেছিল। ঠিক সেই মূহুর্তে পুলিশের দিকে একটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কে বা কারা বোমা নিক্ষেপ করেছিল একথা কেউই বলতে পারে নাই। তবে, এ ব্যাপারে যেসব সন্দেহ করা হয় সেগুলোর মধ্যে ‘নৈরাজ্যবাদী এবং গোয়েন্দা’ উভয়েই আছে। বোমা আক্রান্ত হয়ে ক্রুব্ধ পুলিশ জনতার প্রতি গুলিবর্ষণ করে। এতে কতজন নিহত বা আহত হয়েছিলেন তা কখনই নির্ধারণ করা যায় নাই, তবে একটি অনুমান করা হয় যে সাত বা আট জন নিহত এবং প্রায় চল্লিশজন আহত হয়েছিলেন। একজন অফিসার সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করেছিল এবং আরও সাতজন পরের সপ্তাহগুলোতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

হে মার্কেট স্কোয়ারের ঘটনায় আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, আলবার্ট পার্সন্স, অগাস্ট স্পাইস, স্যামূয়েল ফিল্ডেন, অস্কার নীবি, মিশেল সোয়াব, জর্জ এঙ্গল, অ্যাডলফ ফিশার, এবং লুই লিং। তাদেরকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও এদের মধ্যে মাত্র তিনজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। গ্রেফতারকৃতদের বিচারের জন্য যে জুরিবোর্ড গঠন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ছিলেন! সমস্ত বিশ্ব এই বিচারকার্য পর্যবেক্ষণ করেছে। ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর অনেক ব্যর্থ চেষ্টার পর পার্সন্স, স্পাইস, এঙ্গেল এবং ফিশারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। লুই লিং আমেরিকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দাবী এবং তাদের শাস্তির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবাদস্বরূপ নিজের মুখে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ছয় বছর পরে ফিল্ডেন, নীবি এবং সোয়াবকে গভর্নর অ্যালটগেল্ড ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হে-মার্কেট স্কোয়ারে গ্রানাইট পাথরে ১৮ ফুট দীর্ঘ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। এখানে আন্দোলনকারীদের শাস্তি দেওয়ার বছর ১৮৮৭ এর সাথে লেখা হয়েছে- ‘দে ডে উইল কাম হোয়েন আওয়ার সাইলেন্স উইল বি মোর পাওয়ারফুল দ্যান দ্যা ভয়েসেস ইউ আর থ্রোটলিং’ অর্থাৎ এমন একদিন আসবে যখন আমাদের নীরবতা তোমরা যে কন্ঠকে থামিয়ে দিলে তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী হবে। এখন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয় বাংলাদেশসহ প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।

লেখক : অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্রাসি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থের লেখক। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্বিবিদ্যালয় এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা

মে দিবসের কলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর