আরেক একাত্তরে পাকিস্তান
১৩ মে ২০২৩ ১৫:৫৫
রাগে-ক্ষোভে বা রাজনৈতিক কথার মারপ্যাঁচে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ দেশটির বর্তমান অবস্থাকে একাত্তরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার উপলব্ধি পাকিস্তান আবার একাত্তরের পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাজনীতি ও আইনি লড়াই প্রসঙ্গেই তার এ অভিব্যক্তি? আশপাশে আর কিছু নেই? ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধিপত্যে মোটামোটি আঘাত হেনেছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এত খোলামেলাভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। কখনো কখনো নাখোশ হয়েছে। দু’চারটা গরম কথা বলেছে। কিন্তু, কোনো দলের নেতাকর্মীরা সেনাবাহিনী বা সেনাস্থাপনার ওপর হামলা করেনি। এবার ঘটলো সেই ধারনাতীত ঘটনা। এতে ক্ষুব্ধ সেখানকার ক্ষমতাসীনরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বাজ ফাটালেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ। ইমরান ও তার সমর্থকদের বাংলাদেশপন্থী এবং দেশটির সেনাবাহিনীসহ নিজেকে দাবি করলেন পাকিস্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে।
ইমরানে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের তরুণ, নারী ও নাগরিক সমাজ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। এর মাঝে আবার সেখানকার স্যোশাল মিডিয়ার একটি পোস্ট আচ্ছা রকমের তোলপাড় বাধিয়েছে। ‘আমি একজন সম্মানিত সৈনিকের মা হতে চাই; একজন অসম্মানিত, ঘৃণিত জেনারেলের মা নয়’- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের মায়ের এমন প্রতিক্রিয়া ব্যাপক ভাইরাল দেশটিতে। অবস্থা এমন জায়গায় গেছে পাকিস্তান এমন একটা দেশে পরিণত হয়েছে আফগান তালেবান সরকারও তার নিন্দা করে।
পাকিস্তানে এর পরের প্রেক্ষাপট কী? আবার একটি একাত্তর হবে? যায় দিন চলে যায়, আগের ঘটনা হুবহু ঘটে না। ধরন বা ধাঁচ এক হয়। আরেকটি একাত্তর হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে আর যুদ্ধ বাধবে না। তবে, ধারনা ও ধরনে দেশটির অবস্থা গুরুচরনের দিকে যাচ্ছে। মাস কয়েক আগে, শ্রীলংকায় ক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ভাঙচুর করে তা দখলে নেয়। সুইমিং পুলে সাতার কাটে, খাবার লুট করে। আর পাকিস্তানে কোর কমান্ডারের বাসা জ্বালিয়ে দেয় জনতা, লুট করে ফ্রিজের খাবার, এমনকি সেখানে থাকা ময়ুর পাখিগুলোও। রান্না ঘরে থাকা কোরমা, সালাদ, মাংস, স্ট্রবেরিও নিয়ে গেছে প্রতিবাদকারীরা। এগুলো প্রতিবাদের একটা তাৎক্ষনিক ক্রিয়া। মানুষের ক্ষোভের মাত্রা নিয়ে কথা। ময়ুর পাখি নিয়ে চলে যাবার সময় একজনকে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে কি জন্য পোষা এই পাখিটাকে নিয়ে যাচ্ছেন? ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারী উত্তর দেয় এগুলো জনগণের করের পয়সায় কেনা? কেন এসব করের পয়সায় কেনা হবে, পালা হবে?
শ্রীলংকার জনগণের প্রতিক্রিয়া ও মতিগতিও অনেকটা এমনই ছিল। এ রকম সময়ে পেয়ারে জিগাররা কেটে পড়ে। এটা বরাবরের ইতিহাস। শ্রীলংকার মেগা প্রজেক্ট হাম্বানটোটা বন্দর, বিমান বন্দর, এক্সপেসওয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। হাই হ্যান্ডেডনেস সব শেষ করেছে। সেসব প্রকল্পের বুদ্ধি দেয়া পরাশক্তি শ্রীলংকাকে বাঁচাতে আসেনি তাদের কোন কথিত পেয়ারে জিগার । পাকিস্তানেও এখন সেই নজির। মানুষ আমলাতান্ত্রিকতা ও সামরিকায়নে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মুক্তিপাগল হয়ে উঠেছে দেশটিতে। এখন সুযোগ পেয়েছে তো ফুঁসে উঠেছে। পিপলস পাওয়ার এমনই। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তা পাকিস্তানের মতো সামরিক-বেসামরিক সমর্থনে চলা পরাক্রমশালী লুটেরা সরকার হলেও। এক ঘণ্টার মধ্যে পাল্টে যাওয়ার আলামত তৈরি করে দিয়েছে ওই পিপপলস পাওয়ার। এর মাঝে মূখ্য ভূমিকা নিয়েছে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। নজিরবিহীন আদেশে ইমরান খানকে জামিনে মুক্ত করে চমক দেখিয়েছে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট। ইমরান খান যখন আদালতে পৌঁছান তাকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আপনাকে দেখে ভালো লাগছে। ইমরানের মুক্তির আদেশ শুনে পাকিস্তানের রাস্তায় জনতার বিজয় উল্লাস। শাহবাজ শরিফ যেখানে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ইমরান খানকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বিদায় পাকিস্তানের ইতিহাসে নেই।
সামনে শক্তিশালী এ সেনাবাহিনীটির ভূমিকা কী হবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরা ইমরান খানকে জোরপূর্বক ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গন থেকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটিকে সেনাবাহিনীর মধুর প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন। সেনাবাহিনী সব দেশে আছে-থাকবে। কিন্তু পাকিস্তানে ভিন্ন। তারা দেশটিতে ছড়িই ঘোরায় না। ক্ষমতায় বসানো-নামানোতে মূখ্য ভূমিকা রাখে। একাত্তরে এ চর্চা বেশি করতে গিয়ে দেশ্ ভেঙে ছেড়েছে। ভাতে মরা বাঙালির লাঠির কাছে হেরে কলঙ্কিত হয়েছে বিশ্বসেরা একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। এখন নিজ দেশের জনগনেরই লাথি-গুঁতার শিকার। আজকের পাকিস্তান আর একাত্তরের পাকিস্তানের মধ্যে মিল-অমিল দুটাই আছে। পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া নেই। চলছে শাহবাজ শরিফের শাসন। এরপরও পতন প্রশ্নে সেখানে একাত্তর বড় প্রাসঙ্গিক। একাত্তরে মুখোমুখি ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। ২০২৩ সালে শাহবাজ শরিফ ও ইমরান খান মুখোমুখি। উভয়ের সম্পর্ক পাঞ্জাবের সাথে। পাঞ্জাবের সামনে পাঞ্জাব। একাত্তরে বাঙালিদের গাদ্দার ডাকতো পাঞ্জাবি-পাঠানরা। অবশ্য গাদ্দার গাল দেয় তাদের একটা সংস্কৃতি। পাকিস্তান গঠনের পর থেকে ৭৫ বছর ধরে বাঙালি, বেলুচ, পাখতুন ও সিন্ধিদের গাদ্দার আখ্যায়িত করে যাওয়া হচ্ছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নওয়াব নওরোজ খান জারাকজাই, বাচাখান, আলতাফ হোসাইন ও বেনজীর ভুট্টোসহ বহু গাদ্দার রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইংরেজদের তৈরি আইন ২৪-এ ব্যবহার করা হয়েছে।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জমানায় জাভেদ হাশেমী ও আখতার মিঙ্গালের বিরুদ্ধে ২৪-এ ধারায় মামলা হলে সেখানকার লেখক-সাংবাদিক মহল একটু আধটু সমালোচনা আসে। ইমরান খানের শাসনামলে এ গাদ্দার দমন আইনে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২০২০ সালে রেজা রব্বানি আইনটি বাতিলের বিল আনলে ইমরান খানের সরকার বিলের বিরোধিতা করে। শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় এসেও গাদ্দার দমান এ আইনে। এর বেশি শিকার ইমরান ও পাঞ্জাবিরা। এরপরও তাদের স্বস্তি লাহোর হাইকোর্টের ২৪-এ আইনকে পাকিস্তানের অস্তিত্ববিরোধী বা নামসর্বস্ব ঘোষণা করা। এ ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ প্রকাশ করেছে তেহরিকে ইনসাফের লোকেরা। এতেই কি আর শাসকরা দমে? আরো কতো অস্ত্র তাদের হাতে। এখন সেখানে খরার টান পড়েছে। যে খরা তাদের নিয়ে যাচ্ছে পেছনে একাত্তরের যন্ত্রণার দিকে। এ যন্ত্রণা থেকে পাকিস্তানের জনগণেরই বা কতোটা মুক্তি মিলবে?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই