যে দিনটিতে লেখা আছে বাংলাদেশের গৌরবগাঁথা
১৭ মে ২০২৩ ১৫:৩৭
১৭ মে; দেশনেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। যে দিনটিতে লেখা আছে বাংলাদেশের গৌরবগাঁথা। পাঠকরা হয়ত ভাবতে পারেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেবল একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। কিন্তু বিষয়টি আদৌ তা নয়। কারণ তিনি মহাকালের ইতিহাসের অংশ। তার সেই জীবন-ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিন হলো ১৭ মে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিনটি কেবল তার জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এদেশের শাসনকার্যে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসীন থেকে মহিমান্বিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহাকালকে স্পর্শ করতে সক্ষম। এর কারণ আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি লিখেছেন ‘আমাদের অধিকাংশেরই সুখদুঃখের পরিধি সীমাবদ্ধ; আমাদের জীবনের তরঙ্গক্ষোভ কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই অবসান হয়।…কিন্তু পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক লোকের অভ্যুদয় হয় যাহাদের সুখদুঃখ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সহিত বদ্ধ। রাজ্যের উত্থানপতন, মহাকালের সুদূর কার্যপরম্পরা যে সমুদ্রগর্জনের সহিত উঠিতেছে পড়িতেছে, সেই মহান কলসংগীতের সুরে তাহাদের ব্যক্তিগত বিরাগ-অনুরাগ বাজিয়া উঠিতে থাকে। তাহাদের কাহিনী যখন গীত হইতে থাকে তখন রুদ্রবীণার একটা তারে মূলরাগিণী বাজে এবং বাদকের অবশিষ্ট চার আঙুল পশ্চাতের সরু মোটা সমস্ত তারগুলিতে অবিশ্রাম একটা বিচিত্র গম্ভীর, একটা সুদূরবিস্তৃত ঝংকার জাগ্রত করিয়া রাখে।’ অর্থাৎ শেখ হাসিনার ‘সুখদুঃখ জগতের বৃহৎব্যাপারের সঙ্গে বদ্ধ’। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা। অন্যদিকে বিশ্বকবির ভাবনাসূত্রে বলা যায়, শেখ হাসিনাকে কেবল ব্যক্তিবিশেষ বলে নয়, বরং মহাকালের অঙ্গস্বরূপ দেখতে হলে, দূরে দাঁড়াতে হয়, অতীতের মধ্যে তাকে স্থাপন করতে হয়, তিনি যে সুবৃহৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে ৪২ বছর প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আছেন সেটা সুদ্ধ তাকে এক করে দেখতে হয়। এদিক থেকে তিনি ‘ইতিহাসস্র্রষ্টা মহান ব্যক্তিত্ব’। খণ্ড ক্ষুদ্র বর্তমান কালে তার কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রামকে একীভূত করে দেখতে হবে।
আজ ১৭ মে ইতিহাসের একটি বিশেষ দিন।কারণ অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ হাসিনার ৪২তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন প্রিয় জন্মভূমিতে। বাংলাদেশ তারপর থেকে নতুন করে পথ চলা শুরু করে। তার প্রত্যাবর্তনের পর এদেশ পুনরায় ‘জয় বাংলা’র বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল। ৪২ বছর পূর্বের সেই দিনটি এখনকার মতো ছিল না। সেদিন ছিল ভারী বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার এক অপরাহ্ণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনার পদস্পর্শে সেই জল্লাদের দেশ পুনরায় সোনার বাংলা হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় মুখরিত হয়েছিল।
আজ তার প্রমাণ পাচ্ছি আমরা। নারী নেতৃত্বাধীন সিঙ্গাপুর, হংকং, জর্জিয়া, নামিবিয়া, নেপাল, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কদের ওপর আলোকপাত করার সময় বলা হয়, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের মহামারির সংকট মোকাবিলায় দ্রুত সাড়া দিয়েছেন, যাকে প্রশংসনীয় বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। তবে একথা সত্য, বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসা পাবার জন্য শেখ হাসিনা কাজ করেন না। তার দিনপঞ্জি জুড়ে আছে দেশের জন্য ব্যস্ত সময়ের কর্মকাণ্ড। আর তার এই বর্তমান নেতৃত্ব সম্ভব হয়েছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শেখ হাসিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছের মানুষে পরিণত হয়েছেন। অথচ ১৭ মে তার দেশে ফেরা ছিল অতি সাধারণ, কারণ সেভাবেই তিনি দেশের জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। সেদিন তিনি এক বৃহৎ শূন্যতার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এদেশে তার ঘর নেই; ঘরের আপনজনও কেউ নেই। তাই সারা দেশের মানুষ তার আপন হয়ে উঠল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈর-শাসকরা বোঝাতে চেয়েছিল তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের। সেনা শাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাতদিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি নেতা কিন্তু তারও বেশি তিনি কর্মী। কারণ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তার শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা তার প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো। দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত বর্ণনা আছে তার নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ।’ তার ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৭ মে) আগে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুইদিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানবো না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবোই করবো।’ তাই তো কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।
১৭ মে দিনটি এদেশের ইতিহাসের আলোকবর্তিকা। সেদিন থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এতোদিন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সেই বছরই শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং জিয়ার অভিসন্ধি ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লক্ষ মানুষের বাঁধ ভাঙা স্রোত তাকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল বিচিত্র ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি। শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম, ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ আরও ছিল- শেখ হাসিনা আসছে, জিয়ার গদি কাঁপছে, গদি ধরে দিব টান জিয়া হবে খান খান। আবালবৃদ্ধ জনতা আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।’
সেদিনের প্রত্যয় শেখ হাসিনা ও তার সরকারই বাস্তব করে তুলেছেন। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে এনে শীঘ্রই ফাঁসি দেওয়া হবে বলে আমরা মনে করি। ১৭ মে সম্পর্কে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদ ছিল এরকম ‘ঐদিন কালবোশেখির ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ৬৫ মাইল। এবং এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় ছিল।’ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমান থেকে নেমেই তিনি দেশের মাটিতে চুমু খান। এ সময় বিপুল জনতার বিচিত্র স্লোগান মুখরিত করে তুলেছিল ঢাকার রাজপথ। যেন সূর্যোদয় হয়েছে, নতুন দিনের পথ চলা শুরু হলো। অশ্রুসজল সেই দিনের কথা আছে নানাজনের স্মৃতিচারণে। ঢাকা শহর তখন মিছিলের নগরী। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বিকাল ৩.৩০ মিনিটের পর বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি মাটি স্পর্শ করার আগেই হাজার হাজার উৎসাহী জনতা সকল নিয়ন্ত্রণের সীমা, নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে ফেলে। নিরাপত্তা কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় অবশেষে তিনি নেমে আসেন; হাত নেড়ে জনতাকে শুভেচ্ছা জানান। কিন্তু তার অন্তরে ততক্ষণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। বিকাল ৪.৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা একটি ট্রাকে ওঠেন। এ সময় বজ্রনিনাদে জনতার স্লোগান চলছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক যখন ফুলের মালা পরিয়ে অভিবাদন জানান তখন বাঁধ ভাঙা কান্নার জোয়ার এসে ভাসিয়ে দেয় শেখ হাসিনাকে; কেঁদে ওঠেন তিনি। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি কেবল পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গেই তুলনীয়।
শেখ হাসিনার ফিরে আসা খুব বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জনতার স্বার্থে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি তার প্রত্যাবর্তনের আগে নৈরাজ্যের যাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছিল মানুষ। পাকিস্তানি শাসক, দালাল-রাজাকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং আপামর জনগণের অংশগ্রহণে ৯ মাসের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার প্রচেষ্টা সফল হতে দেয় নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সামরিক শাসকদের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। দেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশের প্রতিকূল এক সময়ে জননেত্রীকে আমরা রাজনীতির মঞ্চে পেলাম। তিনি দায়িত্ব নিলেন এবং লাখো জনতার সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন ‘আজকের জনসভায় লাখো লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোন দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। …বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ গত চার দশক ধরে দেশি-বিদেশী চক্রান্ত ও হাজারও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি জনগণের পাশেই আছেন; ভবিষ্যতে থাকবেনও। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল পর্যন্ত একাধিক বার বন্দি অবস্থায় নিঃসঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে তাকে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশ ও জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তনের মতো শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনও ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারির পর তার দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ১৬ জুলাই যৌথবাহিনী তাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে ৩৩১ দিন কারাগারে বন্দি করে রাখে। সেসময় গণমানুষ তার অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তার সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেফতারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেছিল। কারণ সে সময় আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে এদেশকে নরকে পরিণত করেছিল। নেত্রীকে গ্রেনেড, বুলেট, বোমায় শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক; এখনো তেমনটাই আছেন। নতুন প্রজন্মকে যথার্থ ইতিহাসের পথ দেখিয়েছেন তিনি নিজের রাজনৈতিক সততার মধ্য দিয়ে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে একাধিকবার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৬ আগস্ট জননেত্রীর ওপর ঢাকায় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর তার বাসভবন আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি- শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে একটি বিরাট মিছিল নগরীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৪০ জন নিহত হন। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনের সময় ধানমন্ডিতে তার ওপর বন্দুকধারীরা রাসেল স্কোয়ারে আক্রমণ চালায়। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর- ট্রেনে ভ্রমণকালে ঈশ্বরদী ও নাটোরে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা জননেত্রীর ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। এভাবেই দেশ-বিদেশে কখনও গোপনে কখনও বা প্রকাশ্যে চলেছে হত্যার ষড়যন্ত্র। ২০০০ সালের ২০ জুলাই পূর্ব নির্ধারিত জনসভাস্থল কোটালিপাড়া থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি বিস্ফোরকের বোমা উদ্ধার করা হয়। ২০০৪ সালের ৫ জুলাই তুরস্কে সফরের সময় জননেত্রীকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল ভয়াবহতম দিন। অজস্র গ্রেনেড নিক্ষেপের পরও নেতাকর্মীদের মানবঢালের বেষ্টনীর কারণে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা। তবে নিহত হন অনেক আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী। এছাড়া অনলাইন, ব্লগ এবং ফেসবুকে জননেত্রীকে কটাক্ষ করে খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে বারবার। হত্যার প্রচেষ্টা ও হুমকির মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে শীঘ্রই মহামারি অতিক্রম করে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে- এটা নিশ্চিত। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল অশুভ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে।
বস্তুত আজকের করোনাকবলিত দিনটি ১৯৮১ সানের ১৭ মে’র মতো নয়। দুর্যোগের মধ্যেও আমরা বলতে পারি, সীমাবদ্ধ কালকে অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছেন সাফল্যের বিশাল স্বাক্ষর। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, নারীর অধিকার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত। আর বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তিনি জনগণের কাছে আজ নন্দিত। ১৭ মে ঐতিহাসিক দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। কারণ দিনটি তারই।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিল্টন বিশ্বাস মত-দ্বিমত যে দিনটিতে লেখা আছে বাংলাদেশের গৌরবগাঁথা